ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রকল্পে পূর্ব শর্ত মানা হয়নি, বিচার করা হয়নি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ॥ টিআইবি

রামপাল ও মাতারবাড়ী বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগ

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ১৭ এপ্রিল ২০১৫

রামপাল ও মাতারবাড়ী বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা সম্পাদনে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট এসেসমেন্ট (ইআইএ) সম্পাদন, স্থানীয় জনমত উপেক্ষা করে নানা দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে রামপাল ও মাতারবাড়ী বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এছাড়া জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) বিরুদ্ধে কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে দেশের প্রথম কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পে ঋণের নামে জলবায়ু তহবিলের অর্থ বরাদ্দ দেয়াকে প্রতারণা বলে অভিযোগ করা হয়। বৃহস্পতিবার রাজধানীর মাইডাস সেন্টারে টিআইবি কার্যালয়ে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এসব অভিযোগ তুলে ধরেন। টিআইবি রামপাল ও মাতারবাড়ী বিদ্যুত প্রকল্প : ভূমি অধিগ্রহণ ও পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ শেষে তিনি বলেন, প্রকল্প করতে যেসব পূর্বশর্ত রয়েছে তা মানা হয়নি। আন্তর্জাতিক মানদ- বিচার করা হয়নি। যাদের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কথা তারা পাননি। অন্যদিক এর প্রভাব পড়ছে সার্বিকভাবে আর্থসামাজিক খাতে। সারাবিশ্বে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত প্রকল্প বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অথচ আমাদের এখানে কয়লাভিত্তিক প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে, যা পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব পড়বে। ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, উভয় প্রকল্পেই পরিবেশ ও আর্থসামাজিক ক্ষতির কথা উল্লেখ করা হয়নি। যাদের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কথা তাদের বেশিরভাগই প্রকৃত ক্ষতিপূরণ পাননি। আবার অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি ক্ষতির তুলনায় অধিক ক্ষতিপূরণের টাকা পেয়েছেন। প্রকল্পের কারণে জনগণের জীবন-জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু প্রকল্পের শর্তাবলী জনগণকে জানানো হয়নি। পরিবেশ দূষণ বিবেচনা করে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত প্রকল্প সুনির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে পর্যায়ক্রমে বন্ধ করতে হবে। একই সঙ্গে সৌরবিদ্যুত ও বায়ুবিদ্যুতের মতো নবায়নযোগ্য প্রযুক্তির বিকাশ ঘটাতে হবে। সংবাদ সম্মেলনে জাইকার প্রতারণার বিষয়ে টিআইবির কাছে দালিলিক কোন প্রমাণ আছে কিনা- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে ড. ইফতেখার বলেন, আমরা রিলায়েবল সোর্স থেকে এটা জানতে পেরেছি। গবেষণা কার্যক্রমটি নবেম্বর ২০১৪ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০১৫ পর্যন্ত সময়ে পরিচালিত হয়। সম্মেলনে সভাপতির বক্তব্যে এ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, বিদ্যুত আমাদের একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু জনগণের জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে নয়। রামপাল প্রকল্পে শুধু মানুষ নয়, প্রাণিকুলও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জাতীয় স্বার্থে কোন কাজ হলে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে তা গ্রহণ করে। উভয় প্রকল্পেই ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে এবং পরিবেশগত সমীক্ষাগুলোও প্রশ্নবিদ্ধ। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকার কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন রামপাল প্রকল্পে নিয়ম ভেঙ্গে ইআইএ করেছে একটি সরকারী প্রতিষ্ঠান এবং জাপানী অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন মাতারবাড়ী প্রকল্পে ইআইএ করেছে একটি জাপানী প্রতিষ্ঠান, যার ফলে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানে স্বার্থের সংঘাতের ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। রামপালের ইআইএ সম্পাদনে বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (বিপিডিবি) এবং ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ারপ্ল্যান্ট কোম্পানি লিমিটেডের (এনটিপিসি) পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের কারিগরি নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে, যা