ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

তামাক চাষের বিকল্প

কোলেস্টেরলমুক্ত তেল-জনপ্রিয় হয়ে উঠছে সূর্যমুখী ফুলের চাষ

প্রকাশিত: ০৬:১৬, ২৩ এপ্রিল ২০১৫

কোলেস্টেরলমুক্ত তেল-জনপ্রিয় হয়ে উঠছে সূর্যমুখী ফুলের চাষ

জাহাঙ্গীর আলম শাহীন ॥ লালমনিরহাটে তামাক চাষের জায়গা দখল করে নিচ্ছে সূর্যমুখী ফুল। জেলার আদিতমারী, কালীগঞ্জ, হাতীবান্ধা ও লালমনিরহাট সদরের বড়বাড়িতে তামাক চাষের বিকল্প হিসেবে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সূর্যমুখী ফুলের চাষ করে কৃষক লাভবান হয়েছে। এর মাধ্যমে কৃষি অর্থনীতিতে সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। কৃষকরা তামাক চাষে উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে। অনেক কম পরিশ্রম ও অর্থ বিনিয়োগ করে গ্রামের কৃষক পরিবারগুলো তামাকের চেয়েও সূর্যমুখী চাষে বেশি লাভবান হয়েছে। সূর্যমুখী চাষে ফুলের মতো কৃষকের মুখে হাসি ফুটে উঠছে। তামাক কোম্পানিগুলোর নিয়োগকৃত মাঠকর্মীদের প্ররোচনায় কৃষক তামাক চাষ করে। বেশি দাম দিয়ে কেনার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু কৃষক দাম ঠিকমতো পায় না। নানা অজুুহাতে তামাক চাষ ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়। তামাক পাতা নেশা দ্রব্য। তাই চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি হলে বাজারে দাম পড়ে যায়। তখন কৃষক অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিতে পড়ে যায়। কিন্তু সূর্যমুখী চাষে কোন ঝুঁকি নেই। এটা খাদ্য শস্যভুক্ত। ভোজ্য তেল ও সব ধরনের সবজির সঙ্গে খাওয়া যায়। পুষ্টিমান অনেক অনেক গুণে বেশি। কোলেস্টেরলমুক্ত তেল। এই অঞ্চলের কৃষকের খাতায় লাভজনক কৃষি ফসল হিসেবে সূর্যমুখী চাষ ব্যাপক সাড়া ফেলে দিয়েছে। লালমনিরহাট জেলা সদরের প্রায় ১৫ কিলোমিটার অদূরে বড়বাড়ির পশ্চিম বুদারু গ্রাম। এই গ্রামে আউশ ও আমন ধানের চাষ ছাড়া কৃষক কোন অর্থকরী ফসল ফলানোর চিন্তা মাথায় নেয়নি। গ্রামের কৃষকের সরলতার সুযোগ নিয়ে তামাক কোম্পানির লোকজন তামাক চাষে উৎসাহিত করে। কৃষক তামাক চাষ করে প্রতারণার শিকার হয় বারবার। কৃষকের কাছে বিকল্প কোন চাষযোগ্য ফসল ছিল না। এমন সময় ব্র্যাক নামের একটি এনজিও তামাক চাষের বিকল্প হিসেবে সূর্যমুখী চাষ করার সুযোগ তৈরি করে। এই সূর্যমুখী ফুলচাষের কারণে বছরে দুই সফলা জমিতে তিন ফসল চাষ করা যায়। তামাকের পাতা সংগ্রহের পর গাছ জৈব সার হিসেবে জমিতে ব্যবহার করা যায় না। এতে ফসলের ক্ষেতের উর্বরতা শক্তি নষ্ট হয়ে যায়। জমির মাটি বিষাক্ত হয়ে যায়। কিন্তু সূর্যমুখী ফুলের বীজ সংগ্রহ করার পর বিশাল বিশাল গাছগুলো জমিতে পচিয়ে জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এতে জমির জৈবসারের ঘাটিত পূরণ হয়। অনেক কৃষক পরিবার তার দৈনন্দিন জীবনে রান্নার কাজের জ্বালানি হিসেবে (খড়ি) ব্যবহার করে থাকে। এতে করে জ্বালানি কাঠের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস পায়। ব্র্যাকের কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচীর আঞ্চলিক কর্মকর্তা বিপ্লব কুমার নাগ জানায়, ব্র্যাক কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচীর অধীনে দারিদ্র্য ও ক্ষুদা দূরীকরণের লক্ষ্যে ব্যাপকভিত্তিক কৃষকদের কারিগরি জ্ঞান ও উন্নত কলাকৌশলের মাধ্যমে ফসল চাষে উদ্বুদ্ধকরণ করা হয়। বুদারু গ্রামে ৩২ জন কৃষক ২০ একর জমিতে এই সূর্যমুখী চাষ করেছে। এদের মধ্যে ৬ জন নারী কৃষানি রয়েছে। এছাড়াও জেলার আদিতমারী উপজেলার কমলাবাড়ি ধনিরটারী, কালীগঞ্জ উপজেলার কাকিনা, ভোটমারী, তুষভান্ডার, মদাতি, চন্দ্রপুর ও হাতীবান্ধা উপজেলার সিংগিমারীসহ মোট ৭০ একর জমিতে সূর্যমুখী চাষ হয়েছে। ফলনো হয়েছে বাম্পার। লালমনিরহাট জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সূত্রে