ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

যশোর উদীচীর বর্ষবরণ

দুই দিনের বর্ণাঢ্য আয়োজন

প্রকাশিত: ০৪:১৫, ১৪ এপ্রিল ২০১৫

দুই দিনের বর্ণাঢ্য আয়োজন

স্টাফ রিপোর্টার, যশোর অফিস ॥ কবির ভাষায় ‘নতুন বছর, নতুন স্বপ্ন, নতুন কিছু বলা, নতুন সকাল নতুন আলো নতুন পথচলা।’ নতুন আলো, নতুন ভোর, নতুন দিন, নতুন উচ্ছ্বাস আর নতুন সম্ভাবনার নতুন বারতা সঙ্গে নতুনভাবে বেঁচে থাকার নতুন প্রত্যয়। তাই নতুনকে স্বাগত জানাতে আবহমান বাংলার ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় বর্ষবরণ উৎসব আমেজে প্রস্তুত হচ্ছে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আপামর বাঙালী। বাংলার আকাশ-বাতাসে নববর্ষের আগমনী সুর। দিকে দিকে শুধু নতুনের জয়গান। এরই মাঝে নতুন দিনের নতুন সম্ভাবনা নিয়ে প্রতি মুহূর্তে এগিয়ে আসছে বঙ্গাব্দ ১৪২২। আর কালের গর্ভে ধীরে ধীরে বিলীনের পথে এগিয়ে চলেছে ১৪২১। মধ্যে সময় মাত্র আর কয়েক প্রহর। তারপর জরা-জীর্ণ ছিন্ন করে পুরাতনকে বিদায় জানিয়ে নতুনের আবাহন। সারাদেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বর্ষবরণে বিগত ৩৯ বছর ধরে পৌর উদ্যানে বর্ণিল ও বৈচিত্র্যময় উপস্থাপনায় যশোরবাসীকে সৃষ্টিশীল আনন্দে মাতোয়ারা করছে যশোরে এ উৎসবের পথিকৃৎ উদীচী, যশোর। বর্ষবরণ উৎসবের চারদশক পূর্তিতে দু’দিনব্যাপী ব্যতিক্রমী নানা আয়োজনে এবারও তার ব্যত্যয় ঘটবে না বলে আয়োজকদের আশা। ‘মুক্ত মনের আলোকে-আঁধার কাটুক পলকে’Ñ সমস্ত অশুভকে দূরে ঠেলে নতুন দিনের প্রত্যাশায় বাংলা নববর্ষের প্রথম সূর্যোদয়ের পরপরই ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ যশোরবাসীকে উৎসবে মাতাতে চায় উদীচী। এ সংগঠন বিগত ৩৯ বছরের ধারাবাহিকতার দৃষ্টান্ত রাখতে এবারও আয়োজন করেছে একটানা চার ঘণ্টা চমক দেয়া জমকালো মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। নববর্ষ উৎসব অনুষ্ঠানকে মনোমুগ্ধকর করতে বিগত দুই মাস ধরে চলছে ব্যাপক প্রস্তুতি। সারাক্ষণ ব্যস্ত সংগঠনের নিবেদিতপ্রাণ বিশাল কর্মীবাহিনী। মহড়ায় ব্যস্ত প্রায় সাড়ে তিনশ’ শিশু-কিশোর-বড় সঙ্গীত, নৃত্য ও অভিনয় শিল্পী। শহরসহ সংগঠন চত্বর রঙ-তুলির আঁচড়ে রঙিন নান্দনিক আল্পনায় রাঙাতে ব্যস্ত চিত্রশিল্পীরা। শহরের গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে শোভা পাচ্ছে রঙিন প্রচার আল্পনা। যেখানে উদীচীর সব অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে যশোরবাসীকে। যা শহরকে করেছে বর্ণিল। এখন অপেক্ষা শুধু সেই মধুক্ষণের; বলার অপেক্ষা ‘শুভ নববর্ষ’। উদীচী যশোরের পক্ষ থেকে বর্ষবরণে দু’দিনব্যাপী উৎসবের প্রথম দিন হবে বরাবরের মতো পৌর উদ্যানে এবং দ্বিতীয় দিন হবে যশোরের ঐতিহাসিক টাউন হল ময়দানের রওশন আলী মঞ্চে। এছাড়া বৈশাখী উৎসবকে বর্ণিল করতে উদীচীর সব সদস্য পরবের নিজস্ব নক্সার পোশাক। সেদিন সংগঠনের সব শিশুরা পরবে একই ধরনের উৎসব রঙের জামা, কিশোরীরা পরবে লাল সাদা জামা, মেয়েরা পরবে কোরা রঙের ওপর আল্পনায় নকশা করা শাড়ি, ছেলেরা পরবে লাল-সাদা পাঞ্জাবি। পৌর উদ্যানে যশোরবাসীকে মাতাতে এবারও সকাল ৬টা ৩১মিনিট থেকে ১০টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত ৪ ঘণ্টার মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপহার দেবে উদীচী, যশোর। দৃষ্টিনন্দন ভিন্নমাত্রার রূপকমঞ্চে অনুষ্ঠান উপস্থাপনে বিগত চার দশকের অনুষ্ঠান সন্নিবেশিত করে সাজানো চারপর্বের অনুষ্ঠানের শুরুতে ভৈরবী রাগের তান দিয়ে শুরু হবে নববর্ষের আবাহন। এরপর বিগত চারদশকের ওপর পরিবেশনা শেষে এবারের বিশেষ উপস্থাপনা অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূর্তপ্রতীক সাধক