ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

মিরপুরে আবার তামিম ঝড়

প্রকাশিত: ০৬:১০, ২০ এপ্রিল ২০১৫

মিরপুরে আবার  তামিম  ঝড়

মোঃ মামুন রশীদ ॥ ধারাবাহিকতা কাকে বলে সেটা প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে দেখিয়েছিলেন তিনিই। অনেক জল্পনা-কল্পনা আর বিতর্ক পেছনে ফেলে দলে জায়গা করে নিয়ে ২০১২ এশিয়া কাপে টানা চারটি হাফ সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন, যা এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের কোন ব্যাটসম্যান করে দেখাতে পারেননি। সারাবিশ্বই অবাক হয়ে দেখেছিল তামিম ইকবালকে। দুর্দান্ত কিছু ইনিংস আরও আগেই খেলে যেকোন প্রতিপক্ষের টার্গেটে পরিণত হয়েছিলেন। কিন্তু সেই তামিমের ব্যাটেই মাঝে অনেকটা সময় দেখা গেছে রানখরা। দেখা গেছে ধারাবাহিকতার অভাব। তাঁকে নিয়ে কম সমালোচনা হয়নি। সেই সব সমালোচনার জবাব এবার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রথম ওয়ানডেতে ১৩২ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলে ব্যাটেই দিয়েছিলেন। আর দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ব্যাট হাতে তা-ব চালাতে পারদর্শী তামিমকে আবার দেখল মিরপুর স্টেডিয়াম। মাত্র ৩১ বলে ক্যারিয়ারের ২৯তম ফিফটি করার পরও থামেননি। করেছেন টানা দ্বিতীয় সেঞ্চুরি। বাংলাদেশের পক্ষে ওয়ানডেতে টানা দুই শতক হাঁকানোর অনন্য রেকর্ড গত বিশ্বকাপেই করেছিলেন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। এবার সেটা করলেন তামিমও। ১০৮ বলে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় শতক পূর্ণ করার পর অপরাজিত থেকেছেন ১১৬ বলে ১৭ চার ও ১ ছক্কায় ১১৬ রানে। এবার বিশ্বকাপে একদিনই পুরনো তামিমকে রুদ্রমূর্তিতে দেখা গিয়েছিল। স্কটল্যান্ডের বিরুদ্ধে ১০০ বলে ৯৫ রানের দুর্দান্ত একটি ইনিংস খেলে দলকে ওয়ানডে ইতিহাসে সর্বাধিক ৩১৮ রান তাড়া করে জেতার রেকর্ড স্থাপনে মূখ্য ভূমিকা রেখেছিলেন। এরপর আন্তর্জাতিক ছাড়াও আনঅফিসিয়াল অনেক ওয়ানডে খেলেছেন কিন্তু রানের ঘাটতি। সব মিলিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সিরিজ শুরুর আগে খেলা সর্বশেষ ৬টি ৫০ ওভারের ম্যাচে তামিমের রান ছিল ২, ১৩, ২৫, ১০, ৫ ও ৯। বিশ্বকাপে স্কটিশদের বিরুদ্ধে খেলা ম্যাচটি ছাড়া তেমন কিছুই করতে পারেননি। তাই তীব্র সমালোচনার মুখে এমনকি জাতির কাছে ক্ষমাও চেয়েছিলেন তামিম। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে রানের ক্ষুধাটা ছিলই। ক্রমাগত চেষ্টা করে গেছেন তিনি। বিশ্বকাপে খেলবেন এমন সম্ভাবনাও ক্ষীণ হয়ে পড়েছিল হাঁটুতে অস্ত্রোপচারের কারণে। ইনজুরি সেরে উঠেই বিশ্বকাপ মঞ্চে খেলতে নেমেছিলেন। কিন্তু দিনশেষে এসব কেউ মনে রাখে না, সবাই দেখে রান কত করল? তামিম অতীতে অনেক টর্নেডো ইনিংস খেলেছেন। জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে ১৩৮ বলে ১৫৪ রানের ইনিংসটা কি এত সহজেই ভোলা যায়? ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারতের বিরুদ্ধে অবিস্মরণীয় বিজয়ে দ্রুতগতির হাফসেঞ্চুরির কথা ভোলা যায়? কিন্তু অতীত কেউ মনে রাখে না। তাই বাজে সময়ে তামিমকে নিয়ে হয়েছে বিদ্রƒপ। এই তো কিছুদিন আগেইÑ সেই তামিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সিরিজের আগে বাংলাদেশ ক্রিকেট লীগের (বিসিএল)) ওয়ানডে টুর্নামেন্টেও রানখরায় ভুগলেন। পাকদের বিরুদ্ধে একমাত্র প্রস্তুতি ম্যাচে বিসিবি একাদশে তাঁকে রাখা হয়নি। কিন্তু রানে ফেরার তীব্র আকাক্সক্ষায় বিসিবির কাছে অনুরোধ করে খেললেন। এবারও ব্যর্থ। তাই বাতাসে গুঞ্জন-কানাঘুঁষা তামিম বাতিল হয়ে গেছেন। তিনি আর বাংলাদেশ দলে খেলার উপযুক্ত নয় কোনভাবেই। জবাবটা মোক্ষমভাবেই দিলেন। নিন্দুকদের মুখে বেমক্কা ঘুষি বসিয়ে দিলেন প্রথম ওয়ানডেতে দুর্দান্ত শতক হাঁকিয়ে। তখন আবার তামিম বন্দনায় মুখর হলো সবাই। বারবার ফিরে এলো একটি কথাইÑ ‘ফর্ম ইজ টেম্পোরারি, বাট ক্লাস ইজ পার্মানেন্ট’। তামিম কোনপর্যায়ের ক্রিকেটার সেটা অনেক আগেই প্রতিপক্ষরা জেনেছেন। তাঁর বিধ্বংসী একটা রূপ লুকিয়ে আছে; সে কারণেই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নামার আগে সবাই হিসেব করেন তামিমকে আলাদাভাবে। তৈরি করেন তাঁকে আটকানোর পরিকল্পনা; যতই তিনি ফর্মহীন থাকুন না কেন। যেমনটা ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিস গেইল, দক্ষিণ আফ্রিকার ডি ভিলিয়ার্স, অস্ট্রেলিয়ার ডেভিড ওয়ার্নার, শেন ওয়াটসন এবং নিউজিল্যান্ডের ব্রেন্ডন ম্যাককুলাম। এ ব্যাটসম্যানদের আতঙ্কে রাখার জন্য রানের মধ্যে নিয়মিত থাকতে হয় না। দ্বিতীয় ওয়ানডেতেও তাই একটা চ্যালেঞ্জ নিয়ে নেমেছিলেন তামিম। এতদিন নিন্দুকরা বলেছেন এক ম্যাচে দুর্দান্ত ফিফটি বা সেঞ্চুরির পর টানা কয়েকটা ম্যাচে নিষ্প্রভ থাকেন তামিম। ২০১২ এশিয়া কাপে সেটার জবাব দিয়েছিলেন। আবারও প্রমাণ দেয়ার চ্যালেঞ্জ। ভেতরে ক্ষুধা এবং আকাক্সক্ষা থাকা জরুরী সাফল্যের জন্য। সেই আকাক্সক্ষাটাই কাজ করল। শুরু থেকেই রবিবার মিরপুর শেরেবাংলায় উপস্থিত দর্শকরা বারবার করতালি দিয়ে গেলেন তামিমের ব্যাটিং ঝড় দেখে। হ্যাঁ, ফিরে এসেছেন পুরনো ব্যাটিং ঝড় নিয়ে তামিম। মাত্র ৩১ বলেই ৫০; যার মধ্যে ৪৮ রানই এলো বাউন্ডারিতে। এক ডজন চার। এরপরও থামেননি। সাবলীল ভঙ্গি নিয়ে পুরনো স্বভাবে ঝড় তুলে গেছেন ব্যাটে। তবে পরের দিকে কিছুটা দেখেশুনেই খেলেছেন তিনি। আরও ৭৭ বল লেগেছে শতক পেতে। শেষ পর্যন্ত সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে দলকে জিতিয়ে মাঠ ছেড়েছেন তামিম মাথা উঁচু করে সগর্বে। বিশ্বকাপে টানা দুই শতক হাঁকিয়েছিলেন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ, যা বাংলাদেশের ওয়ানডে ক্রিকেট ইতিহাসে ছিল প্রথম ঘটনা। এবার দ্বিতীয় ঘটনার জন্ম দিলেন তামিম। ক্যারিয়ারের ষষ্ঠ শতক হাঁকিয়ে এখন সাকিবের সঙ্গে যৌথভাবে তালিকায় বাংলাদেশের পক্ষে সর্বাধিক ওয়ানডে সেঞ্চুরির মালিকও হয়ে গেলেন তিনি।
×