ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এবার আকাশ রাজত্বের অংশীদার হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৫:১৬, ২১ এপ্রিল ২০১৫

এবার আকাশ রাজত্বের অংশীদার হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ

ফিরোজ মান্না ॥ বাংলাদেশ আকাশ রাজত্বের অংশীদার হচ্ছে ২০১৭ সালের জুন মাসে। তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এই রাজত্বে জায়গা করে নেবে দেশ। এত দিন উন্নত দেশগুলোর স্যাটেলাইট বাণিজ্যের কাছে উন্নয়নশীল দেশগুলো পিছিয়ে ছিল। বাংলাদেশও পিছিয়ে পড়া দেশগুলোর একটি। স্যাটেলাইট নামক হাজার দৃষ্টির এক যন্ত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে দেশে দেশের আকাশসীমায়। এ যন্ত্রটির মালিক এখনও বাংলাদেশ হতে পারেনি। তবে বর্তমান সরকার এ যন্ত্রটির মালিক হওয়ার জন্য সব প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করেছে। নামও ঠিক করা হয়েছেÑ ‘বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট’। দেশের নিজস্ব স্যাটেলাইট মহাকাশে ঘুরে বেড়াবে ৪০ ধরনের সেবা নিয়ে। এ সেবার মাধ্যমে দেশ হবে উন্নত। টেলিযোগাযোগ, ব্রডকাস্টিংসহ যোগাযোগ সংক্রান্ত সমস্ত দ্বার উন্মোচিত হবে বাংলাদেশের জন্য। এত দিন স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের বিষয়টি ছিল স্বপ্ন। এখন এটি বাস্তবের আলোতে অবস্থান করছে, স্বপ্নপূরণের একেবারেই দ্বারপ্রান্তে। এ বছরই স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মূল দরপত্র আহ্বান করা হবে। বিটিআরসি সূত্র জানিয়েছে, স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণে সরকার এক হাজার ৩১৫ কোটি টাকা ব্যয় করবে। বাকি টাকা দেবে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান। আকাশে নিজস্ব স্যাটেলাইট স্থাপন হলে বছরে দেশের প্রায় এক শ’ ২০ কোটি মার্কিন ডলার সাশ্রয় হবে। বর্তমানে টেলিযোগাযোগ, ব্রডকাস্টিংসহ নানা খাতে এই টাকা বিদেশী স্যাটেলাইটের ভাড়া দিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। নিজস্ব স্যাটেলাইট থাকলে এই টাকা সাশ্রয় হবে। উল্টো ফ্রিকুয়েন্সি ভাড়া দিয়ে প্রতিবছর দ্বিগুণেরও বেশি টাকা আয় হবে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ হবে ২০১৭ সালের জুনে। সম্প্রতি এ সংক্রান্ত একটি চুক্তি হয়েছে বিটিআরসি ও রাশিয়ার কোম্পানির ইন্টারস্পুটনিক ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অব স্পেস কমিউনিকেশনের মধ্যে। স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের জন্য অরবিটাল সøট (১১৯ দশমিক ১ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ) লিজ সংগ্রহ করেছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। এ অংশেই বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট স্থাপন করা হবে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের ৪০ ট্রান্সপন্ডার ক্যাপাসিটি থাকবে। এর মধ্যে ২০ ট্রান্সপন্ডার দেশের ব্যবহারের জন্যে রাখা হবে। বাকি ২০ ট্রান্সপন্ডার অন্য দেশের কাছে বিক্রি করা হবে। বিটিআরসির কমিশনার ও বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক এটিএম মনিরুল আলম ও ইন্টারস্পুটনিক ইন্টারন্যাশনালের মহাপরিচালক ভাদাম ই বেলোভ নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। দেশের এই নিজস্ব স্যাটেলাইটটি দুর্যোগপ্রবণ এই দেশে নিরবচ্ছিন্ন টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে ভূমিকা রাখবে। এ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ হলে বিদেশী স্যাটেলাইটের ভাড়া ছাড়াই প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনেক কম মূল্যে ব্রডকাস্টিং সেবা দেয়া সম্ভব হবে। এছাড়াও টেলিমেডিসিন, ই-লার্নিং, ই-গবেষণা, ভিডিও কনফারেন্স, প্রতিরক্ষা ও দুর্যোগপূর্ণ অবস্থায় জরুরী যোগাযোগের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ২ হাজার ৯৬৭ কোটি টাকা। সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে