ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ওয়াহিদ নবি

অতঃপর উনি বাড়ি ফিরলেন

প্রকাশিত: ০৩:৩২, ১৬ এপ্রিল ২০১৫

অতঃপর উনি বাড়ি ফিরলেন

উনি প্রথমে আদালতে গেলেন, কৌঁসুলি আর বিচারকের মিষ্টি কথা শুনলেন, জামিন পেলেন আর তারপর ভাড়াটে বাড়িতে ফিরলেন। তাঁর সঙ্গে সাংবাদিক, ফটোগ্রাফার এবং আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। উনি বড় গাড়িতে চড়ে গেলেন। গাড়িটি ধরে কারা যেন দৌড়াতে দৌড়াতে গেল। উনার পরনে স্বভাবসিদ্ধ ‘সি থ্রু’ রঙিন শাড়ি। চোখে রঙিন বড় চশমা। সুবিন্যস্ত চুল। সব মিলে একটা উৎসবের পরিবেশ। অথচ তিনি যাচ্ছিলেন আদালতে। দুর্নীতির অভিযোগে। অসহায় অনাথদের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে। অনেকে বলবেন অভিযোগ তো প্রমাণিত হয়নি; কিন্তু ওই জাতীয় অভিযোগের জন্য আদালতে যাওয়া একটা উৎসবমুখর পরিবেশে? দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বিখ্যাত উক্তি ‘সত্যি সেলুকাস কি বিচিত্র এই দেশ’। ব্যান্ড পার্টি থাকলেই ষোলোকলা পূর্ণ হতো। সত্যি বিচিত্র দেশ। অনেক কিছুই আমাদের মোটা মাথায় ঢোকে না। আদালতে গুরুতর অভিযোগ। আদালতে যাওয়া না যাওয়া অভিযুক্তের মর্জির ওপর নির্ভরশীল। অভিযুক্ত ইচ্ছা করলে আদালতে যেতেও পারেন আবার নাও পারেন। অবশ্য আমাদের জানা নেই সব অভিযুক্তের বেলা এ কথা খাটে কিনা! ভিআইপি অভিযুক্তরা হয়ত এমন সুবিধা পেয়ে থাকেন। হয়ত শুধু ভিআইপি হলে চলে না। ঢাকা বিমানবন্দরে দেখি ‘ভিভিআইপি’ সাইনবোর্ড। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের অবলোকন কত সত্যি। ভিভিআইপি হলে মামলার দিন বহুবার দেয়া হয়। শুনেছি আদালতে হাজির না হওয়ার অজুহাত হিসেবে হরতালের কথা বলা হয়েছে। নিজের ডাকা হরতাল। শ্যামা সঙ্গীতের বাণী- ‘দোষ কারো নয় গো মা, স্বখাত সলিলে ডুবে মরি শ্যামা’ এখানে উল্টো দিকে প্রবাহিত হয়েছে। দিগি¦জয়ের পর তিনি বাড়ি ফিরলেন। কেউ কেউ ভাড়া করা বাড়িকে বাড়ি বলতে চান না। তাঁরা বলেন বাসা। সে যাই হোক, তিনি বাড়ি ফিরলেন। আগেই বলেছি আমাদের মোটা মাথায় অনেক কিছুই ঢোকে না। কেন তিনি বাড়ি ছেড়েছিলেন? বাড়িওয়ালা বাড়ি থেকে আন্দোলন করতে দেবেন না, তাই? বাড়িওয়ালার কয়টা ঘাড়ে কয়টা মাথা? ১৩-১৪ সালের আন্দোলনের সময় তিনি বাড়িতেই ছিলেন। এবার তবে কী হলো? পত্রিকায় পড়েছিলাম তাঁর বাড়িভাড়া নাকি ৫ লাখ টাকা। কোথা থেকে এত টাকা আসে- এ কথা জিজ্ঞেস করব না। অনেকেই রোষ কষায়িত নেত্রে আমার দিকে তাকিয়ে বলবেন- ‘উনি দুইবারের প্রধানমন্ত্রী।’ টাকা পয়সা, ঘরবাড়ি ইত্যাদির ব্যাপার-স্যাপার মোটা মাথায় ঢোকে না। ছেঁড়া গেঞ্জি আর ভাঙ্গা বাক্সের উত্তরাধিকারিণী দশ লাখ টাকার মালিক। প্রশ্ন উঠামাত্র বিচারপতি সাহেব বললেন ‘আমি দিয়েছি’। সরকারী টাকা ইচ্ছামতো এঁরা যাকে ইচ্ছা দিতে পারেন। আবার এরশাদ সাহেব একটা বাড়ি তাঁকে দিয়েদিলেন। আপোসহীন নেত্রী যাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলন করে ‘আপসহীন নেত্রী’ হলেন তাঁর কাছে থেকে একটা বাড়ি