ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

চৈত্র সংক্রান্তিতে সংস্কৃতি অঙ্গন উৎসবমুখর

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ১৪ এপ্রিল ২০১৫

চৈত্র সংক্রান্তিতে সংস্কৃতি  অঙ্গন উৎসবমুখর

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ নদীর স্রোতের মতোই সময় বহমান। সেই সময়ের সিঁড়ি বেয়ে শেষ হলো আরও একটি বাংলা বছর। আগামীর পথে ছুটে চলার প্রত্যয়ে মহাকালের অতল গহ্বরে হারিয়ে গেল বঙ্গাব্দ ১৪২১। সেই সূত্রে সোমবার ছিল ১৪২১ বঙ্গাব্দের শেষ দিন ত্রিশে চৈত্র। হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী বাংলা সংস্কৃতির রীতিমাফিক চৈত্র সংক্রান্তি। নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে বাংলা সনের সমাপনী মাস চৈত্রের শেষ দিন চৈত্র সংক্রান্তিকে ঘিরে বাঙালীর রয়েছে নানা আচার-অনুষ্ঠান। কালক্রমে ধর্মভিত্তিক আচার থেকে উৎসবে রূপ পাওয়া দিনটিকে ঘিরে হয়ে থাকে নানা আয়োজন। পুরনো বছরের জীর্ণতাকে বিদায় দিয়ে নতুন বছরের প্রাপ্তির প্রত্যাশা উঠে আসে সেসব আয়োজনে। এক সময়ের গ্রামীণ এই লোকাচার এখন ঠাঁই করে নিয়েছে শহুরে নাগরিক জীবনে। শিকড় সন্ধানী নাগরিক মন ঐতিহ্যের আবাহনে শামিল হয় চৈত্র সংক্রান্তি উদ্যাপনে। তাই তো চৈত্র সংক্রান্তিতে রাজধানীর নানা প্রান্তের সংস্কৃতির অঙ্গনে ছিল উৎসবমুখর রকমারি বর্ণিল আয়োজন। নৃত্য-গীত, কবিতা ও কথায় সাজানো হয় এসব অনুষ্ঠান। কোথাও বা উন্মুক্ত আকাশে বর্ণিল ঘুড়ি উড়িয়ে বিদায় জানানো হয় বছরের শেষ দিনটিকে। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের উন্মুক্ত চত্বরে পুরনো বছরকে বিদায় জানিয়ে যৌথভাবে চৈত্র সংক্রান্তির আয়োজন করে সুরের ধারা ও চ্যানেল আই। বাংলা শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে চৈত্র সংক্রান্তি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে শিল্পকলা একাডেমি ও গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন। বাংলা বছরের শেষ দিনকে ঘিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীদেরও ছিল সাংস্কৃতিক আয়োজন। জাতীয় জাদুঘরে সূচনা হয়েছে তিন দিনের পিঠা উৎসব ও কারুশিল্প মেলা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় বসেছিল লোকগানের আসর। সুরের ধারা ও চ্যানেল আইয়ের আয়োজন ॥ রাজধানীর চৈত্র সংক্রান্তির সবচেয়ে আকর্ষণীয় অনুষ্ঠানটি হয় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে। যৌথভাবে চতুর্থবারের মতো বর্ষবিদায়ের এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে সঙ্গীত সংগঠন সুরের ধারা ও চ্যানেল আই। বছরের শেষ দিনের সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় এ চৈত্রসংক্রান্তির বিশেষ আয়োজন। গানের সুরে সুরে তুলে ধরা হয় বাংলার ইতিহাস ঐতিহ্যে ও সংস্কৃতিকে। পঞ্চকবির গানের পরিবেশনার মাধ্যমে সূচনা করা হয় অনুষ্ঠানের। সন্ধ্যা ছয়টায় শুরু হয়ে টানা চলে রাত ১২টা পর্যন্ত। সঙ্গীতানুষ্ঠানের পাশাপাশি আয়োজন করা হয় পঞ্চকবিকে নিয়ে আলোচনা ও লোকজ সংস্কৃতির মেলা। ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে’, ‘ধন ধান্য পুষ্পভরা’, ‘মায়ের দেয়া মোটা কাপড়’, ‘কারার ওই লৌহ কপাট’ গানসহ পঞ্চকবির লেখা জনপ্রিয় পাঁচটি গানের সমন্বয়ে সঙ্গীত কোলাজ পরিবেশনের মাধ্যমে বর্ষবিদায় অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। কোলাজ গানের পরিবেশনাটিতে অংশ নেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার নেতৃত্বে সুরের ধারার শিক্ষার্থী শিল্পীরা। ছিল শিক্ষকদেরও পরিবেশনা। রাত ১২টা পর্যন্ত চলমান অনুষ্ঠানে ৭১টি গান পরিবেশন করেন শিল্পীরা। সম্মেলক গানের পাশাপাশি একক গান পরিবেশন করেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, তপন