ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাংলাদেশ ৮ উইকেটে জয়ী

সৌম্যর সেঞ্চুরিতে উড়ে গেল পাকিস্তান ॥ বাংলাওয়াশ

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ২৩ এপ্রিল ২০১৫

সৌম্যর সেঞ্চুরিতে উড়ে গেল পাকিস্তান ॥ বাংলাওয়াশ

মিথুন আশরাফ ॥ অবশেষে উৎসবের আনন্দে একসঙ্গে মাতল ১৬ কোটি প্রাণ। প্রথম দুই ওয়ানডে জেতার পর পুরো জাতির উৎসবের সঙ্গে পুরোপুরি মিশে যাননি ক্রিকেটাররা। তৃতীয় ওয়ানডে ৮ উইকেটে জেতার পর যখন পাকিস্তানকে বাংলাওয়াশ করা নিশ্চিত হলো তখন ক্রিকেটাররাও আনন্দে উন্মাতাল হয়ে গেলেন। উৎসবে ভেসে গেল পুরো বাংলাদেশ! লেগে ব্যাটের কানায় লাগিয়ে প্যাডেল সুইপ করলেন তামিম। অর্ধশতকও হয়ে গেল। আনন্দ উদযাপনও করতে চাইলেন বাংলাদেশ ওপেনার। কিন্তু ড্রেসিংরুম থেকে দুই হাত মেলে তামিমকে ‘কুল ডাউন’ থাকতে বললেন অধিনায়ক মাশরাফি। চূড়ান্ত উৎসবের সময় যে তখনও হয়নি। পাকিস্তানের ৪৯ ওভারে করা ২৫০ রানের জবাবে সৌম্য সরকারের অপরাজিত ১২৭ রানে যখন ৩৯.৩ ওভারে ২ উইকেট হারিয়ে ২৫১ রান করে জয় মিলে গেল, নিশ্চিত হলো পাকিস্তানকে বাংলাওয়াশ করা; তখন কী আর তামিম উৎসব না করে পারেন? সিরিজের সেরা ব্যাটসম্যান, টানা দুই ম্যাচে শতক করার পর তৃতীয় ওয়ানডেতেও ৬৪ রান করে বাংলাদেশের ইতিহাসে তিন ম্যাচের সিরিজে সর্বোচ্চ ৩১২ রান করা তামিম তাই উৎসব করলেন। মাঠে দৌড়ে যাননি, তবে ড্রেসিংরুমে থাকা ক্রিকেটারদের জড়িয়ে ধরলেন। এক অন্যরকম প্রশান্তি মিলল যেন। তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে ৭৯ রানে জিতল বাংলাদেশ। ১৬ বছর পর পাকিস্তানের বিপক্ষে জিতল। পুরো জাতি উৎসবে মাতলেও তাতে গা ভাসিয়ে দেননি মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিকরা। তখনও যে সিরিজের দুটি ম্যাচ বাকি। ১৬ কোটি প্রাণ যেন এক হতে পারল না। দ্বিতীয় ওয়ানডেতেও ৭ উইকেটের বড় ব্যবধানেই জয় ধরা দিল। পাকিস্তানকে ৩ দিনের মধ্যে ২ ম্যাচ হারিয়ে সিরিজও জিতে নিল বাংলাদেশ! তাতেও সেইরকম কোন আনন্দ উদযাপন করতে দেখা যায়নি ক্রিকেটারদের। দলের অবস্থা এখন এমন, পাকিস্তানের বিপক্ষে যে জেতা যাবে শুরু থেকেই তো তা বুঝতে পেরেছেন ক্রিকেটাররা। তাই তো ক্রিকেটারদের মধ্যে ছিল না বাঁধভাঙ্গা উল্লাস। তাই শুধু দেশের মানুষই বিজয়ের আনন্দ পুরোদমে করতে থাকলেন। কিন্তু যখন পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ অথবা ধবলধোলাই অথবা বাংলাওয়াশ করা হয়ে যাবে, তাতেও নির্লিপ্ত থাকবেন টাইগাররা? নাহ, এবার আর উৎসব ছাড়া কোন কিছুই মিলল না। মাঠে ১১ জন বাংলাদেশকে জয় এনে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ১৬ কোটি প্রাণ এক হয়ে গেল। আনন্দ, উৎসব, উল্লাস; সব হলো এবার। নির্মলেন্দু গুণের উক্তি মতেই, ‘যুদ্ধ মানে শত্রু শত্রু খেলা, যুদ্ধ মানেই আমার প্রতি তোমার অবহেলা’র মতোই বাংলাদেশ ক্রিকেট দল করল। পাকিস্তানকে পাত্তাই দিল না। যুদ্ধ মানেই শত্রুকে হারিয়ে দিতেই হবে। যেভাবে পারা যায় শত্রুকে ঘায়েল করতে হবে। বাংলাদেশ তাই করল। সিরিজ শুরুর আগে সাকিবের ‘ফেবারিট’ তকমায় ঘায়েল হলো পাকিস্তান। আর মাঠের লড়াইয়ে তামিম, মুশফিক, তৃতীয় ওয়ানডেতে শতক করা সৌম্য, সাকিবরা পাত্তাই দিলেন না আজহার, হারিস, ফাওয়াদদের। সুকান্ত ভট্টাচার্য্যরে ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়ে’র মতো শুধু পাকিস্তানের বিপক্ষে ১৯৯৯ সালের পর ক্ষুধাই মিটিয়ে গেল বাংলাদেশ। বাংলাদেশ দলে এখন ম্যাচ উইনারে ভরপুর। পাকিস্তান কাকে ছেড়ে কাকে নিয়ে ভাববে। নিজেদের নিয়েই তো, নিজেদের ভুলত্রুটিগুলো