নিয়ে নিলেন? আগেই বলেছি মোটা মাথায় অনেক কিছুই ঢোকে না। তিনি স্বৈরাচারী এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন। দুই সেনাশাসক ক্ষমতা দখল করেছিলেন। একজন স্বৈরাচারী আর একজন বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক! সত্যি সেলুকাস কি বিচিত্র এই দেশ। ’১৩-’১৪ সালের আন্দোলনে মানুষ মরেছে অনেক। এই মানুষগুলো রাজনৈতিক মানুষ ছিল না। এরা দিনে এনে দিনে খায়। কাজে না গেলে পরিবারসহ উপোস করতে হয়। কাজের খোঁজে ওরা বেরিয়ে ছিল আর তারপর না ফেরার দেশে তাদের পাঠানো হয়েছে। ক্ষমতার যূপকাষ্ঠে তাদের বলি দেয়া হয়েছে। পুড়ে গিয়ে অত্যন্ত বেদনাদায়ক মৃত্যু তাদের বরণ করতে হয়েছে। যাঁরা তাদের বলি দিয়েছেন তাঁরা নাকি গণতান্ত্রিক রাজনীতি করেন। তাঁরা নির্বাচনের সময় ভোট চান। ভোট দেয় ওই সব মানুষ যাদের অনেকে পুড়ে মরেছে। অনেক টাকার উৎপাদন নষ্ট হয়েছে। উৎপাদিত দ্রব্য যানবাহনের অভাবে পচে গেছে। পড়াশোনার ক্ষতি হয়েছে। অফিস-আদালতের কাজ চলেনি। এসব ক্ষতির মাসুল বহুদিন ধরে জাতিকে দিতে হবে। যানবাহন ভাঙ্গা আর পোড়ানো হয়েছে। রেললাইন উপড়ে ফেলা হয়েছে। হাজার হাজার গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। এই বিপুল ক্ষতি কাদের হয়েছে? ক্ষতি হয়েছে জাতির। এ কথা অনেকে বুঝেও বুঝেন না। কারা চালালো এই তাণ্ডব? বয়সের কারণে সাময়িক উত্তেজনার বসে কিশোররা কি এসব করেছে? বাহ্যত তাই মনে হয়। কিন্তু নীতিনির্ধারকরা এর জন্য সম্পূর্ণরূপে দায়ী। এ কথা যাঁরা স্বীকার করেন না, তাঁদের অনুরোধ নুরেমবার্গ বিচারের ইতিহাস আর একবার পড়ে দেখুন। এই তাণ্ডব সৃষ্টি করে তাণ্ডব সৃষ্টিকারীরা কী পেয়েছেন? এ কথা তাঁরা ভেবেছেন কিনা জানি না। এ বছর আবার একই খেলা শুরু করলেন উনি। বাড়ি ছেড়ে কার্যালয়ে এসে ‘অবরোধের ডাক দিলেন তিনি। কিন্তু অবরোধকারীরা কোথায়? দলের কর্মীরা নেই, নেতারাও নেই। এর বদলে শুরু হলো অগ্নিকা-। পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ। ৩ মাসে সোয়া শ’ মানুষ পুড়ে মরলো। এর মধ্যে ছিল শিশু ও নারী। বার্ন ইউনিটের ভয়াবহ দৃশ্য যারা দেখেছেন তাঁরা কি জীবনে এই নৃশংসতা ভুলতে পারবেন? আবার সেই ভাঙ্গা, পোড়ানো; সেই তাণ্ডব। ৩ মাস পর উনি বাড়ি ফিরলেন। ফেরার আগে আদালত ঘুরে গেলেন। তাঁর অনুসারীরা কোথায় জানি না। তাঁরা উনার বাড়ি ফেরাকে কিভাবে নিলেন জানি না। সত্যি বলতে কী জানতে চাই না। নিশ্চয়ই তাঁদের বলা হচ্ছে এটা একটা কৌশল। দ্রুতই আবার সরকার পতনের আন্দোলন শুরু করা হবে, যেমন এবার করা হয়েছিল। এমন তো হতেই পারে যদি না জনগণের জানমাল রক্ষার জন্য দায়ী ব্যক্তিরা কিছু করেন। শতাধিক মানুষের মৃত্যুর জন্য কেউ না কেউ অবশ্যই দায়ী। এই মৃত্যু আর ধ্বংস রাজনৈতিক কর্মকা- নয়। এটা নির্জলা অপরাধ। এতবড় অপরাধে যারা অপরাধী তারা যদি শাস্তি না পায়, তবে তারা উৎসাহিত হবে নিশ্চয়ই আবার এসব অপরাধ সংঘটিত করতে। এসব বিশাল অপরাধ প্রতিরোধ না করলে সমাজ বিশৃঙ্খল হয়ে পড়বে। লেখক : রয়াল কলেজ অফ সাইকিয়াট্রিস্টের একজন ফেলো।
×