ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ খাজা মুঈনুদ্দীন চিশ্তী (রহ.)

প্রকাশিত: ০৪:৩২, ২৪ এপ্রিল ২০১৫

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ খাজা মুঈনুদ্দীন চিশ্তী (রহ.)

উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারে সূফীয়ায়ে কেরামের অবদান যে সর্বাধিক এটা সর্বজনবিদিত। এ ক্ষেত্রে বিশেষ বিশেষ অবদান রাখেন হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশ্তী সঞ্জরী আজমীরী রহমাতুল্লাহি আলায়হি। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১১৪১ খ্রিস্টাব্দে পারস্যের সিজিস্তানের সঞ্জর নামক স্থানে। তাঁর আব্বা খাজা গিয়াসুদ্দীন রহমাতুল্লাহি আলায়হি এবং আম্মা বিবি মাহনুর রহমাতুল্লাহি আলায়হা। উভয় ছিলেন সেকালের নামকরা বুযুর্গ। খাজা মুঈনুদ্দীন চিশ্তীর আদুরে নাম ছিল হাসান। যে কারণে তাঁর নামের সঙ্গে হাসান নামও যুক্ত হয়। পরবর্তীকালে তিনি যেসব খেতাবে ভূষিত হন তাঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে : খাজায়ে খাজেগান, সুলতানুল হিন্দ, সুলতানুল আরিফীন, গরীবে নওয়াজ। এখানে তছার গরীবে নওয়াজ খেতাবটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। গরীবে নওয়াজ অর্থ হচ্ছে অসহায় দরিদ্রজনের প্রতিপালক। বাস্তবেও তিনি হক্কুল্লাহ্ ও হক্কুল ইবাদের প্রতি সমান গুরুত্ব আরোপ করতেন, যে কারণে তিনি শরীআত, তরীকত, হকীকত ও মা‘রিফাত সমন্বয়ে বিন্যাসিত ইল্মে তাসাওউফ অর্জনের জন্য যেসমস্ত গুণাগুণ থাকা প্রয়োজন তাঁর মধ্যে একটি গুণ হিসেবে আর্তমানবতার সেবাকে যুক্ত করেছেন। এখনও প্রতিদিন তাঁর মাযার শরীফ চত্বরে স্থাপিত লঙ্গরখানায় শত শত দরিদ্রজন খাবার খেয়ে থাকে। খাজা মুঈনুদ্দীন চিশ্তী রহমাতুল্লাহি আলায়হি শৈশবেই কুরআন মজীদ হিফ্জ করেন। প্রাথমিক শিক্ষা তিনি লাভ করে ইস্পাহানে, খোরাসানে। প্রায় পনেরো বছর বয়সে তিনি পিতৃহারা হন। পিতার সম্পত্তি থেকে তিনি একটি আঙ্গুরের বাগান এবং পানির স্রোতে চালিত যাঁতা (ডধঃবৎ গরষষ) ফরায়েয অনুসারে লাভ করেন। একদিন তিনি বাগান দেখাশোনা করছিলেন। এমন সময় সেখানে হযরত ইব্রাহীম কুন্দুযী নামক একজন মজযুব দরবেশ সহসা হাজির হয়ে তার কাছে খেতে চাইলে তিনি তাকে কিছু আঙ্গুর খেতে দিলেন। এতে ঐ মজযুব দরবেশ সন্তুষ্টি প্রকাশ করে তাঁর জন্য দু’আ করলেন এবং তিনি যে একজন মস্ত বড় আল্লাহ্র ওলী হবেন তা বলে সহসা অদৃশ্য হয়ে গেলেন। এই ঘটনা তাঁর অন্তরে দারুণ আলোড়ন সৃষ্টি করল। কিশোর মুঈনুদ্দীনের মধ্যে আল্লাহ্র নৈকট্য লাভের স্পৃহা প্রবলভাবে জাগ্রত হলো। তিনি উত্তরাধিকারী সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদ বিক্রি করে দিয়ে তার অর্থ গরীবদের মধ্যে বিলিয়ে দিলেন এবং আল্লাহর অন্বেষণের উদ্দেশ্যে গৃহত্যাগ করলেন। তিনি দীনি তালীম গ্রহণ করলেন খোরাসান, সমরকন্দ এবং বুখারার শ্রেষ্ঠ সব মাদ্রাসায় সেকালের মশহুর আলিমগণের কাছ থেকে। একপর্যায়ে তিনি বাগদাদ শরীফে যেয়ে পীরানে পীর দস্তগীর গওসুল আজম হযরত আবদুল কাদির জিলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হির দরবারে যেয়ে তার দুআ ও ফয়েয লাভ করেন। তিনি অতি অল্প সময়ে ইল্মে জাহিরের তাবত জ্ঞান ও বিদ্যা হাসিল করে উঁচু স্তরের আলিম হিসেবে মশহুর হন। তারপর তিনি ইল্মে তাসাওউফ হাসিলেরর জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। ৫৬০ হিজরীতে তিনি নিশাপুরের হাওয়ানের বিশিষ্ট সূফী হযরত খাজা আবুল মন্সুর উসমান হারূনী রহমাতুল্লাহি আলায়হির খানকা শরীফে যেয়ে তাঁর হাতে বয়’আত হন। তিনি হযরত উসমান হারূনী রহমাতুল্লাহি আলায়হির খানকা শরীফে আড়াই বছরকাল অবস্থান করে পীর কেবলার নিকট থেকে তাসাওউফের তাবত তালীম গ্রহণ করে পূর্ণতা বা কামালিয়াত হাসিল করেন। পীর কেবলা উসমান হারূনী তাঁকে খিলাফতনামা ও র্খিকা প্রদান করে তাকে খলীফা মনোনীত করেন। তিনি কারামত ও কাশ্ফ শক্তিসম্পন্ন এক মহান সূফীতে পরিণত হন। তিনি পীরের ইজাজত প্রাপ্ত হয়ে বাগদাদ শরীফের উদ্দেশে রওনা হন। পথিমধ্যে সাঞ্জান নামক স্থানে আর একজন বিশিষ্ট সূফী কুব্রাবীয়া তরীকা বিন্যাসকারী হযরত নজমুদ্দীন কুব্রা রাহমাতুল্লাহি আলায়হির সঙ্গে তাঁর মোলাকাত হয়। এখানে কয়েকদিন অবস্থান করে তিনি বাগদাদ শরীফে যান এবং হযরত গওসুল আজম আবদুল কাদির জিলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হির সান্নিধ্য লাভ করেন। তিনি আট সপ্তাহকাল গওসুল আজমের সান্নিধ্যে থেকে তাসাওউফের সর্বোচ্চ মকামে উন্নীত হন। গওসুল আজম রহমানুল্লাহি আলায়হির ফয়েয ও তাওয়াজ্জুলহ্র বরকতে তিনি বিলায়েতের অপরূপ সৌকর্য সুষমায় ম-িত হন। গওসুল আজম তাকে হিন্দুস্তানের রূহানী কর্তৃত্ব দ্বারা ভূষিত করেন। তিনি বিলায়েতের স্বীকৃতি লাভ করেন। বাগদাদ শরীফ থেকে তিনি বিভিন্ন দেশ ও শহর নগর সফর করে বহু বুযুর্গের সান্নিধ্যে যেয়ে তাঁর অভিজ্ঞতাকে আরও সমৃদ্ধ করেন। তারপর তিনি মক্কা মুকাররমা যেয়েও বহু বুযুর্গের সঙ্গে মিলিত হন। মক্কা মুকাররমায় তিনি বেশ কিছুদিন অবস্থান করেন এবং হজ পালন করেন। তারপর তিনি মদীনা মনওয়ারায় এসে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের রওযা মুবারক যিয়ারত করেন। মদীনা মনওয়ারায় তিনি বেশ কিছুদিন অবস্থান করেন। এখানে অবস্থানকালে তিনি স্বপ্নযোগে কারও কারও দেয়া তথ্যানুযায়ী মুরাকাবারত অবস্থায় হিন্দুস্তানে আসবার নির্দেশপ্রাপ্ত হন। এই নির্দেশ স্বয়ং প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামই তাঁকে দান করেন। এরি মাধ্যমে গওসুল আজম আবদুল কাদির জিলানী আল বাগদাদী রহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁকে যে হিন্দুস্তানের রূহানী