ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পুরনো খেলায় বিএনপি, সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে মাঠে নামানোর চেষ্টা

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ১৯ এপ্রিল ২০১৫

পুরনো খেলায় বিএনপি, সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে মাঠে নামানোর চেষ্টা

বিভাষ বাড়ৈ ॥ আবার সেই পুরনো খেলা। ধর্মের অপব্যবহার করে মিথ্যা ও বিকৃত তথ্য ছড়িয়ে আবারও নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার পাঁয়তারা করছে বিএনপি। আইন থাকলেও প্রয়োগে নির্বাচন কমিশনের নমনীয়তার সুযোগে সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের জন্য মাঠে নামানো হচ্ছে হেফাজত, খেলাফত মজলিশ, নেজামে ইসলামী, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামসহ মৌলবাদী গোষ্ঠীকে। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতকে ইসলামের ধারক বাহক আর আওয়ামী লীগসহ সরকারকে ইসলামের প্রতিপক্ষ হিসাবে প্রচার চালানোর জন্য উগ্রবাদীদের সক্রিয় করছে বিএনপি। উগ্রবাদীদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন জামায়াত-বিএনপির শীর্ষ নেতারা। ইতোমধ্যেই হেফাজতের নেতাকর্মীদের উস্কানি, অর্থের প্রলোভন দেয়া হয়েছে। এ তৎপরতার অংশ হিসাবেই শুক্রবার রাতে খালেদা জিয়া ও বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন হেফাজত, জমিয়ত নেতারা। জানা গেছে, নির্বাচনের আগেই বিএনপি সকল উগ্রবাদী দল ও সংগঠনকে মাঠে নামাতে চায়। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও তার ছেলে তারেক রহমানও মৌলবাদীদের ব্যবহার করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চান। তাদের নির্দেশের পরই হেফাজতসহ তাদের ব্যানারে থাকা উগ্রবাদী সংগঠনগুলোর সঙ্গে গেল সপ্তাহে যোগাযোগ শুরু করেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা। বিএনপি নেতারা এ কাজে জামায়াতের সহায়তা চেয়েছেন। ইতোমধ্যেই বিএনপি-জামায়াতসহ উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে। জানা গেছে, আগামী দু’দিনের মধ্যেই প্রকাশ্যে না হলেও কৌশলে ধর্মীয় কর্মসূচীর নামে উগ্রবাদীদের মাঠে নামাতে চায় তারা। একদিকে হেফাজতিরা নিজেদের অরাজনৈতিক বলে প্রচার চালাবে অন্যদিকে সরকার সমর্থক প্রার্থীদের ধর্ম বিরোধী হিসাবে দাঁড় করাতে চায় তারা। সূত্রগুলো বলছে, গেল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের মতো এবারও যদি নির্বাচন কমিশন ধর্মীয় উস্কানির বিষয়ে নমনীয় থাকে তবে একই খেলায় মেতে উঠবে চিহ্নিত এ চক্রটি। বিএনপি-জামায়াতের পক্ষ থেকে হেফাজতের কাছে আগের মতোই প্রচার চালানোর আবেদন জানানো হয়েছে। পত্র পত্রিকায় সরকার সমর্থক প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কৌশলে বিবৃতি পাঠানোর আবেদনও জানানো হয়েছে। সিটি নির্বাচন সামনে রেখে ২০ দলীয় জোটকে নানাভাবে সমর্থনও দিতে শুরু করেছে হেফাজতের বেশ কয়েকজন নেতা। এছাড়া বিএনপির প্রার্থীদের জয়ী করতে কৌশলগত অবস্থান থেকে কাজ করার চিন্তা করছে হেফাজত। তবে চট্টগ্রামের চেয়ে বিএনপির সঙ্গে কাজ করার জন্য বেশি তৎপর হেফাজতসহ এসব সংগঠনের ঢাকার নেতারা। হেফাজতের চট্টগ্রামের নেতাদের একটি বড় অংশ বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে এখন আর কাজ করার পক্ষে নন। শুক্রবার রাতে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেছেন হেফাজত নেতারা। বৈঠকে হেফাজতে ইসলামের ঢাকা মহানগর শাখার আহ্বায়ক মাওলানা নূর হোসেন কাসেমীর নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্য খালেদার বাসভবনে বৈঠক করেছেন। বাসভবন সূত্র জানায়, রাত সাড়ে ৯টা থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত টানা এক ঘণ্টার রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন হেফাজত নেতারা। বৈঠকে আসন্ন তিন সিটি নির্বাচন নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয় বলে জানিয়েছেন হেফাজতের নেতারা। খালেদা জিয়া সিটি নির্বাচনে ২০ দলীয় জোট প্রার্থীদের জয়ী করার জন্য হেফাজত নেতাদের কাছে সাহায্য চেয়েছেন। হেফাজত নেতারাও বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের কৌশলে সমর্থন দেয়ার আশ্বাস দেন। এর আগে হেফাজত ও জমিয়তের নেতারা ঢাকা উত্তর সিটিতে বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত প্রার্থী তাবিথ আউয়ালের সঙ্গেও তার বাসায় গিয়ে সাক্ষাত করেন। হেফাজতের কৌশল সম্পর্কে জানা গেছে, আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দিয়ে মৌলবাদীরা নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের মেয়র কিংবা কাউন্সিলর প্রার্থীদের পক্ষে মাঠে নামবেন না। নেতাকর্মীরা স্থানীয়ভাবে মাঠে কাজ করে যাবে যার যার অবস্থান থেকে। মসজিদ, মাদ্রাসাকে কেন্দ্র করে সরাসরি আওয়ামী লীগ বিরোধী না হলেও ‘নাস্তিকদের’ পক্ষ না নিতে হেফাজত প্রচার চালাবে। হেফাজতে ইসলাম একটি ‘অরাজনৈতিক সংগঠন’ উল্লেখ করে হেফাজতের সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী ইতোমধ্যেই বলেছেন, হেফাজতে ইসলাম কোন রাজনৈতিক দল নয়। এটা একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। হেফাজতে ইসলামের কোন নির্বাচনে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রচারে নামার সুযোগ নেই। আমরা বিগত সিটি নির্বাচনেও যাইনি। তবে আমাদের সংগঠনের নেতাকর্মীরা স্থানীয়ভাবে কিংবা তাদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে নির্বাচনে কোন প্রার্থীকে সমর্থন দিতে পারে। কারণ তারা এ দেশের নাগরিক। নাগরিক হিসেবে তাদের অধিকার আছে। সেক্ষেত্রে তারা যেকোন প্রার্থীকে সমর্থন কিংবা সহায়তা করতে পারেন। তারা বিবেচনা করবেন কে ভাল, কে মন্দ। এক্ষেত্রে তাদের ব্যক্তিগত বিষয়ে হেফাজতের আপত্তি থাকার কিছু নেই। তবে আমাদের অবস্থান নাস্তিকদের বিরুদ্ধে। গেল সিটি নির্বাচনগুলোতেও বিএনপি-জামায়াত ধর্মীয় কার্ড তথা ধর্মীয় ইস্যুর অপব্যবহার করেছে নির্লজ্জভাবে। যে কারণে নির্বাচনে স্থানীয় উন্নয়নের বিষয়টি প্রাধান্য পায়নি বলে বলছেন সংশ্লিষ্টরা। জাতীয় ইস্যু হিসেবেও ধর্মীয় বিষয় নিয়ে এসেছেন বিএনপি প্রার্থীরা। তারা মিথ্যা প্রচার করেছেন মুসলিম হয়েও আওয়ামী লীগ নাকি ইমান-আকিদার ওপর আঘাত হেনেছে। বিশেষ করে হেফাজতের কর্মীরা, সরকারকে ইসলামবিরোধী বলে প্রচার করেছে। এর আগে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় ধর্মের কথা বলেই জঙ্গীদের উত্থান ঘটেছিল। নৌকায় ভোট দিলে দেশে ধর্ম থাকবে না, ইসলাম থাকবে না, মাথায় টুপি থাকবে না, মসজিদে আজানের পরিবর্তে উলুধ্বনি বাজবে। সন্তানের নাম ‘রহিম-করিম’ রাখতে পারবেন না, ‘রাম-শ্যাম, যদু-মধু’ রাখতে হবে। বিএনপির হিন্দু নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ও বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে বিসমিল্লাহ থাকবে না। মূলত নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য ধর্মের অপব্যবহার করেছে বিএনপি-জামায়াত। নির্বাচন কমিশনের গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ অনুযায়ী নির্বাচনে ধর্মকে ব্যবহার, উস্কানি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অথচ কমিশনের শক্ত অবস্থানের অভাবে গেল সিটি নির্বাচনের মতো আবারো ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা শুরু হয়েছে। এদিকে আসন্ন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে উগ্র সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী গোষ্ঠীর পক্ষের মেয়র প্রার্থীদের ভোট না দিতে ভোটারদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিশিষ্টজনরা। তারা বলেছেন, হেফাজতের ৫ নেতার সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া শাপলা চত্বরের উন্মত্ততা সামনে আনতে চাইছেন। নির্বাচন সামনে রেখে খালেদা জিয়ার ভূমিকা নির্বাচনী আচরণবিধির লঙ্ঘন কি-না, এ বিষয়ে কমিশনের ব্যাখ্যা দেয়া জরুরী। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির চেয়ারপার্সন শুক্রবার রাতে হেফাজতের ৫ নেতার সঙ্গে বৈঠক করেন। ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরের উন্মত্ততা আমরা ভুলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু খালেদা জিয়া তা সামনে নিয়ে এলেন। তিনি বলেন, হেফাজত একটি ধর্ম প্রচারের সংগঠন। রাজনৈতিক দল নয়। নির্বাচনের আগে এই ধরনের একটি সংগঠনের সঙ্গে খালেদা জিয়ার বৈঠক কিসের ইঙ্গিত তা আমরা জানতে চাই। নির্বাচনী আচরণবিধি অনুসারে ধর্মকে নির্বাচনী কাজে ব্যবহার না করার কথা থাকলেও একটি গোষ্ঠী তা করার চেষ্টা করছে। সভা সমাবেশ করে খালেদা জিয়া প্রার্থীদের পক্ষে আইনভেঙ্গে ভোট চাচ্ছেন। আমরা নির্বাচন কমিশনের কাছে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা চাই। আমরা নগরবাসীর বিবেকের কাছে প্রশ্ন রাখতে চাই, আমরা হেফাজতের মতো সেই সাম্প্রদায়িক শক্তির উন্মত্ততার পথে ফেরার ফাঁদে পা দেব কি-না। নাকি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকব। অন্যদিকে বাংলাদেশে নির্বাচনে ধর্মের অপব্যবহার বাড়ছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা।তাঁরা বলেন, এর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট আইন থাকলেও তা প্রয়োগ করা হচ্ছে না।
×