পুরুষ মরমী কবি লালন শাহের সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী চেতনার ওপর ভিত্তি করে গীতিনৃত্য আলেখ্য উপস্থাপন করা হবে। শেষপর্বে উৎসব অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানমালায় থাকছে লোকজ-গণসঙ্গীত, যে গানে থাকবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, সত্যেন সেন ও হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গান। থাকবে দেশীয় ও ভারতীয় জনপ্রিয় বাংলা গান, থাকবে দেশাত্মবোধকসহ রবীন্দ্র, নজরুল, দিজেন্দ্র লাল রায়, রজনীকান্ত, রাধারমন, লালন, হাছনরাজা, শাহ আব্দুল করিম, বিজয় সরকার, পান্থ শাহের গান। এছাড়া শিশুদের ছড়া আবৃত্তি, বড়দের আবৃত্তি, সমবেত নৃত্য। উদীচীর ঐতিহ্য অনুযায়ী বরাবরের মতো থাকছে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় রচিত ঐতিহাসিক যাত্রাপালা ‘সিরাজ-উদ-দ্দৌলা’। যার নির্দেশনায় রয়েছেন আব্দুল আফ্ফান ভিক্টর। বৈশাখী উৎসবে যশোর পৌর উদ্যানে উদীচীর ৪০তম উৎসব মঞ্চে এসে যশোরবাসীকে শুভেচ্ছা জানাবেন একুশের পদকপ্রাপ্ত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংগঠক কামাল লোহানী, জেলা প্রশাসক ডক্টর হুমায়ুন কবীর, পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ভাষা-সংস্কৃতি স্বাধিকার আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক রতন বসু মজুমদার প্রমুখ। উদীচীর পহেলা বৈশাখের এ অনুষ্ঠান স্থানীয় সিটি ক্যাবল সরাসরি সম্প্রচার করবে। দ্বিতীয় দিন টাউন হল ময়দানে দেশের বিভিন্ন আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা বাউল শিল্পীদের নিয়ে পরিবেশনায় লোক সঙ্গীত। এ অনুষ্ঠানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় বাউলশিল্পী শুভেন্দু মাইতি সঙ্গীত পরিবেশনা করবেন। আমন্ত্রণপত্রে বৈচিত্র্য শিল্পী মনের সৃষ্টিশীলতার অনুপম নিদর্শন যশোরের বৈশাখী আয়োজনের অন্যতম অনুষঙ্গ নববর্ষের আমন্ত্রণপত্র। প্রতিবছরই যশোরের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো তাদের শৈল্পিক মনের দৃষ্টিনন্দন ব্যতিক্রমী নিমন্ত্রণপত্রে আমন্ত্রণ জানায় অতিথিবর্গকে। যশোরের এ ঐতিহ্য ধরে এবারও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। বৈচিত্রময় আমন্ত্রণপত্র তৈরির নীরব প্রতিযোগিতার মানসে রঙ তুলির আঁচড়ে হরেক রকম আমন্ত্রণপত্র তৈরিতে তাই বিন্দুমাত্র কার্পণ্য নেই যশোরের প্রায় সবগুলো সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্তাব্যক্তি ও নিবেদিতপ্রাণ কর্মীদের। হারিয়ে যাওয়া বাঙালী সংস্কৃতির ঐতিহ্য নবপ্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে কে কাকে ছাড়িয়ে যাবে এ যেন এক আবেগময় প্রতিযোগিতা। তাইতো মাটির টানে ফিরে যেতে দেশীয় নানা উপকরণের সংমিশ্রণে আবহমান গ্রাম বাংলার চিরায়ত দৃশ্যের শৈল্পিক উপস্থাপনার আমন্ত্রণপত্র যশোরসহ দেশব্যাপী ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। ইতোমধ্যে এ নান্দনিক আমন্ত্রণপত্র পৌঁছে গেছে অতিথিদের মাঝে। উদীচী যশোর তাদের আমন্ত্রণপত্রে এবার বাঙালী জীবনের অন্যতম অনুষঙ্গ ‘মাছ ও মাছ ধরা পলো ওখলুই’ দিয়ে আমন্ত্রণ জানিয়েছে তাদের অতিথিবর্গকে। নড়াইলে তিন দিনব্যাপী লোকজমেলা নিজস্ব সংবাদদাতা, নড়াইল থেকে জানান, বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ উপলক্ষে নড়াইলে কলাগাছে চড়া, হাড়িভাঙ্গা, বালিশবদল, বেলুন ফাটানো, ঝরাপাতা-ঝরাফুল ও চিত্রাঙ্কনসহ তিন দিনব্যাপী গ্রামীণমেলা শুরু হয়েছে। সোমবার দুপুরে নড়াইলের লোহাগড়ার আমাদা আদর্শ কলেজ চত্বরে মেলার উদ্বোধন করা হয়। কলেজ পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ও