শুধরে নিতেই তো তাদের দিন যাচ্ছে। তবুও প্রথম দুই ওয়ানডেতে কাউকে নিয়ে বিশেষ ভাবনা না হলেও মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে বুধবার সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডেতে এসে অধিনায়ক আজহার আলীকে (১০১) নিয়ে ভাবতে হয়েছে। তবে যেই ২০৩ রানে সাকিব আউট করে দিলেন আজহারকে, সঙ্গে সঙ্গে আজহার-হারিসের ৯৮ রানের জুটি ভেঙ্গে গেল। পাকিস্তান ইনিংসে যেন ‘ডায়রিয়া’ও লেগে গেল। আর ৪৭ রানের মধ্যেই রুবেল, আরাফাত, মাশরাফির বোলিংয়ে খতম হয়ে গেল পাকিস্তানের ইনিংসও। যেই পাকিস্তানের ইনিংস শেষ হলো তখনই বোঝা হয়ে যায় বাংলাওয়াশ হচ্ছেই হচ্ছে। এখন শুধু অপেক্ষা। কত দ্রুত হয়। বাংলাদেশ যে আত্মবিশ্বাস নিয়ে খেলছে, তাতে ৮-১০ ওভার আগে খেলা শেষ হলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছুই থাকবে না। বাংলাদেশ ক্রিকেটাররা যে শুধু পাকিস্তানকেই নয়, বিশ্বদরবারেও নিজেদের মতো করে পৌঁছে দিচ্ছেন রবীন্দ্রনাথের সুর, ‘ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই, ছোটো এ তরী/আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।’ বাংলাদেশ দলকে বিশ্বদরবারে এখনও ‘ছোট্ট’ দল ধরা হলেও, এ দলে এখন পারফরমারে ভরে গেছে। যে ক্রিকেটারদের দিয়ে বিশ্ব দরবার শাসন করতে যে প্রস্তুত হচ্ছে, তাও বুঝিয়ে দিচ্ছে। তামিম ইকবাল ৬৪ রানে আউট হওয়ার পর সৌম্য সরকার ক্যারিয়ারের প্রথম শতক তুললেন। অপরাজিতও থাকলেন। তার সঙ্গে মাশরাফির ‘রান মেশিন’ মুশফিকও ৪৯ রান করে অপরাজিত থাকলেন। যখন সৌম্য বাউন্ডারি মেরে খেলা শেষ করলেন, মুশফিক-সৌম্য একে অপরের কোলে উঠে যায় পারলে। এতটাই আনন্দ তাদের মধ্যে কাজ করেছে। সেই বিষয় তো হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে পাকিস্তান। এমনই ‘ধোলাই’ করেছে দলটিকে টানা তিন ম্যাচেই হারিয়ে দিয়ে প্রথমবারের মতো সিরিজের ব্যবধান ৩-০ দাঁড়িয়ে গেছে। কী কঠিন পরিস্থিতিতেই না পড়েছে পাকিস্তান। একে তো বাংলাদেশ দলের কাছে হেরে চলেছে। আবার সাবেক ক্রিকেটারদের সমালোচনা তো চলছেই। তারা যেন এখন বলতে চাইছেন, ‘মনেরে আজ কহ য়ে/ ভাল মন্দ যাহাই আসুক/ সত্যেরে লও সহজে।’ আর ১৬ কোটি প্রাণতো শুধু ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ ধ্বনিতেই অজ্ঞান হচ্ছে। এমন আনন্দ কী আর কোনদিন মিলেছে? নিউজিল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, জিম্বাবুইয়ে, কেনিয়া, আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ডসহ এর আগে নয়বার প্রতিপক্ষকে হোয়াইটওয়াশ করার আনন্দ মিলেছে। কিন্তু পাকিস্তানকে বাংলাওয়াশ করার যে আনন্দ, তার ধারেকাছেও কী কোন আনন্দ আসতে পেরেছে? তাই তো আজ মধুসূদন দত্তের সুরই পুরো জাতির কণ্ঠে, ‘বহু দেশ দেখিয়াছি, বহু নদ-নলে, কিন্তু এ ¯েœহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে?’ ক্রিকেট বিশ্বের সব দলের বিপক্ষেই বাংলাদেশের সিরিজ খেলা হয়েছে। প্রতিটি দেশে গিয়েই সিরিজ খেলা হয়েছে। এর মধ্যে জেতাও হয়েছে অনেক। কিন্তু তৃষ্ণা বোধহয় এবারই মিটল। পাকিস্তানকে বাংলাওয়াশ করে পুরো তৃষ্ণা মেটালেন মাশরাফিরা। দেশবাসীকেও তৃষ্ণা দিলেন। স্কোর ॥ বাংলাদেশ-পাকিস্তান তৃতীয় ওয়ানডে-মিরপুর পাকিস্তান ইনিংস ২৫০/১০; ৪৯ ওভার (আজহার ১০১, হারিফ ৫২, সামি ৪৫; সাকিব ২/৩৪, আরাফাত ২/৪৩, রুবেল ২/৪৩, মাশরাফি ২/৪৪)। বাংলাদেশ ইনিংস ২৫১/২; ৩৯.৩ ওভার (সৌম্য ১২৭*, তামিম ৬৪, মুশফিক ৪৯*; জুনায়েদ ২/৬৭)। ফল ॥ বাংলাদেশ ৮ উইকেটে জয়ী। ম্যাচসেরা ॥ সৌম্য সরকার (বাংলাদেশ)। সিরিজ সেরা ॥ তামিম ইকবাল (বাংলাদেশ)।
×