ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ছোট ব্যবসায়ীদের ঋণের ব্যবস্থা কী?

প্রকাশিত: ০৩:৫৬, ১৭ এপ্রিল ২০১৫

ছোট ব্যবসায়ীদের ঋণের ব্যবস্থা কী?

গত সপ্তাহে আমার লেখার শিরোনাম ছিল ‘চুতরা গাছে আম ধরে না’। ঐ নিবন্ধে আমি বলেছিলাম, ব্যাংকঋণ কিছু হাতে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। শুধু কিছু হাতে নয়, কিছু অঞ্চলেই ব্যাংকঋণ ‘কনসেনট্রেইটেড’ হচ্ছে। তথ্য দিয়ে এ কথা বলতে গিয়ে বলেছিলাম, এটাই স্বাভাবিক। সরকার এখন বড় ব্যবসা-বাণিজ্য-শিল্প-অবকাঠামো করে না। এসব করে এখন বেসরকারী খাত, বড়জোর প্রাইভেটÑপাবলিক পার্টনারশিপ। এসবে বিনিয়োগ বেশি লাগে, ঋণ বেশি লাগে। অতএব, বেসরকারী খাতে বড় বড় ঋণ যাচ্ছে। আবার ছোট-মাঝারি শিল্প করতেও আজকাল বেশ টাকা লাগে। অতএব, হাজারজনের ঋণ একজনে নিয়ে যায়। এটাই বাজার অর্থনীতি। ছোটরা মরে যায়, বড় ও শক্তিধর টিকে যায়। এসব আলোচনা করে শেষে বলেছিলাম, আগামী সংখ্যায় দেখব কিভাবে ছোটদের টেকানো যায়। বড় ঋণগ্রহীতার অর্থ কী? একজন গ্রাহক ব্যক্তিগতভাবে, কোম্পানিগতভাবে বা গ্রুপগতভাবে সর্বোচ্চ কত ঋণ নিতে পারে ব্যাংক থেকে। কিভাবে ব্যাংকঋণ কেন্দ্রীভূতকরণের ঘটনা ঠেকানো যায়। বিষয়টি বেশ জটিল ও আলোচনার জন্য অনেক জায়গা দরকার। আমাদের হাতে এত সুযোগ নেই। এর মধ্যেই চেষ্টা করা যাক। উল্লেখ্য, বড় বড় ঋণ ঠেকানো, সীমিতকরণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিন্তু চেষ্টা করে যাচ্ছে। তাদের ঘোষিত নীতিও তাই। এটা তাদের আইনী দায়িত্ব। ব্যাংক কোম্পানি এ্যাক্টের ২৬ (খ) ধারায় এই মর্মে বাংলাদেশ ব্যাংককে ক্ষমতা দেয়া আছে। এই ধারায় একজন গ্রাহককে, ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা গ্রুপÑ সর্বোচ্চ কত ঋণ দেয়া যাবে তা নির্ভর করে ব্যাংকের মূলধন কত তার ওপর অর্থাৎ সর্বোচ্চ ঋণ বা যাকে বলা হয় ‘সিঙ্গেল পার্টি এক্সপোজার’ তা নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের মূলধনের ওপর। একইভাবে ‘লার্জলোন’ সর্বমোট কত হবে তার সীমাও বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারণ করে দিচ্ছে। ঘটনা হচ্ছে, এতদসত্ত্বেও অভিযোগ উঠছে ব্যাংকঋণ কিছু লোকের কাছে বন্দী হয়ে পড়েছে। আরও মজা হচ্ছে নিয়ন্ত্রক অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংকও তা স্বীকার করে নিচ্ছে এবং দিনের পর দিন তারা ব্যাংকগুলোকে এই প্রবণতা রোধ করতে নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছে। তাহলে গলদটা কোথায়? আমি দুটি উদাহরণ দিয়ে আলোচনা শুরু করতে