ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দিলু রোডে সন্ত্রাসীদের এলোপাতাড়ি গুলি

জনকণ্ঠের সিএনজি চালক ইয়াকুবও মৃত্যুর কাছে হেরে গেলেন

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ২৪ এপ্রিল ২০১৫

জনকণ্ঠের সিএনজি চালক ইয়াকুবও মৃত্যুর কাছে হেরে গেলেন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ গত ১৩ এপ্রিল দিবাগত রাত দুটায় রাজধানীর রমনা মডেল থানাধীন দিলু রোডে সন্ত্রাসীদের এলোপাতাড়ি গুলিতে আহত তিনজনের মধ্যে দৈনিক জনকণ্ঠের পরিবহন পুলের সিএনজিচালক ইয়াকুব আলীও অবশেষে মৃত্যুর কাছে হার মানলেন। কি অপরাধ ছিল চালক ইয়াকুব আলীর? জানতে চেয়েছে তার পরিবার। নিহতের পরিবারের আর্তনাদে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিবেশ ভারী হয়ে পড়ে। শোকের ছায়া নেমেছে ইয়াকুব আলীর পরিবারে। এ নিয়ে আহত তিনজনের মধ্যে দুইজনের মৃত্যু হলো। ঘটনার দুদিন পর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রিক্সাচালক হাকিমের মৃত্যু হয়। আর আহত আরেক রিক্সাচালক রাতেই প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি চলে যান। ডান পায়ের হাঁটুর উপরের চামড়া ভেদ করে তার গুলি বেরিয়ে যায়। পুলিশ বলছে, গুলিবর্ষণের প্রকৃত কারণ জানার চেষ্টা চলছে। হত্যাকারীদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত আছে। তবে সন্ধ্যা ছয়টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ঘটনার সঙ্গে জড়িত কেউ আটক হয়নি। বৃহস্পতিবার বেলা তিনটার দিকে ইয়াকুব আলীর মৃত্যু হয়। কর্তব্যরত চিকিৎসকরা বলছেন, বুলেট বুকের দুই হাড়ের মাঝ দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। বুলেটটি গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে। ভেতরেই অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে ইয়াকুব আলীর মৃত্যু হয়। তার অস্ত্রোপচার করা অনেকটাই অসম্ভব ছিল। তার বুলেট স্থির করার চেষ্টা চলছিল। কিন্তু কোনক্রমেই সেটি হয়ে উঠছিল না। ঘটনার পর পরই অস্ত্রোপচার করা হলে রিক্সাচালক হাকিমের পরিণতি হতে পারত। এদিকে ইয়াকুব আলীর মৃত্যুতে থেমে যায় তাঁর জীবনের চাকা। শুধু তাই নয়, সেইসঙ্গে অচল হয়ে পড়েছে সংসার। সংসারের উপার্জনক্ষম একমাত্র ব্যক্তির মৃত্যুতে দুই সন্তান নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন স্ত্রী সালমা বেগম। মৃত্যুর পর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ১০১ নম্বর ওয়ার্ডে শোকের ছায়া নেমে আসে। নিহতের পরিবারের সদস্যদের গগন বিদারী আর্তনাদে সেখানকার আকাশ বাতাস ভারী হয়ে আসে। মেঝেতে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতে থাকে স্ত্রী সালমা বেগম আর তার তিন সন্তান। সালমা বেগম বলেন, কিভাবে তিনি সংসার চালাবেন, তা আল্লাহই জানেন। সংসারে রোজগার করার মতো কেউ নেই। ভবিষ্যত অন্ধকার ভেবে বার বার মূর্ছা যাচ্ছিলেন তিনি। তার স্বামীকে কেন সন্ত্রাসীরা হত্যা করল, কি দোষ ছিল তার, তাও জানতে চেয়েছেন তিনি। হত্যাকারীদের কঠিন শাস্তিও দাবি করেছেন ইয়াকুবের স্ত্রী। বার বার একই কথা বলেই মূর্ছা যাচ্ছিলেন সালমা বেগম। নিহত সিএনজিচালক ইয়াকুব আলীর পিতার নাম আরব আলী শেখ। বাড়ি বাগেরহাট