ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ফুল বিজু পালন তিন পার্বত্য জেলায় বৈসাবি শুরু ॥ আনন্দে উত্তাল পাহাড়

প্রকাশিত: ০৬:২১, ১৩ এপ্রিল ২০১৫

ফুল বিজু পালন তিন পার্বত্য জেলায় বৈসাবি শুরু ॥ আনন্দে উত্তাল পাহাড়

নিজস্ব সংবাদদাতা, খাগড়াছড়ি/ রাঙ্গামাটি ॥ নদীতে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে পার্বত্য তিন জেলায় শুরু হয়েছে বৈসাবি উৎসব (বৈসু, সাংগ্রাই ও বিজু)। রবিবার ছিল এ উৎসবের প্রথম দিন অর্থাৎ ফুল বিজু। খাগড়াছড়ি চেঙ্গী নদীতে আদিবাসী তরুণ-তরুণীরা ভোরে নদীর জলে দেবতাদের উদ্দেশে ফুল ভাসিয়ে পরিবার ও জাতির জন্য মঙ্গল কামনা করে প্রার্থনার মধ্য দিয়ে এ উৎসবের সূচনা করে। ফুল বিজু কেন্দ্র করে নদীর পাড় হাজারো তরুণ-তরুণীর মিলনমেলায় পরিণত হয়। পাহাড়ী সম্প্রদায়ের তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরী, ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা দল বেঁধে ফুল তুলে গঙ্গা দেবীর উদ্দেশে নদী-খালে ফুল ভাসিয়ে পুরাতন বছরের গ্লানি মুছে নতুন বছরের শুভ কামনায় নিজেদের পবিত্রতা কামনা করে। বর্ষবরণ ও বিদায় অনুষ্ঠানকে ঘিরে নতুন সাজে সেজেছে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিটি পাহাড়ী জনপদ। সব পাপাচার ও গ্লানি ধুয়ে মুছে নিতে খাগড়াছড়িতে আদিবাসী সম্প্রদায়ের তিন দিনব্যাপী বৈসাবি উৎসব শুরু হয়েছে। বাংলা বছরের শেষ দু’দিন এবং নতুন বছরের প্রথম দিন মূলত বর্ষবরণ উৎসব পালিত হয়। খাগড়াছড়িতে এবার বৈসাবি উৎসব পালিত হচ্ছে ব্যাপক আনন্দ-উল্লাসের মাধ্যমে। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ করায় বৈসাবি উৎসবের আনন্দে পাহাড়ীরা মাতোয়ারা হয়ে ওঠে। সঙ্গে বাঙালী জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের ফলে এ অনুষ্ঠানটি হয়ে ওঠে সম্প্রীতির এক সেতুবন্ধন। বৈসাবি উপলক্ষে কিছু কিছু চাকমা গ্রামে চাকমা চারণকবিদের (গেংগুলিদের) পালাগানের আয়োজন করা হয়। ত্রিপুরা সম্প্রদায়ও তাদের গ্রামে আয়োজন করে গড়াইয়া নৃত্য। পাহাড়ীরা বৈসাবি উৎসব তিনটি ভাগে পালন করে থাকে। প্রথম দিনটির নাম ফুল বিজু। এদিন শিশু-কিশোররা ফুল তুলে ঘর সাজায়। দ্বিতীয় দিনটি মূল বিজু। এ দিনটি হচ্ছে মূল অনুষ্ঠান। এদিন নানা ধরনের তরকারি রান্না করে থাকে। এর নাম পাচন, এটি বৈসাবির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের পিঠা ও মিষ্টান্নও তৈরি করা হয়। অতিথিদের জন্য এদিন ঘরের দরজা থাকে সবার জন্য খোলা। ফুল বিজুর দিন পাহাড়ীরা ভোরে ঘুম থেকে উঠে নদী বা ছড়ায় গোসল করার আগে পানিতে ফুল ভাসিয়ে দিয়ে গঙ্গা বা গঙ্গা পূজা করে। এরপর বড়রা বাড়িঘর ও আঙিনায় সোনা-রূপার পানি দিয়ে বাড়ির আসবাবপত্র পরিষ্কার করে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা বিভিন্ন ফুল দিয়ে বাড়িঘর সাজায়। সন্ধ্যায় বাড়ির আঙিনায়, গোয়াল ঘরে এবং নদীর ঘাটে সারি সারি মোমবাতি জ্বালানোর মধ্য দিয়ে বৈসাবির প্রথম দিনের কাজ সম্পন্ন হয়। বৈসাবির দ্বিতীয় দিনে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে মোরগ-মুরগিকে খাওয়ানোর জন্য চাল ছিটিয়ে দেয়। কনিষ্ঠরা বয়োঃজ্যেষ্ঠদের পায়ে সালাম করে আশীর্বাদ নেয়। এদিন সবার বাড়ির দ্বার সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে। প্রত্যেক বাড়িতে সারাদিন খানাপিনা চলে। পাহাড়ীদের তৈরি বিভিন্ন ধরনের পিঠা, তিলের নাডু, মিষ্টি, সেমাই, কমপক্ষে পাঁচ প্রকার আনাজপাতি দিয়ে রান্না করা পাচন প্রত্যেক বাড়ি খেতে দেয়া হয়। এছাড়া পাহাড়ী মদ এক চোয়ানি দুচোয়ানি বাদিকাবা এবং চিনিকলে তৈরি অপরিশোধিত মিষ্টি মদ তৈরি করে। এদিন যুবক-যুবতীরা দল বেঁধে এবং বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি, এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে রং মেখে গান গেয়ে ঘুরে বেড়ায়। বৈসাবির তৃতীয় দিন বা নববর্ষে পাহাড়ীরা সকালে মন্দিরে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করেন। গ্রামের লোকজনকে ভাল ভাল খাবার খেতে দেয় অথবা বাড়িতে গিয়ে দিয়ে আসে। বিকেলে আবার মন্দিরে গিয়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে পূজা করে। এভাবেই পাহাড়িরা আনন্দ-উৎসব সাংসারিক সামাজিক, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের মধ্য দিয়ে বৈসাবির মাধ্যমে পুরাতন বছরকে বিদায় জানায় এবং নতুন বছরকে বরণ করে নেয়। রাঙ্গামাটিতে বৈসাবি শুরু ॥ কাপ্তাই হ্রদে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায় শুরু হয়েছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বৈসাবি উৎসবের মূল আনুষ্ঠানিকতা। রবিবার সকালে রাঙ্গামাটি শহরের গর্জনতলী এলাকায় ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের লোকজন কাপ্তাই হ্রদে ফুল ভাসিয়ে তাদের প্রাণের উৎসব বৈসু শুরু করেন। এর মধ্য দিয়ে পুরানো বছরের সকল দুঃখ গ্লানি মুছে যাবেÑ এমনটাই বিশ্বাস করেন ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের লোকজন। ফুল ভাসানোর পর অনুষ্ঠিত হয় বয়স্ক ¯œান, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সোমবার মূল বিজুতে চলবে অতিথি আপ্যায়ন। ঘরে ঘরে রান্না করা হবে পাহাড়ীদের ঐতিহ্যবাহী পাচন তরকারি ও তৈরি হবে ঐতিহ্যবাহী পিঠা। ইতোমধ্যে গৃহিণীরা শুরু করেছেন ঘর সাজানোর কাজ। প্রধানত বিজু ফুল দিয়ে ঘর সাজানো হবে। এছাড়াও থাকবে নানা আনুষ্ঠানিকতা।
×