ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিদায় গুন্টার গ্রাস

প্রকাশিত: ০৩:৫৬, ১৭ এপ্রিল ২০১৫

বিদায় গুন্টার গ্রাস

পরিণত বয়সেই জীবনাবসান হলো জার্মানির নোবেলজয়ী সাহিত্যিক গুন্টার গ্রাসের। শুধু একজন মেধাবী ও বিশ্বমানের লেখক বলে নয়, স্বজাতিরা তাঁকে গুরুত্ব দিতেন একজন সমাজ বিশ্লেষক হিসেবে। তিনি একাধারে ছিলেন কবি, কথাশিল্পী, নাট্যকার, চিত্রশিল্পী ও ভাস্কর। মানুষ নশ্বর, তাঁকে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে বিদায় নিতেই হবে। কিন্তু একটি মানবজীবনের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ হলো স্বদেশ ও স্বজাতির জন্য যথাযথ অবদান রেখে যাওয়া। অবিস্মরণীয় কথাকার হিসেবে সেটি তিনি রেখেছেন উত্তমরূপেই। তাই তাঁর দেশবাসী তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণে রাখবে। বিশ্ববাসীর কাছেও তিনি স্বগুণে সুপরিচিতি লাভ করেছিলেন। জার্মান প্রেসিডেন্ট এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘তার কর্ম জার্মান জাতির ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য প্রতিবিম্ব এবং আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে থাকবে।’ জার্মান নীতিবোধের বিবেক হিসেবে খ্যাত গুন্টার গ্রাসের প্রথম উপন্যাস ‘দ্য টিন ড্রাম’ (১৯৫৯) প্রকাশের মধ্য দিয়ে বিশ্বসাহিত্যে তিনি তাঁর প্রবল আবির্ভাবের ঘোষণা দেন। এ উপন্যাস তাঁকে পৃথিবীজুড়ে ব্যাপক পরিচিতি এনে দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত উপন্যাস দ্য টিন ড্রাম তাঁকে পৌঁছে দেয় খ্যাতির চূড়ায়। জীবদ্দশায় তিনি বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কারে সম্মানিত হন। সাহিত্যে সবচেয়ে গৌরবময় নোবেল পুরস্কার পান ১৯৯৯ সালে। পুরস্কারটি দেয়ার সময় সুইডিশ এ্যাকাডেমির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, গুন্টার গ্রাস তাঁর সাহিত্যে নিপুণ হাতে ‘ইতিহাসের বিস্মৃত মুখচ্ছবি’ এঁকেছেন। গুন্টার গ্রাসের জীবনও উপন্যাসোপম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। মার্কিন সেনাদের হাতে ধরা পড়ে ১৯৪৪ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত প্রায় দুই বছর তিনি বন্দী ছিলেন। পরে মুক্তি পেয়ে তিনি খামার শ্রমিকের কাজ করেন। পরবর্তীকালে তিনি চিত্রকলা নিয়ে পড়াশোনা করেন ডুসেলডর্ফ ও বার্লিনে। ২০০৬ সালে ইউরোপবাসীকে গুন্টার গ্রাস জানান যে, তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি বাফেন এসএস বাহিনীর সদস্য ছিলেন। বাস্তবতা হলো ওই ঐতিহাসিক কালপর্বে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা রাখার মতো বয়স ছিল না। তিনি কোন মানবতাবিরোধী ভূমিকাও রাখেননি। তবু জার্মানবাসীর কাছে দুঃখ প্রকাশ করে গেছেন। তাঁর ভেতরে সবসময় সত্যসন্ধানী ও প্রতিবাদী মনোভাব কাজ করে গেছে। আগ্রাসনবাদী ইসরাইল সরকারের বিরুদ্ধে কবিতা লিখেও সমালোচিত হতে হয়েছে তাঁকে। গুন্টার গ্রাস দুইবার ঢাকায় এসেছিলেন। ১৯৮৬ সালে প্রথমবার এসে তিনি পুরান ঢাকার বিস্তীর্ণ এলাকা পায়ে হেঁটে প্রত্যক্ষ করেন। এরপর ঢাকায় আসেন ২০০১ সালে। প্রথমবার তাঁর বাংলাদেশ সফরের সময় স্ত্রী উটে গ্রাসও তাঁর সঙ্গে ছিলেন। সে সময় জাতীয় জাদুঘরে জয়নুল আবেদিনের ছবি দেখে তিনি মুগ্ধ হন। লালবাগের কেল্লা ঘুরে দেখেন। এ ছাড়া মোহাম্মদপুরে বিহারী ক্যাম্প দেখতে যান। গ্রামের কুমার, তাঁতি এবং শহরের বস্তিবাসীদের জীবন তিনি খুব কাছে থেকে দেখেন। দিনপঞ্জিতে সেসব অভিজ্ঞতার বিবরণ তিনি লিখেছেন। সেই সময় তিনি বাংলাদেশের লেখকদের রচনায় আরও বেশি করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন তুলে ধরার অনুরোধ জানান। বাংলাদেশের অকৃত্রিম এই বন্ধুকে হারানোর বিষয়টি বেদনার। বিশ্বসাহিত্যে তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর অবিস্মরণীয় সাহিত্য সৃষ্টির জন্য।
×