ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অবিলম্বে আইন হচ্ছে

বিদেশীরা বৈবাহিক সূত্রে নাগরিকত্ব পাবেন

প্রকাশিত: ০৫:১২, ১৮ এপ্রিল ২০১৫

বিদেশীরা বৈবাহিক  সূত্রে নাগরিকত্ব  পাবেন

তপন বিশ্বাস ॥ বাংলাদেশে এই প্রথমবারের মতো পূর্ণাঙ্গ একটি নাগরিকত্ব আইন করতে যাচ্ছে সরকার। এতে কোন বিদেশী বাংলাদেশের কোন নাগরিককে বিয়ে করলে তাকে নির্ধারিত শর্তসাপেক্ষে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা যাবে। নাগরিকত্ব গ্রহণে মিথ্যা তথ্য প্রদান করলে বা তথ্য গোপন করলে সর্বোচ্চ দুই বছর কারাদ- এবং পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার বিধান থাকছে। পুনরায় একই অপরাধ সংঘটনে প্রথমবারে কৃত অপরাধের জন্য বর্ণিত দ-ের পরিমাণ দ্বিগুণ হবে। সেক্ষেত্রে সর্বোচ্চ চার বছর কারাদ- এবং ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে আইনটিতে। বৈবাহিক সূত্রে নাগরিকত্ব প্রদান, নাগরিকত্বের অবসানের বিধানও থাকছে নতুন এই আইনে। আইন প্রণয়নের পর প্রায় সকল ক্ষেত্রে নাগরিকত্ব সার্টিফিকেট ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হবে। এতে বাংলাদেশের নাগরিক নন এমন ব্যক্তির রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা সীমিত হয়ে যাবে। এমনকি দেশে জাল ভোটারের সংখ্যাও কমে আসবে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা অনেকটাই নিশ্চিত হবে। আইনটির খসড়া চূড়ান্ত করে ভেটিংয়ের লক্ষ্যে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ভেটিং শেষে এটি মন্ত্রিসভা বৈঠকে অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে। মন্ত্রিসভার অনুমোদনের পর বিল আকারে তা পাসের জন্য জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বাংলাদেশে এই প্রথম পূর্ণাঙ্গ একটি নাগরিত্ব আইন প্রণয়ন করতে যাচ্ছে সরকার। বর্তমানে ‘ দ্য সিটিজেনশিপ এ্যাক্ট ১৯৫১ এবং দ্য বাংলাদেশ সিটিজেনশিপ (টেম্পোরারি প্রভিশন) অর্ডার, ১৯৭২ (অর্ডার নং ১৪৯ অব ১৯৭২) বিধানবলে দেশের নাগরিকত্ব নির্ধারণ করা হয়। বিদ্যমান এই আইন ও আদেশে বৈবাহিক সূত্রে নাগরিকত্বের বিধান নেই। নতুন এই আইনে বৈবাহিকসূত্রে নাগরিকত্ব প্রদানের সুযোগ থাকছে। তবে বিদেশী নাগরিক বৈবাহিকসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক লাভ করলেও কোন কারণে বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তিনি নাগরিকত্ব হারাবেন। সূত্র জানায়, বিদ্যমান আইনসমূহ বিলুপ্ত করে পূর্ণাঙ্গ একটি আইন করার লক্ষ্যে ২০০৫ সাল থেকে কাজ করে যাচ্ছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আইনটি প্রণয়ণের লক্ষ্যে ২০১১ সালে মন্ত্রিপরিষদ নীতিগতভাবে অনুমোদন দিয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০১৪ সালের শেষদিকে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সর্বশেষ মতবিনিময় শেষে আইনের খসড়াটি প্রাথমিকভাবে চূড়ান্ত করে তা ভেটিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। একটি যুগোপযোগী আইন প্রণয়নের লক্ষ্যে ১ এপ্রিল আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ বিভাগে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আইনমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্মসচিবের সমন্বয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বৈঠকে প্রবাসী শ্রমিকদের মধ্যে যারা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব হারিয়েছেন তাদের দ্বৈত নাগরিকত্ব দেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এছাড়া নাগরিকত্ব ব্যবস্থাপনা বিষয়ে নির্বাচন কমিশন, পাসপোর্ট অধিদফতর, স্থানীয় সরকার আইন সংক্রান্ত