চাই। ১৯৯১ সালে ব্যাংক কোম্পানি এ্যাক্ট ঢেলে সাজানোর সময় আইন হলো ব্যাংকগুলো তাদের আমানতের দশ শতাংশ পর্যন্ত শেয়ার ব্যবসায় খাটাতে পারবে। এই বিধানের ফল পেলাম আমরা ২০১০ সালের দিকে। সমস্ত ব্যাংক লাফিয়ে পড়ল শেয়ার ব্যবসায়। নজিরবিহীন ধস নামে শেয়ার ব্যবসায়। বোঝা গেল এই বিধানটি ছিল মারাত্মক ভুল। এখন ব্যাংক শেয়ার ব্যবসা করতে পারে না, তা করে তাদের সাবসিডিয়ারি কোম্পানি। ১৮-১৯ বছর লাগল ভুল বুঝতে। ততদিনে সর্বনাশ যা হওয়ার তাই হয়ে গেছে। ১৯৬২ সালের কথা। তখন তৈরি হয় ‘ব্যাংক কোম্পানিজ অর্ডিন্যান্স-১৯৬২’ যা সমূলে পরিবর্তন করে তৈরি হয়েছে আজকের ব্যাংক কোম্পানি এ্যাক্ট ১৯৯১। কতদিন সময়? ২৯ বছর। ২৯ বছর আগে অর্থাৎ ১৯৬২ সালে আইন হয় ব্যাংকের মূলধন হবে মোট আমানতের ৬ শতাংশ। এটা একটা মারাত্মক ভুল। এই ভুল ভাঙ্গতে ব্যাংকারদের সময় লাগল ২৯ বছর। ১৯৯১ সালে বলা হলো মূলধনের সম্পর্ক হবে খারাপ সম্পদের সঙ্গে অর্থাৎ লোনের সঙ্গে। খারাপ লোন যত বেশি হবে ব্যাংকের পুঁজি তত বেশি লাগবে। শত হোক লায়াবিলিটির (দায়) সঙ্গে লায়াবিলিটির তুলনা হয় না। এই দুটি মারাত্মক ভুল ব্যাংকাররাই করেছেন। বহু ক্ষতির পর এ দুটি মেরামত করা হয়েছে। এমতাবস্থায় কি বলব ‘লার্জ লোন’ বা ‘সিঙ্গেল পার্টি এক্সপোজার’ সম্পর্কিত বিধিবিধানও ক্রটিযুক্ত? লার্জ লোন (বড় ঋণ) বা সিঙ্গেল পার্টি এক্সপোজারের সঙ্গে সম্পর্ক একক ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা গ্রুপ। দেখা যায় আমাদের দেশে বহু ব্যবসায়ী ব্যবসা করেন একটা ‘গ্রুপ’ পরিচয়ে। এই ‘গ্রুপের’ কোন আইনী বৈধতা নেই। খুব কমই কোম্পানি আছে যারা অন্য কোম্পানির ‘সাবসিডিয়ারি’। বড় বড় ব্যবসায়ী অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যবসা করেন প্রাইভেট কোম্পানি দিয়ে। এসব বস্তুত পারিবারিক প্রতিষ্ঠান। এখানে স্ত্রী, শ্যালিকা, বোনÑ এরা হন ‘নারী উদ্যোক্তা’Ñ কোম্পানির চেয়ারম্যান বা ম্যানেজিং ডিরেক্টর। বাস্তবে এরা ব্যবসার সঙ্গে কোনভাবেই সম্পর্কিত নন। আত্মীয়স্বজন, কর্মচারী, গ্রামবাসী, চাকর-বাকরদের পরিচালক করে বহু ব্যবসায়ী প্রাইভেট কোম্পানি করেন। তাদের নামেই ব্যবসা হয়। মূল ব্যক্তিটি থাকেন পর্দার অন্তরালে। কোম্পানির প্রকৃত মালিক চৌধুরী সাহেবÑ কথার কথা। কিন্তু সামনে আছেন মজুমদার সাহেব। ব্যাংক কোম্পানি আইনের ব্যাখ্যা দিয়ে এটা ধরা খুবই কঠিন। এটা করা হয় সুচতুরভাবে। সরকারী ব্যাংকের পরিচালক হলে সরকার তাদের নামে একটা শেয়ার হস্তান্তর করে। একই মুহূর্তে আরেকটা সাদা কাগজে সই করে রাখা হয় ওই শেয়ার