কর্তৃক দান করেছেন তা নিশ্চিতভাবে স্বীকৃতি লাখ করল। তিনি লাহোরে এসে খানকা শরীফ স্থাপন করেন। এখানে উল্লেখ্য যে, ১১৯১ খ্রিস্টাব্দে চৌহান রাজ পৃথ¦ীরাজের সঙ্গে গজনীর সুলতান শিহাবুদ্দীন মুহম্মদ ঘুরীর তরাইন নামক স্থানে যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে ঘুরী সাফল্য অর্জন করতে না পারলে ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে খাজা মুঈনুদ্দীন চিশ্তী রহমাতুল্লাহি আলায়হির দু’আর বরকতে তরাইরেন ২য় যুদ্ধে তিনি বিজয় পতাকা উড্ডীন করেন এবং তদানীন্তন ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের সুদৃঢ়প্রসারী বুনিয়াদ স্থাপন করেন। আর এর পেছনে যে মহান সূফীর দু’আ ছিল তিনি হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশ্তী রহমাতুল্লাহি আলায়হি। জানা যায়, তিনি লাহোর থেকে ১১৯৩ খ্রিস্টাব্দে দিল্লীতে এসে কিছুকাল অবস্থান করে ১১৯৫ খ্রিস্টাব্দে আজমীর শরীফে এসে স্থায়ী খানকা শরীফ স্থাপন করেন। দলে দলে লোক তাঁর মুরীদ হতে থাকে এবং অন্যান্য ধর্মের বহুলোক ইসলাম গ্রহণ করে। অল্পদিনের মধ্যে আজমীর শরীফ সমগ্র উপমহাদেশের রূহানী রাজধানীতে পরিণত হয়। তিনি ৬৩৩ হিজরীর ৬ রজব রাতের বেলায় গভীর মুরাকাবারত অবস্থায় তাঁর হুজ্রা শরীফেই ইন্তেকাল করেন এবং সেখানে তাঁকে দাফন করা হয়। আজমীর শরীফ কালক্রমে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের তীর্থস্থানে পরিণত হয়। হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশ্তী রহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেছেন : আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভ করার জন্য শরী’আতের পূর্ণ পাবন্দ হওয়া অবশ্য কর্তব্য। শরী’আত ও তরীকত বর্জন করে সূফী হওয়া যায় না। মাযার শরীফ সংরক্ষণ ও সৌন্দর্যকরণের কাজ তাঁর ইন্তেকালের পরপরই শুরু হয়। ১৪৫৫ খ্রিস্টাব্দের সুলতান মাহমুদ খিলজী (১৪৩৬-৬৯) মাযার শরীফের প্রবেশ পথে বুলন্দ দরওয়াজা নামে এক বিশাল সুরম্য তোরণ নির্মাণ করেন। ঐখানে একটি মসজিদ ও মাযার শরীফের ওপর একটি গম্বুজও নির্মিত হয়। পরবর্তীকালে মুগল সম্রাট আকবর খাজা মুঈনুদ্দিন চিশ্তী রহমাতুল্লাহি আলায়হি রূহানী শক্তির ফলাফল লাভ করেন। যে কারণে তিনি হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশ্তীর প্রতি ভীষণভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। সম্রাটের কোন সন্তানাদি হচ্ছিল না। তখন তিনি একজন চিশতিয়া তরীকার পীরের কাছে থেকে সন্তান লাভের জন্য তদবীর নিয়ে সন্তান লাভ করেন। সেই পীর হচ্ছেন শাহ সেলিম চিশতী। যার মাযার সম্রাট আকবরের মাযারের কাছেই রয়েছে। সে যাক, সেলিম চিশতীর নামে তিনি পুত্রের নাম রাখেন নুরুদ্দীন মুহম্মদ সেলিম। এই সেলিমই পিতার মৃত্যুর পর জাহাঙ্গীর উপাধি ধারণ করে