নিরপেক্ষতার মানদ-কে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। শিল্পসমৃদ্ধ এলাকা বা ফাঁকা জায়গা না হলেও এসব জায়গায় প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিবেশগত ছাড়পত্র দিয়েছে পরিবেশ অধিদফতর, যা নিয়মবহির্ভূত। এমনকি রামপাল প্রকল্পের ক্ষেত্রে বন বিভাগের মতামত গ্রহণ না করারও অভিযোগ রয়েছে। রামপাল প্রকল্পে ইআইএ সম্পাদনের আগেই শর্তভঙ্গ করে মাটি ভরাটসহ অন্যান্য উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু হলেও পরিবেশ অধিদফতরের পক্ষ হতে কোন আইনানুগ ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি। রামপাল প্রকল্পে গণশুনানিতে অংশগ্রহণকারীদের মতামত অগ্রাহ্য করেই ইআইএ চূড়ান্তকরণ এবং মাতারবাড়ী প্রকল্পে স্টেকহোল্ডারদের মতামত নেয়া হয়নি। এমনকি এসব স্টেকহোল্ডার সভায় অংশগ্রহণকারীদের ‘প্রকল্পের বিরোধিতা না করার’ ব্যাপারে রাজনৈতিক নেতাদের হুমকি প্রদান করা হয়েছে। প্রকল্পের স্থান নির্বাচনে পরিবেশ রক্ষা এবং মানুষের আর্থসামাজিক ঝুঁকির চেয়ে প্রকল্পের সুবিধাদিকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। পরিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা (এনভায়রনমেন্টালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া- ইসিএ) থেকে ১৫ কিলোমিটার নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা থাকলেও রামপাল প্রকল্পে তা মানা হয়নি। এমনকি সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে কয়লা পরিবহন ও কার্বনের ফলে সৃষ্ট দূষণও এখানে বিবেচনায় আনা হয়নি। প্রকল্প দুটি বাস্তবায়নে সামগ্রিক ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন পরিকল্পনা বিষয়ে তথ্য উন্মুক্ত করা বা স্বপ্রণোদিত তথ্য প্রদান এবং বিনিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির বিষয়গুলোও জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি। অন্যদিকে উভয় প্রকল্পের বিরোধীদের বিরুদ্ধে বিভিন্নভাবে হুমকি প্রদান ও নির্যাতন করা হয়েছে। ন্যায্য ক্ষতিপূরণ না পেয়ে জমি থেকে উচ্ছেদ ও প্রকল্পবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে অনেকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অজুহাতে মামলা করা হয়েছে এবং পুলিশের ভয়ে অনেকে পলাতক জীবনযাপন করছে। অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে সময়মতো ক্ষতিপূরণ না পাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্তরা দিন দিন দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে নিমজ্জিত হচ্ছে বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়। সুশাসনের ঘাটতিজনিত বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে ১২ দফা সুপারিশ তুলে ধরে টিআইবি। এগুলো হলো- রামপাল ও মাতারবাড়ী তাপবিদ্যুত প্রকল্পের জন্য প্রণীত পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এবং স্বার্থের দ্বন্দ্ব থেকে মুক্ত বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠান/ব্যক্তি কর্তৃক মূল্যায়ন সাপেক্ষে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ, ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন কর্মপরিকল্পনা অনুসারে মূল্য নির্ধারণ, উপদেষ্টা পর্ষদ ও পুনর্বাসন উপদেষ্টা কমিটি গঠনের মাধ্যমে রামপাল ও মাতারবাড়ী প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্ত জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণ পুনর্নির্ধারণ, নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান কর্তৃক জরিপপূর্বক এ দুটি প্রকল্পের সব ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের তালিকা প্রণয়ন এবং নির্ধারিত ক্ষতিপূরণের পরিমাণসহ বিস্তরিত জনসমক্ষে প্রচার, ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে ভূমি অধিগ্রহণ শাখা কর্তৃক প্রকল্প এলাকায় ‘ওয়ান স্টপ’ সার্ভিসের মাধ্যমে স্বল্প সময়ে ক্ষতিপূরণ প্রদানের ব্যবস্থা, প্রকল্পগুলোতে ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ পাওয়া ও পুনর্বাসনের বিষয়ে অভিযোগ জানানো এবং অভিযোগ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা, প্রকল্পগুলোতে ভূমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিপূরণ প্রদানে দুর্নীতির ঘটনা তদন্তের মাধ্যমে প্রমাণ সাপেক্ষে দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ। সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন- প্রতিষ্ঠানটির উপনির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, রিসার্চ এ্যান্ড পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান প্রমুখ।
×