ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর

কিউবা ও যুক্তরাষ্ট্র ॥ সম্পর্কের নবদিগন্ত

প্রকাশিত: ০৪:২৩, ২১ এপ্রিল ২০১৫

কিউবা ও যুক্তরাষ্ট্র ॥ সম্পর্কের নবদিগন্ত

১৯৬০-এর দশকের প্রথম দিকে আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং তরুণ ছাত্রছাত্রীদের দেখা এক নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি তখন হঠাৎ একদিন খবরের কাগজে দেখলাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিউবা আক্রমণ করেছে। দিনটা ছিল ১৭ এপ্রিল ১৯৬১ আর তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন মুক্ত পৃথিবীর তরুণ স্বপ্নের প্রতীক জনএফ কেনেডি আর কিউবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখনকার পশ্চিম গোলার্ধের সমাজতন্ত্রের প্রধান প্রবক্তা ফিদেল ক্যাস্ট্রো। ১৯৫৯ সালে কমিউনিস্ট ক্যাস্ট্রো, দক্ষিণপন্থী সামরিক শাসক বাতিস্তাকে হটিয়ে কিউবায় ক্ষমতা দখল করেছিলেন। কিউবার বরাহোপসাগর বা বে অব পিগসের তটে এই আক্রমণ পরিচালিত করেছিল তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা বা সিআইএ এবং এতে অংশগ্রহণ করেছিলেন কমিউনিস্ট কিউবা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয়প্রাপ্ত কিউবান আমেরিকানরা। কেনেডির বেশ আগে প্রেসিডেন্ট আইসেনহাওয়ারের সময় থেকে এসব কিউবান আমেরিকানদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছিল সিআইএ। হার্ভার্ড শিক্ষিত গণতান্ত্রিক মানসের অধিকারী কেনেডি নগ্নভাবে প্রতিবেশী দেশ আক্রমণে সম্ভবত পরিপূর্ণ সাড়া দিতে পারেননি। সেজন্য আক্রমণের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে তিনি আক্রমণকারী কিউবান আমেরিকান অভিযাত্রীদিগকে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীর সমর্থন দিতে রাজি হননি। ফলত ২০ এপ্রিলের শেষ দিকে ফিদেল ক্যাস্ট্রোর নেতৃত্বাধীন কিউবান সেনাদল আক্রমণকারীদের পর্যুদস্ত করে হটিয়ে দিতে সমর্থ হন। এই বিফল আক্রমণের পুরো দায়িত্ব কেনেডি ২১ এপ্রিল স্বীকার করে কিউবার অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়ে আগের মতো মার্কিন নজরদারি অব্যাহত রাখেন। অনেক আগ থেকে, স্পেনীয় আমেরিকান যুদ্ধের পর হতে কিউবার গুয়ানতানামো উপসাগরের যুক্তরাষ্ট্রের দখল করা দক্ষিণ কোণায় যুক্তরাষ্ট্র নৌঘাঁটি পরিচালনা করে আসছিল। ফলত এই সময়ে কিউবার ওপর আগ থেকে আরোপিত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ক্রমান্বয়ে আরও বিস্তৃত ও দৃঢ়তর করা হয়। কিউবার প্রায় রফতানিই যুক্তরাষ্ট্রে যেত বলে এই নিষেধাজ্ঞা কিউবার ব্যাপক অর্থনৈতিক মন্দার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বাতিস্তাকে হটিয়ে ফিদেল ক্যাস্ট্রো কর্তৃক সরকার দখল করার পর কমিউনিস্ট দর্শন অনুযায়ী ক্রমান্বয়ে কিউবার ভূমি ও শিল্প মালিকানা ক্ষেত্রে লোকায়ত্ত পরিবর্তন আনা এবং যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ও কোম্পানিসমূহের মালিকানাস্থিত প্রতিষ্ঠানসমূহ জাতীয়কৃত করা হয়। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ক্রমান্বয়ে কিউবা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানীয় এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে কিউবায় আমদানীয় সকল পণ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, যুক্তরাষ্ট্রস্থিত সকল ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানকে কিউবার সঙ্গে বাণিজ্যিক লেনদেন ও সেখানে বিনিয়োগকরণ থেকে বিরত রাখে এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে কিউবায় ভ্রমণ বন্ধ করে দেয়। এই সব নিষেধাজ্ঞা আরোপণের ফলে কিউবা তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাবাধীন একটি রাষ্ট্রে পরিণত হয়। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবাকে যুক্তরাষ্ট্রের তথাকথিত আক্রমণ থেকে প্রতিরক্ষণ দেয়ার লক্ষ্যে ’৬০-এর দশকের প্রথম ভাগে সেখানে দূরপাল্লার মিসাইল সন্নিবেশিত করে। কেনেডির নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র এ সম্পর্কে সজাগ হয়ে কিউবার প্রতিকূলে নৌ-অবরোধ আরোপ করে কিউবা থেকে এই সব মিসাইলের অপসারণ দাবি করে। গোপন আলোচনার ভিত্তিতে তুরস্কে সোভিয়েত ইউনিয়নকে লক্ষ্য করে যেসব মার্কিন মিসাইল আগে থেকে সন্নিবেশিত করা ছিল তা যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক প্রত্যাহার করার শর্তে সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবা থেকে এসব মিসাইল সরিয়ে নিয়ে যায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পরও কিউবার প্রতিকূলে যুক্তরাষ্ট্রের এই নীতির কোন পরিবর্তন ঘটেনি। ১৯৯২ সালে যুক্তরাষ্ট্র ‘কিউবা গণতান্ত্রিক আইন’ ও ১৯৯৬ সালে ‘হেল্পস বাটন আইন’ অনুযায়ী সুস্পষ্ট বিধান দেয় যে যতদিন ফিদেল ও রাউল ক্যাস্ট্রোকে (ফিদেলের ছোট ভাই) বাদ দিয়ে কিউবায় গণতান্ত্রিক সরকার ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত না হবে ততদিন পর্যন্ত কিউবার প্রতিকূলে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক আরোপিত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা বলবত থাকবে। এই নিষেধাজ্ঞার আওতার বাইরে সময়ান্তরে মানবিক কারণে যুক্তরাষ্ট্র কিউবায় কতিপয় কৃষিজাত পণ্যাদি ও ওষুধ পত্রাদি যুক্তরাষ্ট্র থেকে রফতানি হতে দেয়। এসব ব্যতিক্রম সত্ত্বেও কিউবান সরকারের হিসাব অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক আরোপিত বাণিজ্য ও বিনিয়োগ নিষেধাজ্ঞার ফলে কিউবার ১.১২৬ ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষতি সাধিত হয়। ১৯৮২ সালে যুক্তরাষ্ট্র কিউবাকে জঙ্গীপোষক রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে। এই সময়ে কিউবার প্রধানমন্ত্রী ফিদেল ক্যাস্ট্রো মধ্য আমেরিকায় কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ করেন বলে বিদিত হয়। যুক্তরাষ্ট্র ও কিউবার মধ্যকার এই বৈরিতার বিপরীতে ১৯৯১ সালে কিউবা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত নিষেধাজ্ঞার নিন্দা করে প্রস্তাব উত্থাপিত ও অনুমোদন করাতে সমর্থ হয়। ২০১৩ সাল পর্যন্ত ২২ বছর ধরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ এই নিন্দা সূচক প্রস্তাব প্রতিবছর গ্রহণ করে এসেছে। ২০১৩ সালে একমাত্র ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া অন্য ১৮৬টি রাষ্ট্র এই নিন্দা সূচক প্রস্তাব সমর্থন করে সাধারণ পরিষদে কিউবার অনুকূলে ভোট দেয়। ১৯৯২ সালে ফিদেল ক্যাস্ট্রো ঘোষণা করেন যে তখন থেকে তার দেশ বিদেশে সশস্ত্র বিপ্লব সমর্থ করবে না। ২০০০ সালে জাতিসংঘের সহস্রাব্দ শীর্ষ সম্মেলনে ক্যাস্ট্রো ও ক্লিনটন আনুষ্ঠানিকভাবে করমর্দন করেন। ২০০৮ সালে ফিদেল ক্যাস্ট্রোর অবসর গ্রহণ করার পর তার ভাই রাউল ক্যাস্ট্রো কিউবার প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা করে যে তখন থেকে কিউবা কর্তৃক অন্যান্য দেশে তথাকথিত বিপ্লবীদের সমর্থন দেয়া বন্ধ করেছে। ২০১৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় নেলসন ম্যান্ডেলার শেষকৃত্যে ওবামা ও রাউল পরিচিত হন এবং করমর্দন করেন। ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র বিদিত করে যে কিউবাতে তখনও মানব অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। এই বছরেই কানাডা এবং ভাটিকান সিটিতে পারস্পরিক বৈরিতা দূরীকরণের লক্ষ্যে কিউবার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের গোপনে আলোচনা অনুষ্ঠিত হতে থাকে। এ আলোচনাক্রমে কিউবার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য পোপ ফ্রান্সিস সহায়তা করেন। ফলে ২০১৪-এর ১৭ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এবং কিউবার প্রেসিডেন্ট রাউল ক্যাস্ট্রো দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়ন করা হবে