চৌধুরী, সুমন চৌধুরীসহ অনেকে। গানের ফাঁকে ফাঁকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে আলোচনা করেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে শামসুজ্জামান খান, দ্বিজেন্দ্র লাল রায় সম্পর্কে আসাদ চৌধুরী, রজনীকান্ত সেন সম্পর্কে করুণাময় গোস্বামী ও অতুল প্রসাদ সেন প্রসঙ্গে কথা বলেন বিশ^জিৎ ঘোষ। অনুষ্ঠানের শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন সুরের ধারার সভাপতি রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। তিনি একাধিক গান পরিবেশন করেন। রাত ১২টা এক মিনিটে ‘ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলো’ গানটি পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় সুরের ধারার বর্ষবিদায় অনুষ্ঠান। একই স্থানে রাত সাড়ে ১২টা থেকে ছিল বাউল গানের আসর। বাউল গান পরিবেশন করেন শফি ম-ল, ডলার বাউল, ফকির শাহাবুদ্দীন, দেওয়ান শফিউর রহমান, বিশ^জিৎ রায়, সিঁথি সিনথিয়া প্রমুখ। শিল্পকলার উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে ঘুড়ি উৎসব ॥ ‘মঙ্গল হোক এই শতকে মঙ্গল সবার’ সেøাগানে চৈত্র সংক্রান্তি ও বর্ষবরণের আয়োজন করেছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। সোমবার বিকেল থেকে শুরু হয় চৈত্র সংক্রান্তির অনুষ্ঠান। এ অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে আয়োজন করা হয় ঘুড়ি উৎসব, ঘুড়ি প্রদর্শনী ও আল্পনা কর্মশালা। ঘুড়ি ফেডারেশনের সহযোগিতায় দারুণ রূপ পায় ঘুড়ি উৎসব। বিকেলে একাডেমির নন্দন মঞ্চে ওড়ানো হয় নানা আকার-আকৃতির রকমারি ঘুড়ি। একাডেমির সঙ্গীত ও নৃত্যকলা মিলনায়তনের লবিতে অনুষ্ঠিত হয় ঘুড় প্রদর্শনী। চোখ জুড়িয়ে যাওয়া নানা অবয়বের বর্ণিল ঘুড়ি দিয়ে সাজানো হয় প্রদর্শনী। মাছ ঘুড়ি, হাতি ঘুড়ি, বাদুর ঘুড়ি, মৎস্য কুমারী ঘুড়ি, ঈগল ঘুড়ি কিংবা মৌচাকের আকৃতি নেয়া ঘুড়িÑএমন কয়েক শতাধিক রকমারি অবয়বের ঘুড়ি দেখতে ভিড় জমে দর্শনার্থীদের। এছাড়া অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে একাডেমির জাতীয় চিত্রশালা প্লাজায় ছিল তিন দিনের আল্পনা কর্মশালার সমাপনী অনুষ্ঠান। এদিন কর্মশালায় অংশ নেয়া ১৬৩ জন প্রশিক্ষণার্থীর হাতে তুলে দেয়া হয় সনদপত্র। জাদুঘরে পিঠা কারুশিল্প মেলা ॥ ঐতিহ্যবাহী নকশীকাঁথা, পাটের তৈরি হাঁড়ি-পাতিল, ব্যাগ, ম্যাট, পাপোশ, বাঁশের কুলা, মাটির তৈরি রঙবেরঙের পুতুল, পিতলের গহনা, রঙিন মুখোশ, জামদানি শাড়িসহ বাঙালী সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ঐতিহ্যবাহী নকশী পিঠার সম্ভার নিয়ে জাতীয় জাদুঘর প্রাঙ্গণে সোমবার থেকে শুরু হয়েছে ‘পিঠা ও কারুশিল্প মেলা’। বাংলা বছর ১৪২১ বিদায় ও নতুন বছর ১৪২২ বরণ উপলক্ষে এ মেলার আয়োজন করেছে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর। বিকেলে তিন দিনব্যাপী এ মেলার উদ্বোধন করেন জাতীয় জাদুঘরের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সভাপতি এম আজিজুর রহমান। মেলা উদ্বোধনের সময় তিনি বলেন, বাঙালীর হাজার বছরের সংস্কৃতির ঐতিহ্য প্রায় বিলীন হতে বসেছে। কোন এক সময়ে চৈত্র সংক্রান্তি ও বাংলা নববর্ষকে বাঙালীরা বিশেষ এক ক্রিয়া-কলাপের মধ্যদিয়ে উদ্যাপন করত। কালের স্রোতে এ ঐহিত্যকে আমরা হারাতে বসেছি। আমাদের উচিত এটাকে ধরে রাখা ও এর পৃষ্ঠপোষকতা করা। ফিতা কেটে মেলা উদ্বোধনের পর তিনি বিভিন্ন স্টল ঘুরে ঘুরে দেখেন। মেলায় মোট ২৩টি স্টল রয়েছে। মেলা চলবে আগামীকাল বুধবার সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত। আজ মঙ্গলবার সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা এবং আগামীকাল সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা আয়োজন ॥ বর্ণাঢ্য আয়োজনে চৈত্র সংক্রান্তি উদ্যাপন করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় সোমবার বিকেলে। অনুষদের শিক্ষার্থীদের নাচে-গানে বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সরব হয়ে ওঠে পুরো অনুষ্ঠান স্থল। চারুকলা অনুষদ আয়োজিত এ উৎসবে গানের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের তত্ত্বাবধানে ঐতিহ্যবাহী পুতুল নাচ এক ভিন্ন মাত্র এনে দেয়। ‘ময়না ছলাৎ ছলাৎ চলেরে’ লোক গানের সঙ্গে দলীয় নৃত্য পরিবেশনের মধ্যদিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। এরপর ছাত্রছাত্রীদের পরিবশেনায় শুরু হয় রবীন্দ্রসঙ্গীত ও নজরুলসঙ্গীত। পরে আবারও দলীয় নৃত্য। সন্ধ্যায় প্রদীপ প্রজ্ব¡লনের মধ্যদিয়ে বাংলা বছর ১৪২১কে বিদায় জানানো হয়। পরে শুরু হয় পুতুল নাচ। এতে তুলেধরা হয় বাঙালীর লোকজ ঐতিহ্যের বিভিন্ন কাহিনীর অংশবিশেষ। এরপর মাদারীপুরের অন্ধ বাউল শিল্পী ওমর আলীর একক পরিবেশনায় ছিল বাউল গান। সবশেষে দেশীয় যন্ত্রসঙ্গীত সহযোগে লোকগান পরিবেশন করে গান পাগল ও জলের গানের দল। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটম-লে চৈত্র সংক্রান্তি ও চার দিনব্যাপী বৈশাখ উদ্যাপন অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধন হয় সোমবার সন্ধ্যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার এ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগ আয়োজিত এ অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। বিশেষ অতিথি ছিলেন কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মোঃ কামাল উদ্দীন ও অধ্যাপক ড. শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম। সভাপতিত্ব করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার এ্যান্ড পারফরম্যান্স বিভাগের চেয়ারম্যান সুদীপ চক্রবর্তী। সব শেষে মঞ্চস্থ হয় পদ্মপুরাণ অবলম্বনে নির্মিত নাটক চম্পকনগরের উপকথা। গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের আয়োজন ॥ সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমির পরীক্ষণ থিয়েটার হলে যৌথভাবে চৈত্র সংক্রান্তির অনুষ্ঠানের আয়োজন করে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন ও শিল্পকলা একাডেমি। প্রদীপ প্রজ্ব¡লনের মাধ্যমে অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডা. মঞ্জুুরুল হাসান খান। নৃত্য-গীত ও কবিতায় সাজানো হয় আয়োজনটি। সঙ্গে ছিল ঐতিহ্যবাহী সঙযাত্রা। অনুষ্ঠানে সম্মেলক কণ্ঠে গান শোনান ঢাকার প্রধান ৩৫টি নাট্যদলের ৭০ জন নাট্যশিল্পী। পরিবেশিত হয় বিভিন্ন নাটকের গান। নৃত্যের সঙ্গে ছিল চমৎকার কোরিওগ্রাফি। নৃত্য পরিবেশন করে নৃত্যাঞ্চলের শিল্পীরা। সুমধুর সুর ছড়িয়ে সরোদ বাজিয়ে শোনান ওস্তাদ শাহাদাৎ হোসেন খান। এছাড়াও ছিল আবৃত্তি। কবিতার দোলায়িত ছন্দে একক কণ্ঠে আবৃত্তি পরিবেশন করেন আশরাফুল আলম, ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় ও হাসান আরিফ। আয়োজনের অন্যতম আকর্ষণ ছিল সঙযাত্রা। টাঙ্গাইলের ‘বাদাইম্যা’ নামের দলটি পরিবেশন করে সঙযাত্রা। শিশু একাডেমি ॥ বিকেলে বাংলাদেশ শিশু একাডেমির গ্রন্থাগার ভবনের লেকচার থিয়েটার হলে চৈত্র সংক্রান্তি ১৪২১ বঙ্গাব্দ উদযাপন করা হয়। শিশুদের নৃত্য-গীতের বর্ণিল সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় সাজানো হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি। বিশেষ অতিথি ছিলেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক সচিব আ.ই.ম গোলাম কিবরিয়া এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক যুগ্ম-সচিব তাহমিনা বেগম। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ শিশু একাডেমির পরিচালক মোশাররফ হোসেন।
×