ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ব্রিটিশ থেকে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাব বেশি

প্রকাশিত: ০৩:৪১, ২৫ এপ্রিল ২০১৫

ব্রিটিশ থেকে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাব বেশি

প্রেক্ষিতটা সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের। তখন এক শ্রেণীর মিডিয়ার ভূমিকা ছিল বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার অনেকটা নিয়ন্ত্রণে। মিডিয়াগুলো সেনা-সমর্থিত সরকারের প্রশংসা এবং শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার বিপক্ষে সংবাদ প্রচার করত। আজ পড়ুন এরই ধারাবাকিতার অংশ- ২. লে. জে. মাহবুবুর রহমান- ‘৩৬ বছর কেটে গেছে এবং এই ৩৬ বছরে আমরা দেখছি যে, গণতন্ত্রের সত্যিকারের রূপরেখা সৃষ্টি হয়নি।... রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে একটা অসহিষ্ণুতা, রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে একটা সাংঘর্ষিক মনোভাব। গত ২৮ তারিখে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম. সাখাওয়াত যেটা বলেছেন, সত্যিই একটা তাণ্ডব, একটা হিংসাবিদ্বেষ, জিঘাংসা, হত্যাযজ্ঞ, জ্বালাও-পোড়াও অবস্থা দেশজুড়ে এবং ৩০টি জীবন ক্ষয় হয়ে গেছে। একটা মানুষ মরার পরেও আবার মারা হয়েছে। এটা আমি মনে করি, আমাদের দেশের যে ভাবমূর্তি তার ক্ষতি করেছে। ... আমি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সম্পর্কে এটুকু বলতে চাই যে একটা পেশায় দক্ষ সেনাবাহিনী নিশ্চয়ই এবং এই সেনাবাহিনী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীনতার সূতিকাগারে এর জন্ম এবং এই সেনাবাহিনী দেশের অনেক বিপর্যয়, অনেক দুর্যোগ, সেটা মানবসৃষ্ট বা প্রাকৃতিক যাই হোক জনগণের কাছে সবসময় ছিল। এ জন্যই আমি মনে করি, সেনাবাহিনীর বর্তমান ভূমিকা ইতিবাচক।’ মেজর জেনারেল ইবরাহিম যেহেতু রাজনীতিতে নামার চিন্তা করেছিলেন তাই খানিকটা ভিন্নভাবে সেনাবাহিনীকে সমর্থন করে বলেছিলেন, ‘যেহেতু আমাদের চাকুরি জীবনে আমাদের পেশাটাই ছিল নিরাপত্তার কথা চিন্তা করা এবং যে কোনো জিনিসকে যুক্তির সঙ্গে বিশ্লেষণ করা যার সঙ্গে আমাদের নেতৃত্ব, দেশের নেতৃত্ব পরিচিত না। ওনারা এলোমেলোভাবে চিন্তা করেন।’ তারপর তিনি আরো বলেন এক আলোচনা সভায়, ‘অপারেশন ক্লিনহার্টের কথা মনে করেন। মানবাধিকার লংঘিত হয়েছিল। [ইবরাহিম একমাত্র সেনাকর্মকর্তা যিনি এ কথা বলেছিলেন]। অনেক বেসামরিক ব্যক্তিত্ব সামরিক বাহিনীর হাতে মারা গিয়েছিলেন তার জন্য ইনডেমনেটি দিতে হয়েছিল। তার দুই বছর যেতে না যেতেই দেশবাসী আবার বলছেন, না, দেশে সামরিক বাহিনী আসুক [সত্য নয়]।” তবে যেহেতু তিনি রাজনীতি করছেন তাই তাকে বলতে হয়েছে, ‘কেউ বলছেন, সামরিক বাহিনী জাতিকে বাঁচিয়েছে এটা দৃশ্যত প্রমাণিত হয়নি।’ [প্রথম আলো ২৯.১.২০০৭] মেজর জেনারেল (অব.) আমিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের অভিজ্ঞতা বলছে যে [সংস্কার করতে হলে প্রতিষ্ঠানের] রাতারাতি প্রয়োজনবোধে সংবিধানবহির্ভুতভাবে করতে হবে। সংবিধানবহির্ভূতভাবে ছাড়া তাড়াতাড়ি কিছু করা যাবে না।’ পরে প্রথম আলোয় এক লেখায় তিনি উল্লেখ করেন ‘১৯৭৭ সালের পর থেকে সরকারী কোষাগারের টাকায় গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলভাঙা, রাজনৈতিক দল গড়া বা বিশেষ কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিকে দলেবলে কৌশলে দলে ভেড়ানোর জমকালো রাজনীতিবাণিজ্যের রমরমা ব্যবসা জমে উঠতে থাকে। কারণ, তখন সামরিক বেসামরিক আমরা রাজনীতির নিয়ন্ত্রক। ফলে, ভূঁইফোড়ে ভরে যায় রাজনৈতিক অঙ্গন। রাজনৈতিক দালালদের উৎপাতে রাজনীতিবিদরা হন নির্বাচিত, অথবা প্রচণ্ডভাবে মোসাহেবী ব্যবসায় নেমে পড়েন।’ [ঐ] ৮ ফেব্রুয়ারি [২০০৭] বান্দরবানে এক মতবিনিময় সভায় জে. মঈন বলেনÑ ১. ‘অনেকে মনে করছেন দেশে সামরিক শাসন চলছে। কিন্তু, এটা ভুল। জরুরী অবস্থাও সেনাবাহিনী ঘোষণা করেনি। দেশের সংকটময় মুহূর্তে মহামান্য রাষ্ট্রপতি জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেছেন।’ ২. ‘বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুর্নীতিবাজদের গ্রেপ্তারের যে উদ্যোগ নিয়েছে এ কাজে সবারই এগিয়ে আসা উচিত এবং দেশের মানুষও সেটা চাইছে।’ ৩. ‘দেশে এখন একটা নতুন পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে। বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করে রাজনীতিবিদরা এখন আর রাজনীতি করতে পারবেন না। যারা টাকার অভাবে এতদিন রাজনীতি করতে পারেননি, তারা এখন সেই সুযোগ পাবেন।’ বড়গুনায় তিনি বলেন, ‘গত ১৫ বছর গণতান্ত্রিকভাবে দেশ পরিচালিত হয়েছে। কিন্তু রাজনীতিকেরা পুরোপুরি জাতিকে হতাশ করেছেন। তাদের অধিকাংশই গণমানুষকে উপেক্ষা করে নিজেদের ভাগ্য গড়ার দিকে বেশি নজর দিয়েছেন।’ [ঐ, ১৪.২.২০০৭] মঈন আরো বলেনÑ ‘বাংলাদেশে নিজস্ব ধরনের গণতন্ত্রের জন্য রাষ্ট্রপতিকে আরো ক্ষমতা দিতে হবে। মন্ত্রীদের সবার ক্ষমতা হবে সমান, নির্বাচন কমিশনসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কাজে স্বচ্ছতা থাকতে হবে এবং জনগণের প্রশ্ন করার ও সঠিক উত্তর জানার অধিকার থাকবে। ক্ষমতা একজন ব্যক্তি, একটি পরিবার বা কোন বংশে কুক্ষিগত থাকবে না। ক্ষমতায় একটি ভারসাম্য থাকবে। তিনি আরো বলেন, আমরা ইলেকটিভ ডেমোক্রেসিতে ফিরে যেতে পারি না যেমন সমাজের সব স্তরে দুর্নীতির কারণে নিরাপত্তাহীনতা ও অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার সুশাসন বাধাগ্রস্ত হয়েছে, যেখানে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব ও অখণ্ডতার ওপর হুমকি সৃষ্টি করেছে। [ঐ. ৩.৪.২০০৭] সুতরাং মঈনের নেতৃত্বাধীন সামরিক বাহিনী নতুন কিছু করেনি। জিয়াউর রহমানের মতোই ক্ষমতা দখল করেছে। জিয়া প্রায়ই বলতেন, তিনি মার্শাল ল’ জারি করেননি এবং ক্ষমতা দখল করেননি, মোশতাক করেছিলেন। মঈনও বলতেন, জরুরী অবস্থা তিনি নয় ইয়াজউদ্দিন জারি করেছিলেন। জিয়াকে সামরিক বাহিনীর সক্রিয় ও নিষ্ক্রিয় সবাই সমর্থন করেছিলেন। মঈনের বেলায়ও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। মুক্তিযুদ্ধের উপাধিপ্রাপ্ত ও পাকিস্তান ফেরত সামরিক কর্মকর্তাদের মূল বক্তব্য ছিল একই। (চলবে)
×