জানাগেছে, লালমনিরহাট জেলায় সরকারী বেসরকারী ও এনজিওদের মাধ্যমে প্রচলিত কৃষি শস্যের বাইরে গিয়ে নতুন নতুন লাভজনক ফসল চাষে কৃষককে প্রেরণা যোগাতে মাঠ পর্যায়ে কাজ চলছে। বিশেষ করে ধরলা, তিস্তা, স্বর্ণমতি, বুড়ি তিস্তা, দুধকমল ও রতœাই নদীর চরাঞ্চলের বালুতে কিভাবে কৃষি কাজ করা যায়। কিভাবে চরের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়। এই লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে মাঠ পর্যায়ে দু’ ফসলা জমিতে কিভাবে বছরে ৩টি অর্থকরী কৃষি সফল খাদ্য শষ্য চাষ করা যায়। তা নিয়ে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে। সফলতাও এসেছে। চরের ধু ধু বালু মাটিতে বিশেষ পদ্ধতিতে সব্জি চাষ, মিষ্টি কুমড়া চাষ, আলু চাষ, স্ট্রবেরি ফল চাষ ও নীল চাষ বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এখন চরের বালু জমি ফেলনার নয়। প্রতিটি চর এখন একেকটি অর্থকরী ফসল চাষের খাদ্য ঝুড়িতে পরিণত হয়েছে। প্রচলিত ফসলের বাইরে গিয়ে বছরে দু’ ফসলা জমিতে ৩টি অর্থকরী কৃষি ফসল আবাদের অংশ হিসেবে লালমনিরহাট জেলার সদর, আদিতমারী, কালীগঞ্জ ও হাতীবান্ধা উপজেলার কয়েকটি গ্রামে প্রায় ৭০ একর জমিতে সূর্যমুখী ফুল বাণিজ্যিকভাবে চাষ হয়েছে। এই ফুল ফুল হিসেবে চাষ করা হচ্ছে না। ফুল পেকে ফুলের ভেতরের দানা সংগ্রহ করা হচ্ছে। দানা সবজির সঙ্গে বেটে রান্না করে খাওয়া যায়। তাছাড়াও ভোজ্যতেল হিসেবে খাওয়া যায়। এনজিও ব্র্যাকের কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচী তামাকের বিকল্প হিসেবে সূর্যমুখী চাষকে জনপ্রিয় করতে কাজ করছে। এই চাষে সফল হলে উত্তরাঞ্চলে তামাক চাষের মাধ্যমে খাদ্য ঝুঁকির হুমকি অনেক কমে যাবে। সূর্যমুখী একটি অর্থকরী কৃষি ফসল। মূলত প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে সূর্যমুখীর চাষ করা হচ্ছে। সূর্যমুখী ফুলের দানা থেকে ভোজ্যতেল উৎপাদন করা হবে। এছাড়াও সর্ষে বাটার মতো করে সূর্যমুখী ফুলের দানা খাওয়া যায়। গ্রামের মানুষের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনবে। কৃষকরা জানান, এক একর জমিতে সূর্যমুখী চাষে খরচ পড়ে প্রায় ১৩ হাজার টাকা। একরে সূর্যমুখী উৎপাদন হয় ৩৩-৩৫ মণ। একমন সূর্যমুখী ফুলের বীজের বাজার মূল্য প্রায় ১৩-১৪ শত টাকা। একরপ্রতি উৎপাদন খরচ বাদ দিয়ে কৃষকের প্রায় কমবেশি ১২ হতে ১৫ হাজার টাকা লাভ থাকে। সূর্যমুখী চাষের জমিতে বছরের ৩টি ফসল করা যায়। আমন, রবিশস্য ও বোরো ধান। সূর্যমুখী ফুলের গাছ জমির সবুজ সারের চাহিদা মেটায়। জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি পায়। জেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ আবদুল মজিদ জানান, সূর্যমুখী চাষ কৃষক পরিবারগুলো ব্যাপক সাড়া ফেলে দিয়েছে। সূর্যমুখী চাষ গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে। কৃষক পরিবারগুলো ফুলচাষে লাভের মুখ দেখায় সূর্যমুখী ফুল চাষে ঝুঁকে পড়েছে। সূর্যমুখী ফুল চাষে তামাক চাষের বিকল্প অর্থকরী ফসল হতে পারে। সূর্যমুখী চাষ অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক। তামাক চাষের চেয়ে অনেক পরিশ্রম কম। তামাক চাষে চাষীর পরিবারের ছোট বড় সকলেই কাজ করে। ভালভাবে হিসাব করলে তামাক চাষে তেমন লাভ নেই। সেই হিসাবে সূর্যমুখী চাষ অনেক লাভ জনক। সূর্যমুখীর চারা রোপণের ১১৫ দিনের মধ্যে ফসল পাওয়া যায়। এই ফসলের পাশাপাশি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ক্ষত্রে মৌমাছি চাষ করে মধু সংগ্রহ করা যায়। এই সঙ্গে মৌমাছি ও সূর্যমুখী ফুলের বীজ পাওয়া যায়। বর্তমান বিশ্বে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে একই ফসলের মৌসুমে একাধিক খাদ্য উৎপাদন জনপ্রিয় হচ্ছে। সেই দিক থেকে সূর্যমুখী চাষ ও মধু চাষ একই সময় হচ্ছে। দুইটি খাদ্য পণ্য পুষ্টিমানে অত্যন্ত গুণের অধিকারী ও জনপ্রিয়।
×