লোহাগড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সিকদার আব্দুল হান্নান রুনুর সভাপতিত্বে লোকজমেলায় উপস্থিত ছিলেন সংসদ সদস্য শেখ হাফিজুর রহমান, লোহাগড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ ফয়জুল আমির লিটু, লোহাগড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোকতার হোসেন, আমাদা আদর্শ কলেজের অধ্যক্ষ আল ফয়সাল খান, মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শহিদুর রহমান, লোহাগড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শেখ লুৎফর রহমান প্রমুখ। এর আগে সকালে শিশুদের অংশগ্রহণে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। শিশুদের রঙতুলির আঁচড়ে পহেলা বৈশাখের নান্দনিকতাসহ নদ-নদী, প্রকৃতিসহ নানান আবহ ফুটে ওঠে। আমাদা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থী সাদিয়া জানায়, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে খুব ভাল লাগছে। এমন উৎসবমুখর পরিবেশ আগে কখন সৃষ্টি হয়নি। চতুর্থ শ্রেণীর নিশাত বলে, রঙতুলিতে পহেলা বৈশাখের আগমনী বার্তা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। রামিম হোসেন জানায়, এমন একটি উৎসব সত্যিই আনন্দের। বর্ষবিদায় ও বরণের এই আনন্দ-উৎসবে ছোটদের পাশাপাশি বড়দের মাঝেও ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা লক্ষ্য করা গেছে। উৎসবে পুরুষদের জন্য কলাগাছে চড়া ও হাঁড়িভাঙ্গা এবং স্কুল-কলেজ পড়ুয়া মেয়েদের জন্য বালিশ বিতরণ, ঝরাপাতা-ঝরাফুল ও বেলুন ফাটানো প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। আমাদা আদর্শ কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্র আজমল হোসাইন বলেন, আমি হাঁড়িভাঙ্গা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছি। হাঁড়ি ভাঙ্গতে না পারলেও খুব আনন্দ পেয়েছি। লোহাগড়ার আমাদা গ্রামের সুরুজ শেখ বলেন, খেলায় প্রথম পুরস্কার জিতেছি। করিম বলেন, কলাগাছে চড়া অনেক মজার। বালিশবদল খেলায় অংশগ্রহণকারী সাথী খানম, মাছুরা খাতুন, ফাতেমা, লায়লা সাথী, শান্তা ইসলাম, সীমা পারভীন বলেন, এ খেলায় আমরা মেয়ে অংশ নিয়েছি। একাদশ শ্রেণীর মাছুরা বলেন, বেলুন ফাটানো খেলাটিও অনেক আনন্দের। সবাই বেলুন লুকিয়ে রাখতে চেষ্টা করেন, তবে সহজে রক্ষা পাওয়া যায় না। অধ্যক্ষ আল ফয়সাল খান বলেন, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, কৃষক-শ্রমিক, শিশু-কিশোরসহ বিভিন্ন পেশার মানুষের মিলনমেলায় উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয় গ্রামীণমেলায়। গলাচিপায় ছয় দিনের কর্মসূচী স্টাফ রিপোর্টার গলাচিপা থেকে জানান, সোমবার সন্ধ্যায় চৈত্র সংক্রান্তিতে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন, কবিতা পাঠ ও মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে পটুয়াখালীর গলাচিপায় ছয় দিনব্যাপী বাংলা বর্ষবরণের বর্ণাঢ্য কর্মসূচী শুরু হয়েছে। এর আগে বিকেলে স্থানীয় বালুরমাঠে বাংলার আবহমান ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। বর্ষবরণের অন্য কর্মসূচীর মধ্যে মঙ্গলবার বেলা ৯টায় স্বাধীনতা বিরোধীদের প্রতি ঘৃণা জানিয়ে বের হবে মঙ্গল শোভাযাত্রা। এর আগে সকাল ৮টায় আড়ম্বরপূর্ণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন বছর বরণ করে নেয়া হবে। বেলা এগারোটায় রামনাবাদ নদীতে অনুষ্ঠিত হবে নৌকাবাইচ। বিকেলে রয়েছে হা-ডু-ডু প্রতিযোগিতা। অন্যান্য দিনেও রয়েছে লাঠিখেলার মতো বিভিন্ন ধরনের ঐতিহ্যবাহী উৎসবের আয়োজন। বাংলাদেশ-তুরস্ক স্কুল মাঠে বসবে পুরো ছয় দিনব্যাপী মেলা। এছাড়া, প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও নাটক।
×