ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নববর্ষে গণজাগরণ মঞ্চের শতাধিক সদস্যের সফর

রাষ্ট্রকে সোহাগপুরের বিধবাদের দায়িত্ব নেয়ার দাবি

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ১৬ এপ্রিল ২০১৫

রাষ্ট্রকে সোহাগপুরের বিধবাদের দায়িত্ব নেয়ার দাবি

রফিকুল ইসলাম আধার, শেরপুর থেকে ॥ এবার রাষ্ট্রের কাছে শেরপুরের সোহাগপুরের সেই বিধবাদের দায়িত্ব নেয়ার দাবি জানিয়েছেন যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ডাঃ ইমরান এইচ সরকার। ১৪ এপ্রিল মঙ্গলবার সোহাগপুর এলাকায় সেই বিধবাদের সঙ্গে অন্যরকম নববর্ষ উদযাপন অনুষ্ঠানে ডাঃ ইমরান ওই দাবি জানান। মুক্তিযুদ্ধে ত্যাগ স্বীকারকারী প্রত্যেকটি জেলা, উপজেলা ও গ্রামকে মডেল হিসেবে গড়ে তুলতেও দাবি জানান তিনি। ডাঃ ইমরান এইচ সরকার সোহাগপুর গ্রামটির দৈন্যদশা দেখে হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, স্বাধীনতা অর্জনের পরেই স্বাধীনতা যুদ্ধে ত্যাগ স্বীকার করা মানুষের দায়িত্ব নেয়া উচিত ছিল রাষ্ট্রের। এতদিন নেয়া হয়নি, এখন নিতে হবে। তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে যে সমস্ত জেলা কলঙ্কমুক্ত করা হচ্ছেÑ সে সমস্ত জেলা, উপজেলা ও গ্রামকে দারিদ্র্যমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক মডেল জেলা, উপজেলা ও গ্রাম হিসেবে গড়ে তোলা হোক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, সোহাগপুরের বিধবা মায়েরা তার কাছে আকুতি জানিয়েছেন, জীবন সায়াহ্নেহ্ন এসে তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাদের দুর্বিষহ জীবনের কথাগুলো বলে মরতে চান। আশা করি প্রধানমন্ত্রী তাদের ওই ইচ্ছেটা পূরণ করবেন। তিনি এলাকার সংসদ সদস্য কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, আপনার চেষ্টাতেই সোহাগপুরের বিধবারা বেঁচে থাকার ন্যূনতম সুযোগ পাচ্ছে। বেসরকারী দুটি প্রতিষ্ঠান ও ইউনিয়ন পরিষদের তরফ থেকে প্রতিমাসে তারা ১৮শ’ টাকা হারে ভাতা পাচ্ছেন। কিন্তু সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী হওয়ার পরও তাঁর বদান্যতায় কোন সরকারী প্রতিষ্ঠান তাদের সহায়তায় এগিয়ে না আসায় তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন। মঙ্গলবার দুপুরে বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী সোহাগপুর বিধবা পল্লীতে পৌঁছেন ডাঃ ইমরান এইচ সরকারের নেতৃত্বে গণজাগরণ মঞ্চের শতাধিক সদস্য। এখানে তাদের বরণ করে নেন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবারের সদস্যসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষ। শহীদ বেদিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ ও প্রার্থনার মধ্য দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠানমালা। তারা একাত্তরের স্বামীহারা বিধবা, শহীদ পরিবারের সন্তানদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান এবং একান্তে সময় কাটান। চলে বিধবাদের সঙ্গে প্রাণ খোলা আলোচনা। সেইসঙ্গে চলে তাদের দুর্বিষহ জীবনের স্মৃতিচারণ। তখন এক আবেগাপ্লুত পরিবেশের সৃষ্টি হয়। ওই সময় পরে ইমরান এইচ সরকার ৩২ জন বিধবার হাতে নববর্ষের বিভিন্ন উপহার এবং জেলা আওয়ামী লীগের ধর্ম সম্পাদক হাজী দুলাল মিয়ার দেয়া ১ হাজার করে টাকা তুলে দেন। দুপুরে বিধবাদের সঙ্গে পান্তা-ইলিশ খেয়ে গণজাগরণ মঞ্চের সদস্যরা কাকরকান্দি মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চে আলোচনা সভায় যোগ দেন। ওই অনুষ্ঠানে হাজারো মানুষের ঢল নামে। ‘কামারুজ্জামানের ফাঁসি, সোহাগপুরের হাসি’ গণজাগরণ মঞ্চের এক সেøাগান কন্যার স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে গোটা এলাকা। উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জিয়াউল হোসেন মাস্টারের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কমান্ডার নুরুল ইসলাম হীরু, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফজলুল হক, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আহ্বায়ক নাজিম উদ্দিন ও ইউপি চেয়ারম্যান শহীদ উল্লাহ তালুকদার মুকুল। উল্লেখ্য, একাত্তরের ২৫ জুলাই ওই গ্রামে আলবদর নেতা কামারুজ্জামানের নির্দেশে ১২০ জন পুরুষকে হত্যা করা হয়। বিধবা হয় তাদের স্ত্রীরা। ৪৪ বছর অপেক্ষার পর সেই কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে। কিন্তু এখনও দুর্বিষহ কষ্টের জীবনের অবসান হয়নি তাদের। উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি গ্রামটিতে। মেলেনি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি। নেয়া হয়নি স্মৃতি সংরক্ষণের তেমন কোন উদ্যোগ। সাক্ষী সুরক্ষা কমিটির জরুরী সভা ॥ কামারুজ্জামানের মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের সুরক্ষায় এক জরুরী সভা হয়েছে শেরপুরে। ১৫ এপ্রিল বুধবার সকালে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষ রজনীগন্ধ্যায় ওই সভা অনুষ্ঠিত হয়। জেলা প্রশাসক ও সাক্ষী সুরক্ষা কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ জাকীর হোসেনের সভাপতিত্বে সভায় পুলিশ সুপার মোঃ মেহেদুল করিমসহ কমিটির অন্যান্য দায়িত্বশীল সদস্য ও শেরপুরে বসবাসকারী রাষ্ট্রপক্ষের ৯ জন সাক্ষী উপস্থিত ছিলেন। সভা শেষে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী জহুরুল হক বীরপ্রতীক (বার), ফকির আব্দুল মান্নান মাস্টার, শহীদ গোলাম মোস্তফার ভাই মোশারফ হোসেন তালুকদার মানিক, কামারুজ্জামানের টর্চারসেলের দারোয়ান ও আত্মস্বীকৃত আলবদর মনোয়ার হোসেন ওরফে মোহন মুন্সী, মজিবর রহমান পানু, সোহাগপুর শহীদ পরিবার কল্যাণ সমিতির সভাপতি জালাল উদ্দিন, করফুলি বেওয়া, হাফিজা বেওয়া ও হাসেন বানু বেরিয়ে এলে তারা মুখোমুখি হন স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মীদের। ওইসময় তারা কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকরের পাশাপাশি তাদের নিরাপত্তায় সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর তৎপরতায় সন্তোষ প্রকাশ করেন। সেইসঙ্গে তারা ঘাপটি মেরে থাকা ঘাতক চক্রের হামলে পড়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করে তাদের প্রতি নিরাপত্তা তৎপরতা আরও বাড়ানোসহ দ্রুত অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি কার্যকরের দাবি জানান। অন্যদিকে সাক্ষী সুরক্ষা কমিটির সভা প্রসঙ্গে শেরপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, সদ্য কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় সাক্ষী সুরক্ষা কমিটির ওই জরুরী সভা করা হয়েছে। সভায় উপস্থিত রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীরা তাদের নিরাপত্তার বিষয়ে সন্তুষ্টির কথাই প্রকাশ করেছেন। এর পরও দায়িত্বশীল সকল মহলের তরফ থেকে তাদের নিরাপত্তার বিষয়ে অধিকতর খেয়াল রাখা হচ্ছে । সাক্ষী মোহন মুন্সীর মৃত্যুর গুজব ॥ রাষ্ট্রপক্ষের অন্যতম প্রধান সাক্ষী, কামারুজ্জামানের টর্চারসেলের দারোয়ান ও আত্মস্বীকৃত আলবদর সদস্য মনোয়ার হোসেন ওরফে মোহন মুন্সী মারা গেছেনÑ বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন মঙ্গলবার এমন গুজবটি ছিল শেরপুরে ‘টক অব দি টাউন।’ ওইদিন ভোর থেকেই শহরে চাউর হয়ে প্রচার হতে থাকে সাক্ষী মোহন মুন্সী মারা গেছেন, কোথাও বা আরও একটু বাড়িয়ে বলা হয়েছে মোহন মুন্সী কাচা ল্যাট্রিনে পড়ে মারা গেছেন। ওই প্রচার শুনে সকাল থেকেই মোহন মুন্সীর শহরের বাগরাকসা মহল্লার বাসায় উৎসুক মানুষের ভিড় শুরু হয়। নিজ বাড়িতে মোহন মুন্সী বহাল তবিয়তে থাকলেও এবং যারা বাড়িতে গিয়ে কিংবা তার আত্মীয়স্বজনদের মাধ্যমে তার বেচে থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হলেও ওই গুজব না থেমে ডালপালা ছড়াতেই থাকে। ফলে বিষয়টি গড়ায় স্থানীয় প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী পর্যন্ত। ওই বিষয়ে তৎপরতা বাড়ে তাদেরও। ওই গুজবের বিষয়ে ১৫ এপ্রিল বুধবার দুপুরে মোহন মুন্সী জনকণ্ঠকে বলেন, আমার ওস্তাদ (কামারুজ্জামান) মরছে ফাঁসিতে, আর আমি এহন বয়স অইছেÑ আল্লায় নিলে তো ভালই অয়। কিন্তু আল্লায় নিওনের আগেই যারা ওই গুজব ছড়াইয়া মানুষেরে বিভ্রান্ত করতাছে, তারা ওস্তাদেরই রক্তের মানুষ। অগোর সম্পর্কে সকলেরই সজাগ থাহনের দরকার আছে। কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় এবং তাদের নিরাপত্তায় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর তৎপরতায় সন্তোষ প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, আমার নিরাপত্তায় দুইজন লোক নিয়োগ দেয়া অইলেও বোরকা পইরা হাতে-পায়ে মোজা লাগাইয়া প্রায়ই কিছু মহিলা বাসায় ঢুইকা পড়ে, আমারে দেখবার অছিলায়। অগোরেও সন্দেহ অয়। কিন্তু অরা মহিলা অওয়ায় পুরুষ লোক চেক দেয় কেমনে?
×