ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকায় ভাসমান মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে

প্রকাশিত: ০৪:৪১, ১৮ এপ্রিল ২০১৫

ঢাকায় ভাসমান মানুষের সংখ্যা বেড়েই  চলেছে

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ বয়সের কারণেই পায়ের শক্তি কমে গেছে রতন মিয়ার। তাই রিক্সার গতি স্বাভাবিকভাবে কম হওয়ার কথা। পঞ্চাশ বছর বয়সোর্ধ রতন মিয়ার সঙ্গে কথা হলো শাহবাগে জাদুঘরের সামনে। এখনও যেন যুবক। তাঁর দেহে ক্লান্তির ছাপ পড়লে, মনে কোন বয়সের ছাপ নেই। আগে বরিশাল শহরে রিক্সা চালত। এখন ঢাকায় রিক্সা চালায়। কেমন কাটছে দিনকাল জানতে চাইলে রতন মিয়া বলেন, ‘রিক্সার বাজার মন্দা।’ পরিসংখ্যান ব্যুরো জরিপের ফলাফল অনুযায়ী ঢাকায় ফুটপাতে ভাসমান মানুষ ৫০ হাজার ক্রমে এদের সংখ্যা আরও বাড়ছে। প্রতিদিন ঢাকায় ভাসমান মানুষ জন্মগ্রহণ করার হারও বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূল এলাকায় প্রাকৃতিক দুযোর্গ ভূমিক্ষয় ও বন্যায় ঘরবাড়ি হারিয়ে শূন্য হাতে অনেকে ঢাকায় আসছেন। রতন মিয়ার মতো তাদের বেশিরভাগের ঠাঁই মিলছে ফুটপাতে। এদের মধ্যে শিক্ষা-স্বাস্থ্য এবং নাগরিক অধিকারের কোন চিন্তা কাজ করছে না। অনুসন্ধানে দেখা যায়, সব থেকে বেশি আসছেন কর্মসংস্থানের খোঁজে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এসব মানুষ ঢাকায় এসে আবাসন সমস্যার মুখে পড়ছে এবং ভবিষ্যতে আরও প্রকট রুপ ধারণ করতে পারে। ঠিকানাবিহীন সফিয়া বেগমের কষ্টটা আরও প্রকট। তার ছেলেটি তিন মাস আগে চুরি হয়ে যায়। সেই থেকে তাকে (শিশু) খুঁজছে। গুলিস্তানে জাতীয় স্টেডিয়ামের পাশে ফুটপাতে বসে কথা হয় সফিয়া বেগমের সঙ্গে। তার কোন স্থায়ী বাড়ি-ঘর নেই। তার স্বামীও তাকে ছেড়ে গেছে দু’বছর হলো। এখন কেবল মেয়েটি রয়েছে তার। সফিয়া বেগম জানালেন, হঠাৎ করেই এই মানুষের ভিড়ে রাতে ছেলেটিকে হারিয়ে ফেলেছেন। ওকে খুঁজতে সব জায়গায় ঘুরেছি। আমি কেঁদে কেঁদে তার নাম ধরে কত ডেকেছিলাম। কিন্তু তাকে আর পাইনি। জেন্ডার এ্যান্ড গভর্ন্যান্স ট্রেইনিং প্রোগ্রাম গবেষণায় দেখা গেছে ঢাকায় শতকরা ৪০ ভাগ মানুষ ১০-৩০ বছর ধরে, ৩৭ ভাগ পাঁচ বছর ধরে এবং ২৩ ভাগ ৬-১০ বছর ধরে বসবাস করছে। যে সব মানুষ ৫-১০ বছর আগে আসছে তারাই এখন বেশিরভাগ ভাসমান মানুষ। রাজধানী ঢাকায় বিভিন্ন পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা কাজের খোঁজে ঢাকায় এলেও কাজ পাচ্ছে না ঢাকায়। অনেকের রাত কাটানোর মতো কোন ভাড়া বাসাও নেই। তাই বাধ্য হয়ে তাদের ফুটপাতে বা বস্তিতে ঠাঁই নিতে হচ্ছে। সর্বশেষ বাংলাদেশ আরবান হেল্থ জরিপ-২০১৩ এর প্রাথমিক ফলাফল অনুযায়ী ঢাকায় যেসব ভাসমান মানুষ বাস করে তার মধ্যে একই বস্তি বা ফুটপাত থেকে আসে শতকরা ৪১.