ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে উঠেছে বাংলাদেশ;###;রানা প্লাজা ট্রাজেডির পর দু’বছরে মাত্র ২% কারখানায় ত্রুটি পাওয়া গেছে, যা আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য

গার্মেন্ট শিল্পে গৃহীত পদক্ষেপে এখন ক্রেতাগোষ্ঠী সন্তুষ্ট

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ২১ এপ্রিল ২০১৫

গার্মেন্ট শিল্পে গৃহীত পদক্ষেপে এখন ক্রেতাগোষ্ঠী সন্তুষ্ট

এম শাহজাহান ॥ গার্মেন্টস শিল্পে নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরির লক্ষ্যমাত্রা পূরণে এগিয়েছে বাংলাদেশ। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার দুই বছরে মারাত্মক ত্রুটি পাওয়া গেছে শতকরা ২ ভাগ গার্মেন্টস কারখানায়। আর শুধু বিভিন্ন ত্রুটিজনিত কারণে মাত্র ১৯টি কারখানা বন্ধ করা হয়েছে। গার্মেন্টস সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যে কোন শিল্পের ২ শতাংশ কারখানায় ত্রুটি থাকা আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য। এই বাস্তবতায় দেশের গার্মেন্টস শিল্পে নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরির সক্ষমতায় বেশ অগ্রগতি হয়েছে বলে মনে করছেন তাঁরা। শুধু তাই নয়, পোশাকের আন্তর্জাতিক ক্রেতাজোট এ্যাকোর্ড এবং এ্যালায়েন্সও বাংলাদেশের অগ্রগতিতে সন্তোষ প্রকাশ করেছে। তবে পোশাক খাতে নিরাপদ কর্মপরিবেশ শতভাগ নিশ্চিত করতে আরও মনিটরিং প্রয়োজন বলেও বলে মনে করা হচ্ছে। এদিকে, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরি ইস্যুতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে বাংলাদেশ। ক্রেতা দেশগুলো বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার হুমকি দেয়। বড় বড় ক্রেতাদের কার্যাদেশ হাতছাড়া হয়ে পড়ে। পোশাক খাতের নিরাপত্তার মান নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার পর ২ হাজার ৫০০ কারখানা পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত নেয় ইউরোপীয় ইউনিয়নের ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের জোট এ্যাকর্ড অন ফায়ার এ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশ এবং উত্তর আমেরিকার ক্রেতা জোট এ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশী ওয়ার্কার সেফটি। এই দুই জোটের পক্ষে কারখানা ভবনের কাঠামো, অগ্নি ও বৈদ্যুতিক নিরাপত্তার মান যাচাইয়ে কোন ত্রুটি পেলেই পর্যালোচনা কমিটির মাধ্যমে কারখানা বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ওই অবস্থায় এ্যাকর্ড এ্যালায়েন্সের পরিদর্শনে ঢাকা এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলের ১৯টি কারখানা বন্ধ করে দেয়া হয়। বন্ধ হওয়া এসব কারখানাগুলোর মধ্যে রয়েছে- জিনস কেয়ার, প্যাট্রিয়ট গার্মেন্টস, সফটেক্স কটন, ফেম নিটওয়্যার, ডায়মন্ড সোয়েটার, ফোর উইং, টিউনিক ফ্যাশন, চেরি, জয়া ফ্যাশন, ফ্লোরেন্স, আলটিমেট, যমুনা নিউ ফ্যাশন প্রভৃতি। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর দেশের গার্মেন্টস খাত সত্যিকার অর্থেই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিল। বিশেষ করে নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরি এবং শ্রমমান উন্নয়নে ক্রেতাজোট চাপ দিয়ে আসছিল। এ কারণে গত দুই বছরে এ শিল্পে নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরিতে সরকার ও মালিকপক্ষ যৌথভাবে কাজ করেছে। তিনি বলেন, মালিক, শ্রমিক এবং সংশ্লিষ্ট সকলের আন্তরিকতা ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের কারণে গত এক বছরে পোশাক কারখানায় কোন বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেনি। কারখানাগুলোতে কর্মবান্ধব পরিবেশ বিরাজ করছে। তিনি বলেন, শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো হয়েছে, শ্রম আইন সংশোধন করা হয়েছে, নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। অগ্নিকা- প্রতিরোধে ফায়ার সেফটি ডোর আমদানি শুল্কমুক্ত করা হয়েছে। রানাপ্লাজা দুর্ঘটনার পর তৈরি পোশাক শিল্প জন্য গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপে তাই ক্রেতাগোষ্ঠী সন্তোষ্ট। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত ১ হাজার ৫০০ কারখানা পরিদর্শন করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৯টি কারখানায় বিভিন্ন ধরনের ত্রুটি পাওয়া গেছে, সেগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ওই হিসেবে ত্রুটিপূর্ণ কারখানার পরিমাণ শতকরা ২ ভাগের কম। আন্তর্জাতিকভাবে এ সংখ্যা শতকরা ২ ভাগ পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য বা স্বাভাবিক। ত্রুটি সংশোধনের জন্য বন্ধ হওয়া কারখানার শ্রমিকদের তিন মাসের বেতন কারখানার মালিক এবং ক্রেতাগোষ্ঠী যৌথভাবে পরিশোধ করছে। এদিকে, বাংলাদেশে রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর তৈরি পোশাক শিল্প খাতের নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও শ্রম অধিকার নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে ২০১৩ সালের ৮ জুলাই জেনেভায় সাসটেইনেবিলিটি কমপ্যাক্ট গৃহীত হয়। সাসটেইনেবিলিটি কমপ্যাক্ট মোতাবেক শ্রম আইন সংশোধন, শ্রম পরিদর্শক নিয়োগ, ইপিজেড আইন সংশোধন, সাধারণের প্রবেশযোগ্য ডাটাবেইজ স্থাপন, রফতানিমুখী গার্মেন্টস কারখানা যাচাই-বাচাই, ২৩৬টি ট্রেড ইউনিয়নকে রেজিস্ট্রেশন প্রদান, ফায়ার সেফটি ডোর ও শিল্প কারখানা নির্মাণের সামগ্রী আমদানির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রদান করা হয়েছে। একই সঙ্গে নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরিতে পোশাকের মূল্য বৃদ্ধির দাবি করা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে পোশাকের ক্রেতাদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, এ শিল্প খাত উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া বাংলাদেশ এ্যাকশন প্লান বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তবে বাস্তবায়নের এই অগ্রগতি ধরে রাখতে হলে পোশাকের মূল্য বৃদ্ধি আগে প্রয়োজন। আর পোশাক শিল্পে নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরিতে এ পর্যন্ত সরকারের নেয়া পদক্ষেপ ও তা বাস্তবায়নের অগ্রগতিতে সন্তোষ প্রকাশ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। শ্রম অধিকার বাস্তবায়নে শ্রম আইন সংশোধন, ইপিজেড আইন সংশোধন, ট্রেড ইউনিয়নের রেজিস্ট্রেশন প্রদান ও ফায়ার সেফটি নিশ্চিত কল্পে যন্ত্রপাতি আমদানি শুল্কমুক্ত করায় আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থাও (আইএলও) বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করেছে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলছে, পোশাক শিল্পে বাংলাদেশের অর্জন ভাল তবে আরও অগ্রগতি প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া বাংলাদেশ এ্যাকশন প্লানের ১৬ শর্ত পূরণ করা হয়েছে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশ জিএসপি ফিরে পাওয়ার অধিকার রাখে বলে মনে করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ সহসভাপতি (অর্থ) রিয়াজ বিন মাহমুদ সুমন জনকণ্ঠকে বলেন, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর গত দুই বছরে দেশের গার্মেন্টস শিল্পে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরিতে উদ্যোক্তারা বেশি নজর দিচ্ছে। এখন মাত্র ২ শতাংশ কারখানায় ত্রুটি আছে যা আন্তর্জাতিকভাবে মেনে নেয়ার নিয়ম রয়েছে। তিনি বলেন, দেশে এখন গ্রিন গার্মেন্টস গড়ে উঠছে। শুধু তাই নয়, নিরাপদ কর্মপরিবশে তৈরির অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ করছেন উদ্যোক্তারা। তাই আগামীতে দেশের এ শিল্পে শতভাগ নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরি হবে। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার মতো আর যাতে কোন ট্র্যাজেডি না হয় সে লক্ষ্যে বিজিএমইএ থেকে প্রতিনিয়ত মনিটরিং করা হচ্ছে। এছাড়া সরকারী বিভিন্ন সংস্থাও এখন নিয়মিত তদারিক করছে। তিনি বলেন, নিরাপদ কর্মপরিবেশ ইস্যুতে শেয়ারড বিল্ডিংয়ে (একই ভবনকে কারখানাসহ অন্য কাজে ব্যবহার) রফতানি আদেশ দিচ্ছে না বিদেশী ব্র্যান্ডগুলো। সাব-কন্ট্রাক্টও অনেক ক্ষেত্রে বন্ধ। এ কারণে কাজের অভাবে অনেক কারখানা ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। চলতি বছর শেষে দেশের সব গার্মেন্টস কারখানায় নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরি হবে।
×