পুনর্হস্তান্তরের। যে কোন মুহূর্তে সরকার ওই পরিচালকে বহিষ্কার করতে পারে এবং বিনা ঝামেলায় তাকে যে শেয়ার দেয়া হয়েছে তা ফেরত নেয়া যায়। বেসরকারী খাতেও এই ব্যবস্থা আছে। ‘হোল্ডার ইন ট্রাস্ট’ ‘বেনিফিসিয়েল ওনার’ ইত্যাদি ব্যবস্থা আছে। চৌধুরী সাহেবের শেয়ার মুজমদার সাহেবের নামে। ‘ব্ল্যাঙ্ক ট্রান্সফার ডিড’ সই করিয়ে রেখে দিলেই সব ঝামেলা শেষ। একটা উদাহরণ দিই। ভারতের বিখ্যাত ব্যবসায়ী হাউস ‘টাটা’। তার আদি মালিক জেআরডি টাটা। তাকে একবার প্রশ্ন করা হয়, আপনি তো ভারতের শ্রেষ্ঠতম ধনী ব্যক্তি। কিভাবে তা অর্জন করলেন, তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করুন। ‘জেআরডির’ উত্তরÑ আমি ভারতের দরিদ্রতম ব্যক্তি। আমার নামে কোন সম্পদ নেই, আমার ট্যাক্স ফাইলও নেই। শুনে তো সবাই অবাক। বুদ্ধি থাকলে দুনিয়ার সকল ক্ষমতা ভোগ করা যায়, সবকিছু ভোগ করা যায়Ñ অথচ দুই পয়সা ট্যাক্স দিতে হয় না, কোন কিছুর কাগজেপত্রে মালিকও হতে হয় না। এই বুদ্ধি ৬৪টি জেলার মধ্যে সকল জেলার লোকের নেই। দু-তিনটি জেলার লোকের মধ্যে আছে। আইনে আছে এক পরিবারের দু’জনের বেশি একটি ব্যাংকের পরিচালক হতে পারবে না। বলা আছে, একই সঙ্গে দুই ব্যাংকের মালিক-পরিচালক হতে পারবে না। কত কী? কিন্তু বাজার জানে এক ব্যক্তি চারটি ব্যাংকের মালিক। আইনে আইনে ব্যাংকে ব্যাংকের দশ শতাংশের বেশি শেয়ারের মালিক হওয়া যাবে না। বহু পরিচালক আছেন যাদের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ একেকটি ব্যাংকের ওপর। পদোন্নতি, চাকরি প্রদান ফাইলে সই এমডি সাহেবের। কিন্তু এই তালিকা তৈরি করেন পরিচালক-চেয়ারম্যানরা। এসবই বুদ্ধির ব্যাপার। ‘বুদ্ধি’ ব্যাংকে ব্যাংকে বেচা-কেনা হয়। এর ‘মূল্য’ আছে। এ কারণে ব্যাংক কোম্পানি এ্যাক্টের বিধানে সিঙ্গেল পার্টি এক্সপোজারের মাধ্যমে বড় বড় ঋণ বন্ধ করা সম্ভব নয়। পরিবারের সংজ্ঞা ব্যাংকের পরিচালকদের ক্ষেত্রে বলা আছে। বিধি-বিধান কম নয়। কিন্তু বিধি-বিধানের বাইরে বুদ্ধির বিধান অনেক বড়। চাকর-বাকর, মামাত ভাই, ফুফাত ভাই প্রাইভেট কোম্পানির ‘মালিক’। এমতাবস্থায় কেমনে প্রমাণ হবে ওই কোম্পানির প্রকৃত মালিক চৌধুরী সাহেব? আর মালিকই যদি প্রমাণিত না হয় তাহলে তাকে সর্বোচ্চ ঋণ কত দেয়া যাবে তার প্রশ্ন উঠবে কোত্থেকে? আরও কথা আছে। সেদিকে গেলাম না। বিদ্যমান অবস্থায় গরিবদের জন্য, ছোটদের জন্য কী করা যায়? কিভাবে তাদের জন্য ঋণের ব্যবস্থা করা যায়। কিছুদিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, প্রত্যেক ব্যাংক শাখাকে দু’জন করে নারী উদোক্তাকে