বিষয় পর্যালোচনা করে ডিজিটাল পদ্ধতিতে নাগরিকত্ব সার্টিফিকেট প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষ নাগরিকত্ব সংক্রান্ত সনদ প্রদানের ক্ষেত্রে আরও অধিকতর দায়িত্বশীল ও জবাবদিহি করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সূত্র জানায়, প্রস্তাবিত আইনটি চূড়ান্ত হলে নাগরিকত্ব বিষয়ে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করা হবে। এতে ভুয়া ঠিকানা দিয়ে বা বাংলাদেশের নাগরিক নয় এমন কোন ব্যক্তি বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশ যাওয়া এবং অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িত থাকার বিষয় অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে। এছাড়া আইনটি প্রণয়ন করা হলে প্রায় সকল ক্ষেত্রে নাগরিকত্ব সার্টিফিকেট ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হবে। এতে বাংলাদেশের নাগরিক নন এমন ব্যক্তির রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা সীমিত হয়ে যাবে। এমনকি দেশে জাল ভোটারের সংখ্যাও কমে আসবে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা অনেকটাই নিশ্চিত হবে। বৈবাহিকসূত্রে নাগরিকত্ব ॥ খসড়ায় বলা হয়েছে, কোন বিদেশী বাংলাদেশের কোন নাগরিকের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলে তাকে নির্ধারিত শর্তসাপেক্ষে তাকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা যাবে। তবে এ ক্ষেত্রেও আবেদনকারীকে নিরবচ্ছিন্নভাবে কমপক্ষে তিন বছর বাংলাদেশে বসবাস করতে হবে। ওই তিন বছরের মধ্যে চিকিৎসা, শিক্ষা অথবা জরুরী প্রয়োজনে বাংলাদেশের বাইরে গমন করতে সাময়িক অবস্থানকাল পরবর্তীতে তাকে বাংলাদেশে অবস্থান করে প্রথম আগমনের সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের মধ্যে মোট তিন বছর পূর্ণ করতে হবে। এ সময়কে বাংলাদেশে নিরবচ্ছিন্নভাবে বসবাসের আওতাধীন বলে গণ্য হবে। এই ধারায় আরও বলা হয়েছে, নাগরিকত্ব লাভের পর কোন কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিয়েবিচ্ছেদ ঘটলে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণকারী স্বামী বা স্ত্রীর নাগরিকত্ব সয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে। কিন্তু তাদের সন্ত্রানদের নাগরিকত্ব বহাল থাকবে। নিবন্ধনসূত্রে নাগরিকত্ব ॥ কোন সাবালক এবং সমর্থ ব্যক্তির আবেদনের প্রেক্ষিতে তাকে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে নিবন্ধন করা যাবে। যদি তার পূর্বপুরুষ (জীবিত অথবা মৃত) অবিভক্ত ভারতে জন্ম গ্রহণ করেন, তিনি বাংলাদেশের একজন সাধারণ নাগরিক হন এবং আবেদনপত্র অব্যবহিতপূর্বে কমপক্ষে পাঁচ বছর বাংলাদেশে বসবাস করেন। তবে শর্ত থাকে যে, উল্লেখিত পাঁচ বছরের মধ্যে তাকে নিরবচ্ছিন্নভাবে তিন বছর বাংলাদেশে বসবাস করতে হবে। বাংলাদেশের বাইরে তার অবস্থান একাধারে ছয়মাসের বেশি হতে পারবে না। আবেদনের আগে একাধারে কমপক্ষে তিন মাস বাংলাদেশে বসবাস করতে হবে। এ সকল শর্ত পূরণ করতে তিনি বাংলাদেশের স্থায়ী আবাসিক অধিকার সনদ অর্জন করার যোগ্য হবেন। অপরাধ সংঘটন ও পুনঃসংঘটনের দ- ॥ এই আইনের অধীনে কোন ব্যক্তি অসদুদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে যদি কোন মিথ্যা বা বিকৃত তথ্য প্রদান বা তথ্য গোপন করলে তিনি সর্বোচ্চ দুই বছর পর্যন্ত কারাদ- অথবা পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয়দ-ে দ-িত হবেন। যদি কোন ব্যক্তি পুনরায় একই অপরাধ সংঘটন করেন সে ক্ষেত্রে প্রথমবারে কৃত অপরাধের জন্য বর্ণিত দন্ডের পরিমাণ দ্বিগুণ হবে। দ্বৈত নাগরিকত্ব ॥ প্রবাসে অর্জিত নাগরিকত্বের কারণে এই আইনে নিজ দেশের অর্জিত নাগরিকত্বের অবসান ঘটবে না। সে ক্ষেত্রে নির্ধারিত প্রক্রিয়ায় আবেদনের পর তাকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা যাবে। এটি দ্বৈত নাগরিকত্ব হিসেবে গণ্য হবে। কোন বাংলাদেশী নাগরিক কোন কারণে বাংলাদেশের নাগরিকত্বের অবসান ঘটানোর পর বিধি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত পন্থায় তার বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পুনর্বহালের জন্য সরকারের কাছে আবেদন করলে তা বিবেচনায় নিয়ে অন্য কোন আইন দ্বারা বাতিল না হলে তার নাগরিকত্ব পুনর্বহাল করার বিধান রাখা হয়েছে। জন্মসূত্রে নাগরিক ॥ বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী প্রত্যেক ব্যক্তি জন্মসূত্রে নাগরিক হবেন, যদি তার পিতা বা মাতা এই আইন বলবৎ হওয়ার তারিখে বা এর পরে অথবা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে এই আইন বলবৎ হওয়ার অব্যবহিত পূর্ব পর্যন্ত সময়ের মধ্যে জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক হন বা থাকেন। এছাড়া খসড়ায় আরও বলা হয়েছে, এই আইন বলবৎ হওয়ার পর দুই বছর বয়স পর্যন্ত কোন শিশু বাংলাদেশে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া গেলে এবং যদি সম্পূর্ণ বিপরীত কিছু প্রকাশ না পায় তাহলে ওই শিশু বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছে বলে ধরে নিয়ে তাকে জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক করা যাবে। বংশসূত্রে নাগরিকত্ব ॥ কোন ব্যক্তি বাংলাদেশের বাইরে অন্য কোন দেশে জন্মগ্রহণ করলেও তিনি বাংলাদেশের নাগরিক হবেন। তবে তার পিতা বা মাতা বংশসূত্র ছাড়া ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে এই আইন বলবৎ হওয়ার অব্যবহিত পূর্ব পর্যন্ত সময়ের মধ্যে অন্য কোনভাবে বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে থাকলে, তিনি বাংলাদেশের নাগরিক হবেন। তবে কোন ব্যক্তির পিতা বা মাতা কেবল বংশসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক হওয়ার কারণে ওই ব্যক্তি এই আইনের অধীনে বাংলাদেশের নাগরিক হবেন না, যদি বাংলাদেশী কনস্যুলেট বা দূতাবাসে তার জন্মের এক বছরের মধ্যে নিবন্ধন করা না হয়, তিনি যে দেশে জন্মগ্রহণ করেছেন সে দেশের নিয়ম অনুযায়ী জন্ম নিবন্ধন সনদপ্রাপ্ত না হন, অথবা জন্মকালে তার পিতা বা মাতা বাংলাদেশ সরকারের অধীনে কিংবা প্রেষণে/লিয়েনে অন্যত্র চাকরিতে না থাকেন। বাংলাদেশে স্থায়ী আবাসিক অধিকার ॥ যদি কোন ব্যক্তি নির্ধারিত অঙ্কে বৈদেশিক মুদ্রায় বা বৈদেশিক মূলধন ও যন্ত্রপাতি বা উভয় প্রকারেই বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেন বা নির্ধারিত পদ্ধতিতে ও অঙ্কে বাংলাদেশের কোন কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেন এবং এতদুদ্দেশে বাংলাদেশে নির্ধারিত সময়কাল অবস্থান করেন, তাকে বাংলাদেশে স্থায়ী আবাসিক অধিকার সনদ প্রদান করা যাবে। তবে তিনি এই ধারার অধীনে নাগরিকত্ব অর্জন না করা পর্যন্ত, তাকে বাংলাদেশের একজন স্থায়ী নিবাসী বলে গণ্য করা হবে। এছাড়া খসড়ায় নাগরিকত্ব প্রদান সংক্রান্ত বিষয়ে-নিবন্ধিত বা অনিবন্ধিত জাহাজ বা উড়োজাহাজে জন্মগ্রহণ, ভূখ- সংযোজনসূত্রে নাগরিকত্ব, স্থায়ী নিবাসের সনদ, নিবন্ধন এবং দেশীয়করণের মাধ্যমে অর্জিত নাগরিকত্বের কার্যকারিতা, নিবন্ধন বহি, নিবন্ধন সনদ, অপ্রাপ্ত বয়স্কদের নিবন্ধন সংশয়ের ক্ষেত্রে প্রদত্ত নাগরিকত্ব সনদ, নাগরিকত্ব পরিত্যাগ, নগরিকত্বের অবসান পুনর্বিবেচনা ইত্যাদি ধারা সংযোজিত হয়েছে। খসড়ায় আরও বলা হয়েছে আইনটি বলবৎ হলে বিদ্যমান দ্য সিটিজেনশিপ এ্যাক্ট ১৯৫১ এবং দ্য বাংলাদেশ সিটিজেনশিপ (টেম্পোরারি প্রভিশন) অর্ডার, ১৯৭২ (অর্ডার নং ১৪৯ অব ১৯৭২) রহিত হবে।
×