বলে ঘোষণা করেন। ঘোষণায় বলা হয় যে, যুক্তরাষ্ট্র ক্রমান্বয়ে কিউবার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞাদি প্রত্যাহার করবে এবং হাভানা ও ওয়াশিংটনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হবে। ২০১৫-এর জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের কূটনৈতিকরা হাভানাতে কিউবার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্যে আলোচনায় বসেন। জানুয়ারির ১৫ তারিখে যুক্তরাষ্ট্র কিউবা থেকে সিগার ও রাম সীমিত পরিমাণ আমদানি এবং কম্পিউটার ও টেলিযোগাযোগভিত্তিক প্রযুক্তি যুক্তরাষ্ট্র থেকে কিউবায় রফতানিকরণ অনুমোদন করে। ২০১৫-এর ১৪ এপ্রিল পানামা সিটিতে আমেরিকান রাষ্ট্র সংস্থার বৈঠকে ওবামা ও রাউল প্রকাশ্যে আবারও করমর্দন করে এই দুই দেশের সম্পর্কের নবদিগন্তের উন্মোচন করেন। এর পরই যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসীদের মদদদাতা রাষ্ট্রের তালিকা থেকে কিউবার নাম প্রত্যাহার করে নেয়। কিউবাকে এই তালিকা থেকে প্রত্যাহার করার পর যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক তৈরিকৃত সন্ত্রাসী রাষ্ট্রের তালিকায় মাত্র ৩টি রাষ্ট্র যথা ইরান, সুদান ও সিরিয়া থেকে যায়। এর আগে প্রেসিডেন্ট ওবামা এক খোলাখুলি বিবৃতিতে বলেছেন যে, ৫০ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক কিউবাকে অবরোধকরণের নীতি ফলদায়ক হয়নি এবং এখন থেকে যুক্তরাষ্ট্র ভিন্নতর রাষ্ট্রে কোন হস্তক্ষেপ করবে না। সমাজতান্ত্রিক নীতি অনুযায়ী কিউবা ফিদেল ক্যাস্ট্রোর শাসনামলের শুরু থেকে ব্যক্তিমালিকানা সীমিত, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ প্রতিষ্ঠিত এবং কিউবায় ব্যবসা এবং উৎপাদনে রত যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানসমূহ জাতীয়কৃত করে। সমাজতন্ত্রের পথে কিউবার এসব কার্যক্রম দেশের সার্বিক উৎপাদন ইপ্সিত মাত্রায় বাড়াতে সক্ষম হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের আপেক্ষিকতায় কিউবায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্যবিষয়ক সুবিধা ও সেবাসমূহ ক্যাস্ট্রোর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বিস্তৃত হয়নি এবং অধিকাংশ নাগরিকের জীবন থেকে দারিদ্র্য দূর করা যায়নি। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাত্মক অবরোধ কিউবাকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সংবলিত রাষ্ট্রে উন্নীত করার জন্য কোন ইতিবাচকতা সৃষ্টি করেনি। কিউবার স্বৈরতান্ত্রিকতা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে আশ্রয় নেয়া কিউবানদের সংখ্যা কমেনি। এসব তথ্য পর্যালোচনা করলে দুটি কর্মান্তিক ফলশ্রুতি দৃষ্টিতে আসে। এক, বাণিজ্যিক ও আর্থিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র কিউবাতে গণতন্ত্রের প্রবর্তন ও মানবাধিকারের সম্প্রসারণ ইপ্সিত মাত্রা ও গতিতে করতে সমর্থ হয়নি। বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অবরোধ বা অসহযোগিতা আরোপ করে এক দেশ হতে আরেক দেশে গণতন্ত্র বা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিতকরণ কোন সময়েই কোন দেশের জন্য ইতিবাচক হয়নি। দুই, অন্যদিকে এ তথ্যও সুস্পষ্ট হয়ে স্বীকৃত হয় যে, কিউবার সমাজতান্ত্রিক সরকার দেশের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে এবং দারিদ্র্যবিমোচন করতে পূর্ণাঙ্গভাবে ব্যর্থ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কিউবার বৈরী রাজনৈতিক নীতি যুক্তরাষ্ট্রে কোন প্রভাব সৃষ্টি করতে পারেনি। এই প্রেক্ষিতে তাই বলা চলে যে প্রায় ৫০ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও কিউবা কর্তৃক অনুসৃত পারস্পরিক ক্ষেত্রে বৈরিতার ভিত্তিতে প্রযোজ্য নীতি সফল হয়নি। এই প্রেক্ষিতে ২০১৪-এর ১৭ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এবং কিউবার প্রেসিডেন্ট রাউল ক্যাস্ট্রোর