ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আজ নেপাল যাচ্ছে বাংলাদেশের মেয়েরা

প্রকাশিত: ০৬:১২, ১৯ এপ্রিল ২০১৫

আজ নেপাল যাচ্ছে বাংলাদেশের মেয়েরা

স্পোর্টস রিপোর্টার ॥ ময়মনসিংহের দক্ষিণ রানীপুর গ্রামের মৎস্য ব্যবসায়ী মিরাস উদ্দিন এবং গৃহিণী হাজেরা খাতুনের চার মেয়ে, এক ছেলে। অভাবের সংসার। শামসুন নাহার তাদের চতুর্থ মেয়ে। বয়স ১২। পড়ে কলসিন্দুর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণীতে। শৈশব থেকেই খেলাধুলার দিকে ঝোঁক মেয়েটার। খেলেও ভাল। স্কুলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় উচ্চ লাফ, দীর্ঘ লাফ এবং ১০০ মিটার দৌড়ে সবমিলিয়ে ছয়বার প্রথম হয়ে পুরস্কার পেয়েছে। তবে তার অনুরাগ হচ্ছে চর্মগোলকের প্রতি। কিন্তু অভাবের সংসার, তার ওপর মেয়ে হয়ে ফুটবল খেলবে- এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি মা-বাবা। সেটা ২০১২ সালের কথা। তিন বছরের মধ্যেই সেই মেয়েটি ফুটবল খেলে মা-বাবার হাতে তুলে দিয়েছে প্রায় ২০ হাজার টাকা। অনটনের সংসারে এই টাকা অনেক কিছু। নাহার এখন সুযোগ পেয়েছে বাংলাদেশ অনুর্ধ-১৪ বালিকা ফুটবল দলে। আজ দুপুরে সে জীবনে প্রথমবারের মতো বিমানে উঠবে। যাবে বিদেশে খেলতে। ‘কোনদিনও ভাবিনি প্লেনে উঠব, বিদেশে যাব। সবকিছু মনে হচ্ছে স্বপ্নের মতো! প্লেনে উঠব বলে মোটেও ভয় পাচ্ছি না!’- হাসিমুখে বলে নাহার। ফুটবল খেলে পরিবারের ভাগ্য বদলে দেয়ার সূচনালগ্নে নাহারের দৃপ্ত উচ্চারণ, ‘আমরা নেপালে শুরু হওয়া এএফসি অনুর্ধ-১৪ গার্লস রিজিওনাল চ্যাম্পিয়নশিপে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্যই যাচ্ছি। আশা করি ভুটান ও ভারতকে হারিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হব এবং টুর্নামেন্টের ফাইনালে খেলব।’ ২০১২ সালে বঙ্গমাতা ফুটবল, ওই বছরই প্ল্যান অনুর্ধ-১৫ বালিকা চ্যাম্পিয়নশিপ, প্ল্যান অনুর্ধ-১৫ বালিকা চ্যাম্পিয়নশিপের অনুশীলন ক্যাম্প এবং ২০১৪ সালের অক্টোবরে ‘কেএফসি জাতীয় মহিলা ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ’ খেলে নাহার এখন অনুর্ধ-১৪ বালিকা দলের চূড়ান্ত স্কোয়াডে। আগামী ২০-২৫ এপ্রিল ২০১৫ পর্যন্ত নেপালের কাঠমা-ুতে অনুষ্ঠিত হবে এএফসি অনুর্ধ-১৪ গার্লস রিজিওনাল চ্যাম্পিয়নশিপ। গ্রুপ ‘বি’ তে বাংলাদেশের সঙ্গে আছে ভারত ও ভুটান। গ্রুপ ‘এ’ তে আছে ইরান, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা এবং নেপাল। এই টুর্নামেন্টে সাত দেশ দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে খেলবে। প্রতি গ্রুপ থেকে শীর্ষ দুই দল খেলবে সেমিতে। সেক্ষেত্রে গ্রুপের একটি ম্যাচ জিতলেই বাংলাদেশের শেষ চারে খেলাটা নিশ্চিত। ট্রায়ালে নাহারকে বাছাই করেন দলের সহকারী কোচ মাহবুবুর রহমান লিটু। তিনি বলেন, ‘২০১৪ সালে জাতীয় মহিলা ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে ওর খেলা দেখে ওকে বেছে নিই। নাহারসহ ময়মনসিংহের ১২ জন মেয়ে ট্রায়ালে আসে। পরে দু’জন বাদ পড়ে। বর্তমানে অনুর্ধ-১৪ দলে নাহারসহ ময়মনসিংহের মেয়ে আছে ১০ জন।’ কিভাবে ফুটবলে এলো নাহার? ‘২০১১ সালে আমাদের অঞ্চলের মেয়ে সানজিদাকে (অনুর্ধ-১৪ দলে সানজিদাও আছে) খেলতে দেখে উৎসাহিত হই ফুটবল খেলতে। পরের বছর বঙ্গমাতা ফুটবলে অংশ নিই। আমার কোচ ছিলেন মফিজ উদ্দিন। তিনিই আমাকে ফুটবলার বানান। তাঁর নিজস্ব একাডেমিতেও আমাকে নেন। আমার মা-বাবা আপত্তি করলে তিনিই তাঁদের বুঝিয়ে-শুনিয়ে রাজি করান। প্রথমে আমি খেলতাম লেফট আউটে। পরে এক খেলায় দলে একজন ডিফেন্ডারের কমতি থাকায় আমাকে তিনি ওই পজিশনে খেলান। আমি ভাল খেললে তিনি আমাকে সবসময় ডিফেন্ডার হিসেবেই খেলতে বলেন। এখনও সেভাবেই খেলছি’- নাহারের ভাষ্য। ইতোমধ্যে অনুর্ধ-১৪ বালিকা দল ৭টি প্রস্তুতি ম্যাচ খেলেছে। জিতেছে ৫টিতে, ড্র করেছে ২টিতে। করেছে ৩২ গোল আর খেয়েছে মাত্র ৮ গোল। সব ম্যাচেই খেলে নাহার। তার বক্তব্য- ‘কোন ম্যাচেই চোট পাইনি। আসলে ফুটবল খেলা শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত সিরিয়াস কোন ইনজুরিতে পড়িনি।’ দলের বাকি ১৭ সতীর্থ খেলোয়াড়ের সঙ্গে চমৎকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে বলে জানায় নাহার। সেই সঙ্গে যোগ করে- ‘আমরা প্রায়ই একসঙ্গে বসে আলাপ করি কিভাবে টুর্নামেন্টের ফাইনালে খেলব... সেসব নিয়ে। আমাদের দলের প্রতিটি পজিশনই শক্তিশালী। সাতটি প্র্যাকটিস ম্যাচ খেলেছি। জাতীয় দলের বিরুদ্ধেই খেলেছি ৫ ম্যাচ। সিনিয়র আপুদের যদি হারাতে পারি, তাহলে ভারতকে কেন হারাতে পারব না?’ ভবিষ্যত লক্ষ্য? ‘জাতীয় দলে খেলতে চাই। চাই অনেক বছর ফুটবল খেলতে ও অনেক শিরোপা জিততে। সেই সঙ্গে চাই লেখাপড়াটাও ভালমতো চালিয়ে নিতে।’ ২০১৪ সালে এ্যাথলেট কোটায় বিজেএমসিতে চাকরি করার প্রস্তাব এসেছিল। কিন্তু সেখানে ঠিকমতো ফুটবল খেলা যাবে না বলে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয় নাহার। মেসি-নেইমারের মুগ্ধ ভক্ত নাহার সময় পেলেই টিভিতে দেশ-বিদেশের ফুটবল খেলা দেখে। স্মরণীয় ফুটবল ম্যাচ? ‘২০১৪ সালে জাতীয় মহিলা ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ফেবারিট আনসার-ভিডিপিকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়া। ওই ম্যাচে ফাইনালে নাহারের দল টাইব্রেকারে ৪-৩ (১-১) গোলে জেতে। টাইব্রেকারে দলের পক্ষে জয়সূচক গোল করেই খুশিতে-উত্তেজনায় অজ্ঞান হয়ে যাই! এদিকে আমাদের দলের জয় ডিগবাজি খেয়ে উদযাপন করতে গিয়ে পড়ে গিয়ে গুরুতর আহত হন দলের সঙ্গে আসা এক অন্ধ সমর্থক! ওই ম্যাচের কথা কোনদিনও ভুলব না’- নাহারের স্মৃতিচারণ। হিমালয়ের দেশে গিয়ে নাহারের দল কী পারবে ফাইনাল খেলতে? বাংলাদেশের ম্যাচগুলো ॥ ২১ এপ্রিল, দুপুর সোয়া ১টা, প্রতিপক্ষ- ভারত, ভেন্যু- দশরথ স্টেডিয়াম; ২২ এপ্রিল, বিকেল সোয়া ৩টা, প্রতিপক্ষ- ভুটান, ভেন্যু- আর্মি ফিজিক্যাল সেন্টার স্টেডিয়াম।
×