যোগান দেয়া হবে ১ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। বাকি ১ হাজার ৬৫২ কোটি টাকা যে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান কাজ করবে, তারা সরবরাহ করবে। বিটিআরসি জানিয়েছে, অন্য একটি প্রকল্পের মাধ্যমে ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের প্রাথমিক নক্সা তৈরি করা হয়েছে। ২০১৭ সালের জুনে দেশের নিজস্ব স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের টার্গেট ধরা হলেও আরও আগেই (মার্চ মাসেই বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট) উৎক্ষেপণের সম্ভাবনা রয়েছে। এ জন্য ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ’ শীর্ষক প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ২ হাজার ৯৬৭ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। ২০১৪ সালের জুলাই থেকে ২০১৭ সালের জুন মাসের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন সময় ধরা হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট স্থাপনে আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশনস ইউনিয়নের (আইটিইউ) নীতিমালা মেনেই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এদিকে ঢাকা বিভাগের গাজীপুর জেলার জয়দেবপুর এবং রাঙ্গামাটির বেতবুনিয়ায় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের জন্য দুটি গ্রাউন্ড স্টেশন স্থাপনের জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ জন্য আরও একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণে পরামর্শক সেবা গ্রহণের জন্য একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটটির প্রাথমিক ডিজাইন, সম্ভাব্য ব্যয়, বাজার সমীক্ষা, গ্রাহক সংখ্যা, কাঠামো তৈরি, স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের প্রশিক্ষণ, গ্রাউন্ড স্টেশন ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি বিষয়ে সহায়তা দিচ্ছে। সূত্রমতে, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট স্থাপন হলে দেশের স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল, ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান, ভি-স্যাট ও বেতারসহ ৪০ ধরনের সেবা পাওয়া যাবে। নিজস্ব স্যাটেলাইট থাকলেও ব্রডকাস্টিং থেকে শুরু করে টেলিযোগাযোগের সব সেক্টর উন্মুক্ত হয়ে যাবে। বিদেশী স্যাটেলাইটের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে না। অন্যদিকে স্যাটেলাইটের অব্যবহৃত তরঙ্গ ভাড়া দিয়ে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব হবে। বিটিআরসির ২০০৮ সালে নিজস্ব স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের জন্য আইটিইউর কাছে ইলেক্ট্রনিক ফাইলিং দাখিলসহ প্রাথমিক কার্যক্রম শেষ করে। এরপর নিজস্ব স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের জন্য বিটিআরসি স্যাটেলাইটের বিভিন্ন দিক নিয়ে অনেক আলোচনা করে সর্বশেষ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে। জানা গেছে, মহাকাশের বিভিন্ন রেখায় স্থাপন করা ৬৯ দেশের শতাধিক স্যাটেলাইট যোগাযোগ ও সম্প্রচার এবং গোয়েন্দাগিরির কাজ করে যাচ্ছে। নিজেদের স্যাটেলাইট না থাকায় বাংলাদেশের ওপর বিদেশী পাঁচটি স্যাটেলাইট ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিশ্বের ৪৫ দেশের মহাকাশে নিজস্ব স্পেস রয়েছে। তাদের আকাশে অন্য কোন দেশের স্যাটেলাইট নেই। ৫০ দেশ অন্য দেশের সহযোগিতায় স্যাটেলাইট স্থাপন করেছে। ১১ দেশের নিজস্ব ব্যয়ে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করেছে। এ সব দেশের শতাধিক স্যাটেলাইট বিষুবরেখা, মেরু বিন্দু বা ক্রান্তীয় অঞ্চল অথবা বিভিন্ন কৌণিক পথে পরিভ্রমণ করছে। যোগাযোগ মাধ্যমের স্যাটেলাইটগুলো সাধারণত বিষুবরেখার ওপর স্থাপন করা হয়। কক্ষ পথের এই স্থানে স্যাটেলাইট স্থাপন করলে পরিচালন ব্যয় অনেক কম। তাই উন্নত দেশগুলো এই কক্ষে একটার পর একটা যোগাযোগ স্যাটেলাইট পাঠিয়েছে।
×