যুগপৎ ঘোষণা যে যুক্তরাষ্ট্র ও কিউবা পারস্পরিক পূর্ণাঙ্গ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করবে পৃথিবীর সকল রাষ্ট্র স্বাগত করেছে। এই ঘোষণার পর এই দুই রাষ্ট্র তাদের দু’দেশে অন্তরীণাধীন আমেরিকান এবং কিউবান বন্দীদের বিনিময় করেছে; দুই দেশের মধ্যে যাতায়াত ও আর্থিক লেনদেন সহজতর ও বিস্তৃত হয়েছে; কিউবা ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নিয়মিত বেসামরিক বিমান চালনার অনুমতি দেয়া হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রস্থ বীমা কোম্পানিদিগকে কিউবায় তাদের বীমা ব্যবস্থাপনার আবরণ বিস্তৃত করণের সুযোগ অবারিত করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্র সেদেশের বেসরকারী কোম্পানিদিগকে কিউবার কতিপয় ছোটখাটো ব্যবসা বাণিজ্যে বিনিয়োগ করার সুযোগ দিয়েছে। এই সময়ে দৈবচয়নের ভিত্তিতে সমাপ্ত জরিপে দেখা গেছে যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ আমেরিকানরা যুক্তরাষ্ট্র ও কিউবার সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের অনুকূলে মত পোষণ করেন। তেমনি কিউবার সাধারণ মানুষ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কিউবার সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ায় উল্লসিত হয়েছে বলে বিদিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও কিউবার মধ্যে বৈরিতার বদলে বন্ধুত্ব এখন সময়ের ব্যাপার বলে প্রতিভাত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও কিউবার মধ্যে সাম্প্রতিক সম্পর্ক উন্নয়নকরণে যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত এবং পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দুটি নতুন অনুসরণীয় সূত্র স্পষ্টতর করেছে। এক, সমাজতন্ত্রের মোড়কে কোন দেশকে বিশেষত পশ্চিম গোলার্ধের কোন দেশকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার থেকে দূরে সরিয়ে দেয়া যাবে না। লাতিন আমেরিকার সাম্প্রতিক বিবর্তন কিউবা থেকে সেখানে সমাজতন্ত্র রফতানির নিস্ফলতা প্রমাণ করেছে। গণতন্ত্রকে ভিত্তি করে সম্পদ উৎপাদনের ক্ষেত্রে ব্যক্তি-উদ্যোগের সন্দীপন যে সময়ের ব্যাপ্ত পরিসরে উৎপাদন বাড়ায় তা প্রথাগত সমাজতন্ত্রী দেশও স্বীকার করে তাদের অর্থনীতিতে যথাযথ সংশোধনী এনেছে বা আনছে। গণচীন ও ভিয়েতনামের সাম্প্রতিক পরিবর্তন এরই সাক্ষ্য বহন করছে। দুই, কোন দেশকে অবরোধ করে বা বিছিন্ন রেখে তাকে গণতন্ত্রের দিকে টেনে আনা যায় না। গণতন্ত্র ও মানবিক অধিকার অর্জনের সংগ্রাম মূলত সংশ্লিষ্ট দেশের অভ্যন্তর থেকে উঠে আসে। এই প্রক্রিয়ায় অবরোধের বিপরীতে অধিকতর যোগাযোগ ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা সমাজতন্ত্রে আবদ্ধ দেশসমূহকে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের পথে টেনে নিয়ে আসে। এই প্রেক্ষিতে মুক্ত বাণিজ্যের প্রসার ও আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের অবাধ লেনদেন এবং প্রযুক্তির অবাধ বিচ্ছুরণ অনুসরণীয় লক্ষ্য অর্জনকে সহজতর করে। তিন, আগ্রাসী বা সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব নিয়ে আজকের পৃথিবীর আপেক্ষিকভাবে কোন শক্তিশালী রাষ্ট্র দুর্বলতর কোন রাষ্ট্রকে গ্রাস করে আন্তর্জাতিক সমর্থন পায় না কিংবা লাভবান হয় না। পারস্পরিক আলোচনা, শ্রদ্ধাবোধ ও সম্মতির ভিত্তিতে গোলকায়িত পৃথিবীতে সকল রাষ্ট্রকে কাজ করতে হয়। প্রতিরক্ষণের মোড়কে ভিন্নতর রাষ্ট্রকে গ্রাস বা পর্যুদস্ত করা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গ্রহণীয় ও অনুসরণীয় সুস্থ কূটনীতির পরিচায়ক হতে পারে না। গত তিন দশকে এ প্রমাণিত হয়েছে ইরানে, ইরাকে, আফগানিস্তানে, পূর্ব ইউরোপ এবং সর্বশেষে কিউবায়। এই উপরোক্ত তিন প্রেক্ষিতে পৃথিবীব্যাপী সাধারণ মানুষ যুক্তরাষ্ট্র ও কিউবার সম্পর্কের উন্নয়নকে এবং ৫০ বছরের অবরোধকে ভেঙ্গে দেয়ার ঘোষণাকে স্বাগত জানাচ্ছে।
×