হিন্দুস্তানের বাদশাহ হয়েছিলেন। সম্রাট আকবর পুত্রসন্তান লাভ করায় এত খুশি হয়েছিলেন যে ১৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে আগ্রা থেকে দীর্ঘপথ হেঁটে আজমীর শরীফ এসে খাজা মুঈনুদ্দীন চিশ্তী রহমাতুল্লাহি আলায়হির মাযার শরীফ যিয়ারত করেন এবং এর উন্নয়নের জন্য প্রচুর অর্থ বরাদ্দ করেন। তিনি দশ হাজার লোকের খাবার একটা পাত্রে রান্না করার উপযোগী একটি ডেকচি তৈরি করেন এবং তা মাযারের বাইরের চত্বরে স্থাপন করেন একটি চুল্লির ওপর। তিনি বেশ কিছুদিন আজমীর শরীফে অবস্থান করেন এবং ঐ ডেকচিতে খাদ্য রান্না করে নিজ হাতে যিয়ারতকারী সবার মধ্যে খাবার পরিবেশন করেন বলে জানা যায়। পিতার ইন্তেকালের পর জাহাঙ্গীর বাদশাহ্ হয়ে ১৬১৪ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী রহমাতুল্লাহি আলায়হির মাযার শরীফ যিয়ারত করতে আজমীর শরীফ আসেন এবং পাঁচ হাজার লোকের খাবার রান্নার উপযোগী একটি ডেকচি এখানে স্থাপন করেন। মুগল আমলে মাযার শরীফ এবং এর আশপাশের সম্প্রসারণ ও সৌন্দর্যকরণের কাজ সবচেয়ে বেশি হয়। সম্রাট শাহ্জাহান ও সম্রাট আওরঙ্গজেব মসজিদ স্থাপন করেন। সম্রাট শাহ্জাহান সমগ্র মাযার এলাকা শ্বেতপাথর দিয়ে বেঁধে দেন। আজও লাখ লাখ লোক খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতি রহমাতুল্লাহি আলায়হি মাযার শরীফ যিযারত করতে ভিড় জমায়। হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী (রহ.) উপমহাদেশে চিশ্তীর তরীকা নিয়ে আসেন। ইল্মে তাসাউফে যে প্রধান প্রধান তরীকা বা পদ্ধতি রয়েছ তার মধ্যে কাদিরীয়া, চিশ্তীয়া, নকশবন্দীয়া, মুজাদ্দাদিয়া, সুহরাওয়ারদীয়া প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। চিশ্তীয়া তরীকার প্রচলন বাংলাদেশেও রয়েছে। কিন্তু একশ্রেণীর ভ- ও প্রতারক খাজা বাবা, চিশ্তী, আজমেরী উপাধি ধারণ করে পীর সেজে মানুষকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা চালিয়ে আসছে। এদের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করা উচিত। প্রকৃত পীরের কাছ থেকে এই তরীকার নিসবত অনুযায়ী যদি যথাযথ তা’লীম নেয়া যায় তাহলে অতি সহজেই আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা ও রসূলের মুহব্বত হাসিল করা সম্ভব হয়। খাজা মুঈনুদ্দীন চিশ্তী (রহ.) সম্পর্কে আমাদের জাতীয় জাগরণের কবি ফররুখ আহ্মদ সুলতানুল হিন্দ কবিতায় বলেন, নয়া জিন্দিগীর স্বপ্নের আনিলে নতুন সূর্যোদয়! সেই থেকে তুমি আছো হিন্দের একক সুলতান। কোন সম্রাটের ধ্বজা দেখেনি এ জীবন অক্ষয়, কোন প্রেমিকের বহ্নি জ্বলেনি এমন অনির্বাণ। লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ, উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা.) সাবেক পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
×