ঋণ দিতে হবে। একইভাবে বলা যায়, ব্যাংকের মোট ঋণের ৫০ শতাংশ ঋণের আকার হবে ৫, ১০ ও ২০ কোটি টাকার নিচে। প্রত্যেক শাখাকে এমন ঋণ দিতে হবে। এটা কথার কথা। এভাবে ভাবা যায়। দেখা যায় বর্তমানে ব্যবসায়ীরা ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে ব্যবসা করে প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির মাধ্যমে। বিশেষ করে যারা ব্যাংকে ঋণের জন্য আসে তারা তাই। তারা প্রকল্প ঋণ নিতে আগ্রহী। প্রকল্প ঋণের ক্ষেত্রে সমমূলধন দিতে হয়। অর্থাৎ ব্যাংক যদি দেয় ৬০ শতাংশ টাকা ঋণ হিসেবে তাহলে ব্যবসায়ী দেয় ৪০ শতাংশ টাকা। এই ক্ষেত্রে তা আসে জমি হিসেবে। বলা যায়, ১০০ কোটি টাকা ঋণ নিতে হলে কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন হতে হবে কমপক্ষে ২০ কোটি টাকা, যা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে জমা থাকবে। ব্যাংক পরীক্ষা-নিরীক্ষান্তে মনিটরিংয়ের মাধ্যমে তা ব্যবহারের অনুমতি দেবে। ‘মার্জিন’ বলে একটা কথা আছে। বর্তমানে অনেক ক্ষেত্রে ‘মার্জিন’র গুরুত্ব নেই। ফলে ব্যবসায়ীরা শত শত কোটি টাকার ব্যবসা করে এবং তা অনেক ক্ষেত্রে মার্জিন ছাড়াই বা কম মার্জিনে। এটা রোধ হওয়া দরকার। বড় বড় ঋণ হচ্ছে ‘ট্রাস্ট রিসিটে’ (টিআর)। শক্ত হাতে তা দমন করা দরকার। এর অপব্যবহার হচ্ছে। এভাবেই ঋণ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। বড় বড় কোম্পানি যারা পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি তাদের ঋণ দিতে নিরুৎসাহিত করা হোক। তারা শেয়ার বাজারে যাক। সেখান থেকে পুঁজি তুলুক। এতে ব্যাংকঋণের কনসেনট্রেশন কমবে। তারা বাজার থেকে ঋণ নিক। দরকার বোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এদের ‘আমানত’ হিসেবে অথবা অন্য আকারে বাজার থেকে ঋণ নেয়ার ক্ষমতা দিতে পারে, যাতে তারা ব্যাংকংঋণ না নেয়। তারা বাজারে ‘ডিবেঞ্চার’ ইস্যু করে টাকা তুলুক। বড় বড় প্রাইভেট কোম্পানিকে পাবলিক লিমিটেড করতে উৎসাহিত করা হোক। বলা হোক তা করা হলে পাঁচ বছরের জন্য ট্যাক্স হলিডে। এটা কথার কথা। অন্য রকমও হতে পারে। আসল কথা কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাইলে অনেক কিছুই করা যায়। কিন্তু ব্যাংকটি যদি বড় ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় তাহলে তা করা যাবে না। মুশকিল এখানেই। শুধু বিধিবিধান দিয়ে হবে না। আর বর্তমান বিধানে তো হবেই না। এ ছাড়া দরকার হবে ব্যাংক প্রশাসনের মগজধোলাই, যারা বড় ঋণগ্রহীতাদের ক্রীতদাসে পরিণত হচ্ছে। লেখক : সাবেক প্রফেসর, বিআইবিএম
×