৯ ভাগ। ঢাকা বিভাগের অন্যান্য জেলা শহর থেকে শতকরা ১৭ দশমিক ৪ ভাগ, চট্টগ্রাম বিভাগ ১৬ দশমিক ৯ ভাগ , বরিশাল বিভাগ ১০ দশমিক ৩ ভাগ, খুলনা বিভাগ ৪ দশমিক ৯৩ ভাগ, রাজশাহী বিভাগ ৩ দশমিক ৭ ভাগ, রংপুর বিভাগ ২ দশমিক ৯ ভাগ, সিলেট বিভাগ ১ দশমিক ৬ ভাগ এবং বিদেশে ও অন্যান্য স্থান দশমিক ৪ ভাগ নারী ভাসমান মানুষ ঢাকায় আসে। এদের মধ্যে ১৬ দশমিক ৬৭ ভাগ মানুষ জানে না কোথায় তাঁদের বাড়িঘর। জন্ম থেকে একই বস্তি বা ফুটপাতে বাস করা শিশুর হার ছিল শতকরা ৩২ ভাগ। আর ‘বাংলাদেশ আরবান স্বাস্থ্য জরিপ-২০১৩’ অনুযায়ী ওই হার বেড়ে হয়েছে ৪১ দশমিক ৯ ভাগ। নয় বছরে শতকরা বৃদ্ধির হার ৩০ দশমিক ৯৪। প্রতিদিন ঢাকায় ভাসমান মানুষ জন্মগ্রহণ করায় এ হার ক্রমে ক্রমে আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। কনসার্ন ওয়ার্ল্ড ওয়াইড সূত্র মতে, ঢাকায় মানুষ ৭০ লাখ থেকে এক কোটি মানুষ অস্থায়ী বাসিন্দা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো জরিপের ফলাফল অনুযায়ী ঢাকায় ফুটপাতে ভাসমান মানুষ ৫০ হাজার। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক প্রতিবেদনের সূত্র অনুযায়ী, বর্তমান ঢাকায় দেড় কোটি মানুষ বাস করে। প্রতিবছর ৪ লাখ করে যোগ হচ্ছে। সে হিসেবে ২০২০ সালের মধ্যে ঢাকায় জনসংখ্যা হবে দুই কোটির ওপরে। আর তখন ভাসমান মানুষ বৃদ্ধি পেয়ে হবে দ্বিগুণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের শিক্ষক ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, ঢাকা শহরে স্থায়ী, অস্থায়ী ও ভাসমানÑ এই তিন ক্যাটিগরির প্রায় দেড় কোটি মানুষ বাস করছেন। এদের মধ্যে ৩৬ থেকে ৪০ লাখ মানুষ ভাসমান। কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে রাজধানীতে আসছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে ভাসমান মানুষের সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশের পপুলেশন পলিসিতে ভাসমান জনগোষ্ঠী নিয়ে কোন চিন্তা-ভাবনা নেই। এদের সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যানও নেই। এরা ঢাকায় আছেন মূলত কর্মসংস্থানের জন্য। তাই এমন পরিস্থিতিতে তাদের কর্মহীন হওয়া খুবই স্বাভাবিক। তিনি আরও জানান, পপুলেশন পলিসিতে বলা আছে, মানুষকে শহর বিমুখ করা হবে। কিন্তু বাস্তবে কার্যকর কোন পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। যদি এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হতো তাহলে রাজধানীতে ভাসমান মানুষের সংখ্যা কমতো।
×