সদরের কাঁটাবনিয়া গ্রামে। দুই ভাই দুই বোনের মধ্যে ইয়াকুব সবার বড় ছিলেন। নিহত ইয়াকুব আলী দ্বিতীয় স্ত্রী সালমা বেগম, দুই ছেলে জামাল (১৫) ও বাবুকে (১৩) নিয়ে রাজধানীর খিলগাঁও নন্দীপাড়ার বটতলার মোয়াজ্জেম কলোনির ক্যাম্প গলির জব্বারের বাড়িতে ভাড়ায় থাকতেন। মাসিক ১৮শ’ টাকা ভাড়ায় এক বছর ধরে ওই বাড়িতে এককক্ষের বাসায় থাকতেন। বড় মেয়ে লোনা (১৮) বিবাহিত। লোনার স্বামী আলমগীর হোসেন (২৫) জানান, তার শ্বশুরকে রাজধানীর নন্দীপাড়া কবরস্থানে দাফন করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতে সম্ভব না হলে শুক্রবার দাফনের কথা রয়েছে বলেও জানান তিনি। প্রসঙ্গত, গত ১৩ এপ্রিল রাত দুটায় নিউ ইস্কাটনের দিলু রোড মোড়ে ঘটনাটি ঘটে। সিএনজিযোগে চালক ইয়াকুব আলী দৈনিক জনকণ্ঠের সিনিয়র সাব-এডিটর আল আমিনকে দিলু রোডের বাসায় পৌঁছে দিতে যাচ্ছিলেন। এ সময় একটি নোয়া গাড়ির জানালা খুলে আগ্নেয়াস্ত্র থেকে এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে থাকে সন্ত্রাসীরা। ইয়াকুব আলীর (৪৫) ডান বুকে একটি, সিএনজির পেছনে থাকা রিক্সাচালক হাকিমের (৩০) বাম বুকে দুটি ও অজ্ঞাত আরেক রিক্সাচালকের ডান পায়ে হাঁটুর উপরে একটি গুলি লেগে চামড়া ভেদ করে বেরিয়ে যায়। ইয়াকুব আলী ও রিক্সাচালক হাকিমকে রাতেই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ১০১ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। আর অজ্ঞাত রিক্সাচালক রাতেই প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফেরেন। উল্লেখ্য, ঘটনার দুদিন পর গুলিবিদ্ধ হাকিমের অস্ত্রোপচারের উদ্যোগ নেন চিকিৎসকরা। অপারেশন টেবিলেই হাকিমের মৃত্যু হয়। ওয়ার্ডের অন্যান্য রোগীর সঙ্গে থাকা লোকজনরা জানান, পরিবারের সদস্যদের অতিরিক্ত পীড়াপীড়ির কারণেই চিকিৎসকরা জরুরী অস্ত্রোপচার করতে অনেকটাই মানসিকভাবে বাধ্য হন বলে ধারণা করা হয়। হাকিমের মা মনোয়ারা বেগম (৫০) জনকণ্ঠকে জানান, তার দুই ছেলে এক মেয়ে। হাকিম সবার বড় ছিল। মাস খানেক আগে হাকিমের স্ত্রী মৃত্যু হয়। হাকিম রাজধানীর রমনা মডেল থানাধীন মগবাজারের মধুবাগে বসবাস করত। নিহত ইয়াকুবের সিএনজিতে থাকা জনকণ্ঠের সিনিয়র সাব-এডিটর আল আমিন এ প্রতিবেদককে বলেন, গুলিবর্ষণের ধরনে মনে হয়, সন্ত্রাসীদের টার্গেট তারা ছিলেন না। তারা পরিস্থিতির শিকার। সন্ত্রাসীরা গুলি চালিয়েই চলে যায়। তিনি সিএনজি থেকে নেমে অফিসে আসেন। এ ব্যাপারে রমনা থানায় দায়েরকৃত মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা উপপরিদর্শক সাইফুল ইসলাম ইয়াকুব আলীর লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরিকালে জনকণ্ঠকে বলেন, হত্যাকা-ের মোটিভ জানা যায়নি। হত্যাকারীদের গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত আছে। এ ব্যাপারে ডিএমপির রমনা বিভাগের সহকারী কমিশনার এসএম শিবলী নোমান জনকণ্ঠকে জানান, গুলি চালানোর সুনির্দিষ্ট কারণ জানা যায়নি। আধিপত্য বিস্তার বা অন্য কোন কারণে গুলি চালানোর ঘটনাটি ঘটতে পারে। হত্যাকারীদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। গুলিবর্ষণের ঘটনাটি পরিকল্পিত কিনা সে বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
×