ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ব্রিটিশ থেকে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাব বেশি

প্রকাশিত: ০৪:৫৬, ২০ এপ্রিল ২০১৫

ব্রিটিশ থেকে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাব বেশি

১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর শত হানাহানি, কাটাকাটি সত্ত্বেও, এ আশা ছিল যে, পরিবেশ স্থিতিশীল হলে, সংবিধান প্রণীত হবে এবং সংসদীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে। আইনের শাসন যাকে বলা হয়, তাও প্রচলিত হবে। ভারতবর্ষে জওহরলাল নেহেরু রাষ্ট্রভার গ্রহণ করেন, সংবিধান প্রণীত হয় এবং সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা চালু হয়। ভারতে যারা সরকার ও রাজনীতিতে ছিলেন তাদের ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন সংগ্রামের ঐতিহ্য ছিল। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ায় তারা এগিয়ে এসেছিলেন। পাকিস্তানে একই ধাঁচে শাসন চালু হলেও একটি পার্থক্য ছিল। পাকিস্তানের অর্থ তারা বুঝেছিল পশ্চিম পাকিস্তান আরও সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে পাঞ্জাবী আমলাদের শাসন। মুসলিম লীগের যারা ক্ষমতাবান ছিলেন তাদের অধিকাংশ ছিলেন বিত্তবান এবং সাধারণের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক ছিল না। কংগ্রেসীর মতো সেই অর্থে তাদের সংগ্রাম করতে হয়নি। আবুল কালাম আজাদ যে অর্থে সংগ্রামী ছিলেন সে অর্থে মহম্মদ আলী জিন্নাহ সংগ্রামী ছিলেন না। তিনি একদিনের জন্যও জেল খাটেননি। এমন কী লিয়াকত আলী খান। গোলাম মহম্মদ কেউ না। ভারত বাহ্যত ব্রিটিশ প্রভাব থেকে বেরুতে চেয়েছিল। অন্যদিকে, পাকিস্তানীরা গ্রহণ করেন ব্রিটিশদের আমলাতান্ত্রিক প্রভাব ও শাসন। বৃটেনের শাসনের ভিত্তি ছিল সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্র, তবে কর্তৃত্ব ছিল বেসামরিক আমলাতন্ত্রের। পাকিস্তান সেদিকেই এগুলো এবং ১৯৫৮ সালে সামরিক আমলাতন্ত্র ক্ষমতা দখল করল। উল্লেখ্য, এর আগে যারা ক্ষমতায় ছিলেন গোলাম মহাম্মদ বা ইসকান্দার মির্জা তারাও আমলা ছিলেন ব্রিটিশ আমলে। তবে, পাকিস্তানে কর্তৃত্ব ছিল সামরিক আমলাদের। মুক্তিযুদ্ধের অনেক লক্ষ্যের মধ্যে একটি লক্ষ্য ছিল, সামরিক কর্তৃত্ব ও আমলাতান্ত্রিক শাসনের বিনাশ। বঙ্গবন্ধুর আমলে নিরস্ত্র মানুষের কর্তৃত্ব বহাল হয়েছিল। সভ্যতার এটি একটি মাপকাঠি। কিন্তু পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাব আমলাতন্ত্রে খর্ব করা যায়নি। সিভিল কর্তৃত্ব সামরিক আমলাতন্ত্র মানতে রাজি হয়নি দেখেই বঙ্গবন্ধুকে খুন করা হয়। তারপর দীর্ঘদিন চলেছে এই শাসন। রাজনীতিবিদ যারা ক্ষমতায় এসেছেন তারা সামরিক আমলাতন্ত্রের নির্দেশেই চলেছেন, বেসামরিক আমলাতন্ত্রও। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত দীর্ঘ শাসনের একটি প্রভাব আমাদের রাজনীতিবিদ ও সাধারণ মানুষের মনে অভিঘাত সৃষ্টি করেছে। ১৯৯০ থেকে এক দশক রাজনীতিবিদরা শাসন করেছেন সামরিক আমলাতন্ত্রের ছত্রছায়ায়। তারপর কয়েক বছর সামরিক শাসন, যদিও এটিকে বলা হয় তত্ত্বাবধায়ক আমল। এমন সংসদীয় সরকার চলছে কিন্তু সামরিক আমলাতন্ত্রের প্রভাব বলয় বৃদ্ধি পেয়েছে। রাষ্ট্রে তারা যা দাবি করছে তাই পাচ্ছে। এবং সমান্তরাল একটি আলাদা সামরিক সমাজ তারা গড়ে তুলছে। এর পরিণতি এক সময় সংঘাতময় হবে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। আমার আলোচ্য বিষয় তা নয়। পাকিস্তান ঔপনিবেশিক আমলে সামরিক আমলাতন্ত্রের প্রভাব এখনও কতটা বিদ্যামান তা-ই আমি সংক্ষেপে দেখাবার চেষ্টা করব। আমরা যে এই প্রভাবে প্রভাবান্বিত সে কথা কখনও আমাদের মনে আসে না। সে কারণে, তাদের ভোকাবুলারি আমরা ব্যবহার করি রাজনীতিতে এবং মিডিয়ায় এবং তা আমাদের জীবনচর্যার অন্তর্গত হয়ে যায়। এ পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষমতায় না থেকেও জেনারেলরা কীভাবে ক্ষমতায় থেকে যান পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে সামনে রেখে তার কয়েকটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। ঔপনিবেশিকোত্তর ঔপনিবেশিক মন কীভাবে বিকশিত হয় এটি তারও উদাহরণ। ॥২॥ পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সাযুজ্যের একটি কারণ দু’টি দেশ ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত একই রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে ছিল এবং প্রায় ২৪ বছরের মধ্যে ১৫ বছরই ছিল প্রত্যক্ষ সামরিক শাসনের অধীনে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৪৩ বছরের মধ্যে প্রায় ২০ বছর ছিল প্রত্যক্ষ সামরিক শাসনের অধীনে। কারণ, পাকিস্তানে এ শিক্ষিত সামরিক অফিসাররাই ছিলেন ক্ষমতা গ্রহণে অগ্রণী। এই প্রক্রিয়াটি বিস্তারিতভাবে আমি উল্লেখ করেছি আমার লেখা বাংলাদেশী জেনারেলদের মন-এ। এখানে সেই গ্রন্থের নির্যাসটি তুলে ধরব। স্বাধীন হওয়ার পরও বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সম্পূর্ণ প্রশিক্ষণ ছিল ঔপনিবেশিক পাকিস্তান বাহিনীর মতো। স্বাধীন দেশের সামরিক বাহিনীর কাঠামো ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা রাজনীতিবিদরা এখানে প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। সুতরাং, ক্ষমতা দখলের অজুহাত হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে পাকিস্তানী বাহিনীর অজুহাতসমূহ এবং রাষ্ট্র পরিচালনার কৌশলও ছিল একই রকম। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য, বাংলাদেশ প্রসঙ্গে যে আলোচনা করব তার অধিকাংশ অভিজ্ঞতাজাত। দলিলপত্রে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কোনো কোনো বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেলেও স্বাভাবিকভাবেই এসব বহুল আলোচিত বিষয়ের লিখিত কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। কিন্তু বাংলাদেশে বসবাসকারী একজন হিসেবে নিত্যদিনের অভিজ্ঞতা, লিখিত দলিলপত্র থেকে কম মূল্যবান নয়। এসব লিখিত অভিজ্ঞতাই পরবর্তীকালে লিখিত তথ্য হিসেবে ব্যবহার করা হবে। পাকিস্তানে সামরিক বাহিনীকে মাঝে মাঝে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াতে হয়। তখন সিভিলিয়ন প্রেসিডেন্ট বা সংসদ ক্ষমতায় থাকে। কিন্তু তাদের কাজ করতে হয় সামরিক বাহিনীর মতামত নিয়ে। জারদারী এবং বর্তমানে নওয়াজ শরীফের শাসনের সময়ই তা স্পষ্ট। সন্ত্রাসী নিয়ন্ত্রণে কী ব্যবস্থা নেয়া হবে তা নির্ধারণ করে সামরিক বাহিনী এবং তাদের ইচ্ছানুযায়ী সংবিধান সংশোধিত হয়। এটিকে বলতে পারি, সামরিক উপস্থিতি। আর সরাসরি ক্ষমতা গ্রহণকে সামরিক শাসন বা নিয়ন্ত্রণ। সাধারণভাবে অন্যান্য দেশে সামরিক বাহিনী অভ্যুত্থান অথবা গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে উৎখাত হয়। উৎখাত হওয়ার পর ক্ষমতা-কাঠামোতে তাদের উপস্থিতি নাও থাকতে পারে বা ধীরে ধীরে তা অপসৃত হয়। বাংলাদেশে এ বিষয়টি এখনও স্পষ্ট নয় বর্তমান সংসদীয় গণতন্ত্রের আমলেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, এ দু’দেশে, বিশেষ করে বাংলাদেশে অভুত্থানে সামরিক বাহিনী হটে গেছে, কিন্তু তার উপস্থিতি রয়ে গেছে। এই উপস্থিতিও এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ, তা আবার যৌক্তিক পটভূমি তৈরি করে অবশ্যই ফের ক্ষমতা দখলের। জেনারেল মঈনের সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ যখন সিভিল সমাজের মানুষজনও সামরিক বাহিনীর পক্ষে বক্তব্য রাখা শুরু করে। উপস্থিতির পটভূমি তারা কীভাবে তৈরি করে তা আলোচনা করা যেতে পারে। সামরিক বাহিনী ক্ষমতায় যাওয়ার আগে কোনো কোনো শক্তির, [বিশেষ করে বেসামরিক] প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ অনুমোদন লাভ করে। কয়েক বছর আগেও, দেশী সংস্কৃতি শিল্প রক্ষা ক্ষেত্রে বেশি সংরক্ষণ না করলে বা সমাজতান্ত্রিক ঝোঁক থাকলে তারা এই অনুমোদন দিত; কারণ অর্থনীতিতে তারা অবাধ বাজার চাইত। পাশ্চাত্যের বাজার অর্থনীতি প্রত্যয় ও এখানকার শাসকদের অবাধ বাজার প্রত্যয় দুটি সম্পূর্ণ আলাদা। পাশ্চাত্যের বাজার অর্থনীতিতে পুঁজিবাদী প্রতিযোগিতার ফলে পণ্যের দাম কমে, ভোক্তা লাভবান হয়। এখানে বাজার দখল করে নেয় মুষ্টিমেয় উৎপাদক, আমদানিকারীরা এবং সৃষ্টি করে একচেটিয়া বাজারের। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ভোক্তারা এবং তারা নির্ভরশীল হতে বাধ্য হয়। সামরিক প্রতিনিধিরা আঁতাত করে শিল্পবাণিজ্য মালিক ও ব্যাংকারদের সঙ্গে। অর্থ প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণের জন্য সরাসরি তারা নিয়োগ করে তাদের প্রতিনিধি। যেমন, এরশাদ আমলে সরকারী প্রতিটি ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদে ছিলেন সামরিক বাহিনীর একজন করে প্রতিনিধি। (চলবে)
×