ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

১৪২১ এর শেষ সূর্যাস্ত আজ

প্রকাশিত: ০৬:১২, ১৩ এপ্রিল ২০১৫

১৪২১ এর শেষ সূর্যাস্ত  আজ

মোরসালিন মিজান ॥ সবই একদিন পুরনো হয়। গত হয়। সুখ, পাওয়া, না পাওয়া, পেয়ে হারানোর বিষ ব্যথা স্মৃতি হয় একদিন। খুব মনে রাখবার যা, মনে থাকে না। বিদায় জানাতে হয় এমনকি প্রিয় মানুষকে। প্রিয় সময়কে বিদায় জানাতে হয়। পুরনো হয় মাস। বছর। অমোঘ এই নিয়তি মেনে পুরনো হয়েছে আরও একটি বছর। ১৪২১ বঙ্গাব্দের শেষ দিন ৩০ চৈত্র আজ। আজ সোমবার বাঙালীর বর্ষ বিদায়ের বিশেষ দিবস চৈত্রসংক্রান্তি। আবহমান কাল থেকে নানা লোকাচার ও উৎসব অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দিনটি উদ্যাপন করে আসছে বাংলাদেশের মানুষ। মূল আয়োজন গ্রামে হলেও নগর সংস্কৃতিতে এর যথেষ্ট কদর। শেকড় সন্ধানী মানুষ বর্ণাঢ্য আয়োজনে উদ্যাপন করবে চৈত্রসংক্রান্তি। বিদায় জানাবে জীর্ণ পুরাতনকে। বিগত দিনের গ্লানি ভুলে আজ ১৪২২ বঙ্গাব্দকে স্বাগত জানানোর বর্ণাঢ্য প্রস্তুতি নেবে গোটা দেশ। সংক্রান্তি কথাটি ব্যাখ্যা করলে দাঁড়ায়Ñ এক ক্রান্তি থেকে আরেক ক্রান্তিতে যাওয়া। কিংবা বলা যায়, এক কিনারা থেকে আরেক কিনারায় পৌঁছানো। ক্রান্তির সঞ্চার। ক্রান্তির ব্যপ্তি। সূর্যসহ বিভিন্ন গ্রহের এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে গমন। মহাকালের অনাদি ও অশেষের মাঝে ঋতু বদল করতে করতে এগিয়ে চলা। বর্ষ বিদায়ের এ দিনটি লোকজ সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ। ধর্ম বর্ণ নির্বিশিষে সকলেই উদ্যাপন করে থাকেন। গ্রামের ঘরে ঘরে চলে বর্ষ বিদায়ের আনুষ্ঠানিকতা। সনাতন প্রথা অনুসারীরা চৈত্রসংক্রান্তিকে গ্রহণ করেন পুণ্যের দিন হিসেবে। পঞ্জিকা মতে, দিনটি মহাবিষুব সংক্রান্তি। বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী এই দিনে মহা আনন্দে মাতে। পাহাড়ে পাহাড়ে চলে বর্ণাঢ্য উৎসব আয়োজন। চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে গ্রামের নারীরা মাটির ঘরদোর লেপা-পোছা করেন। এমনকি গোয়ালঘরটি পরিষ্কার করা হয়। সকালে গরুর গা ধুয়ে দেয় রাখাল। ঘরে ঘরে বিশেষ রান্না হয়। উন্নতমানের খাবার ছাড়াও তৈরি করা হয় নকশি পিঠা, পায়েস, নারকেলের নাড়ু। দিনভর চলে খাওয়া দাওয়া। প্রিয়জন পরিজনকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানো হয়। অতীতে গ্রামের গৃহস্থরা নতুন জামা কাপড় পরতেন। নাতি-নাতনিসহ মেয়েজামাইকে সমাদর করে বাড়ি নিয়ে আসতেন। তাঁদের জন্যও থাকত নানা উপহার সামগ্রী। চৈত্রসংক্রান্তির দিন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা শাস্ত্র মেনে স্নান, দান, ব্রত, উপবাস করে কাটান। নিজ নিজ বিশ্বাস অনুযায়ী অন্য ধর্মাবলম্বীরাও নানা আচার অনুষ্ঠান পালন করেন। ফোকলোরবিদদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চৈত্র মাসে স্বামী সংসার কৃষি ব্যবসার মঙ্গল কামনায় লোকাচারে বিশ্বাসী নারীরা ব্রত পালন করতেন। এ সময় আমিষ নিষিদ্ধ থাকত। থাকত নিরামিষ, শাকসবজি আর সাত রকমের তিতো খাবারের ব্যবস্থা। বাড়ির আশপাশ বিল খাল থেকে শাক তুলে রান্না করতেন গৃহিণীরা। এই চাষ না করা, কুড়িয়ে পাওয়া শাক ক্ষেতে বাগানে বেশি বেশি পাওয়া গেলে বিশ্বাস করা হতোÑ সারা বছরের কৃষি কর্ম ঠিক ছিল। মানুষ, তার চারপাশের প্রকৃতি ও প্রাণগুলোর আপন হয়েছিল কৃষি। একই কারণে নতুন বছর নিয়ে দারুণ আশাবাদী হয়ে উঠতেন তাঁরা। চৈত্রসংক্রান্তির মেলা খুব আকর্ষণীয় হয়ে থাকে। এ সময় দেশের বিভিন্ন এলাকায় চড়ক উৎসবের আয়োজন করা হয়। চৈত্র মাসজুড়ে সনাতন ধর্মাবলম্বী সন্ন্যাসীরা উপবাস, ভিক্ষান্নভোজনসহ নানা নিয়ম পালন করেন। সংক্রান্তির দিন তাঁরা শূলফোঁড়া, বাণফোঁড়া ও বড়শিগাঁথা অবস্থায় চড়ক গাছে ঝোলেন। পাখির মতো শূন্যে ওড়ে বেড়ান। গাছের চার পাশে ঘোরেন। হাজার হাজার মানুষ তা উপভোগ করেন। যে গ্রামটিতে আয়োজন, সে গ্রামের আশপাশের, এমনকি দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন চড়ক উৎসবে দেখতে আসেন। এখানেই শেষ নয়, সন্ন্যাসীরা আগুনের ওপর দিয়ে খালি পায়ে হাঁটেন! ভয়ঙ্কর ও কষ্টসাধ্য শারীরিক কসরত বটে। তবে এর সঙ্গে ততধিক আনন্দ যোগ হয়েছে। চৈত্রসংক্রান্তিতে চলে গাজনের মেলা। মেলার সঙ্গে বিভিন্ন পৌরাণিক ও লৌকিক দেবতার নাম সম্পৃক্ত। যেমনÑ শিবের গাজন, ধর্মের গাজন, নীলের গাজন ইত্যাদি। এ উৎসবের মূল লক্ষ্য সূর্য এবং তার পতœীরূপে কল্পিত পৃথিবী। সূর্যের সঙ্গে পৃথিবীর বিয়ে দেয়াই এ উৎসবের উদ্দেশ্য। গাজন উৎসবের পেছনে কৃষক সমাজের একটি সনাতন বিশ্বাস ক্রিয়া করে। ধারণা করা হয়, চৈত্র থেকে বর্ষার প্রারম্ভ পর্যন্ত সূর্য যখন প্রচ- উত্তপ্ত থাকে তখন সূর্যের তেজ প্রশমন ও বৃষ্টি লাভের আশায় অতীতে কোন এক সময় কৃষিজীবী সমাজ এ অনুষ্ঠানের উদ্ভাবন করেছিল। গাজনের মেলা ছাড়াও যুগ যুগ ধরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে চৈত্রসংক্রান্তির মেলা। মেলায় মাটি, বাঁশ, বেত, প্লাস্টিক ও ধাতুর তৈরি বিভিন্ন ধরনের তৈজসপত্র ও খেলনা ইত্যাদি বিক্রি হয়। বিভিন্ন প্রকার খাবার, মিষ্টি, দই পাওয়া যায়। এক সময় মেলার বিশেষ আকর্ষণ ছিল বায়স্কোপ, সার্কাস ও পুতুল নাচ। এসব আকর্ষণে দূর গ্রামের দুরন্ত ছেলেমেয়েরাও মেলায় যাওয়ার বায়না ধরত। এ সময় হালখাতার জন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সাজানো, লাঠিখেলা, গান, আবৃত্তি, সঙযাত্রা, রায়বেশে নৃত্য, শোভাযাত্রাসহ নানা অনুষ্ঠান আয়োজন করা হতো। বর্তমানে এসব আচার অনুষ্ঠানের অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে। ধরন পাল্টিয়েছে কোন কোনটি। তবে চৈত্রসংক্রান্তি উদ্যাপন থেমে থাকেনি। বরং নতুন নতুন উপাদান এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। প্রতিবারের ন্যায় এবারও নানা আয়োজনে চৈত্রসংক্রান্তি উৎসব উদ্যাপন করবে বাঙালী। সারাদেশে থাকবে উৎসব অনুষ্ঠান। আজ সোমবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে চৈত্রসংক্রান্তির বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজন করবে সঙ্গীত সংগঠন সুরের ধারা। চ্যানেল আইয়ের সহায়তায় চতুর্থবারের মতো বর্ষ বিদায়ের এ অনুষ্ঠান আয়োজন করা হচ্ছে। আয়োজকরা জানান, বর্ষ বিদায়ের আনুষ্ঠানিকতা নয় শুধু, বাংলার ইতিহাস ঐতিহ্যে ও সংস্কৃতিকে বিশ্ব দরবারে আরও ব্যাপকভাবে তুলে ধরার লক্ষ্যে এই প্রয়াস। সূর্যাস্তের সময় পঞ্চকবির গানের মধ্য দিয়ে সূচনা করা হবে অনুষ্ঠানের। চলবে রাত ১২টা পর্যন্ত। আয়োজন করা হবে লোকজ সংস্কৃতির মেলা। এবারের উৎসবের স্থিরচিত্র ধারণ করবে দৃকের প্রায় ১০০ জন আলোকচিত্রী। গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় শিল্পকলা একাডেমির পরীক্ষণ থিয়েটার হলে আয়োজন করবে চৈত্রসংক্রান্তির অনুষ্ঠান। প্রদ্বীপ জ্বালিয়ে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করবেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডাঃ কামরুল হাসান। আয়োজকদের পক্ষে নাট্যজন ঝুনা চৌধুরী জানান, চৈত্রসংক্রান্তি উৎসবে ঢাকার প্রধান ৩৫টি নাট্যদলের ৭০ জন নাট্যশিল্পী সমবেত কণ্ঠে গান করবেন। থাকবে নাচ ও চমৎকার কোরিওগ্রাফি। অনুষ্ঠানে সরোদ বাজাবেন ওস্তাদ শাহাদাৎ হোসেন খান। বাউল গান, নাটকের গান থাকবে অনুষ্ঠানে। একক গান পরিবেশন করবেন জনপ্রিয় শিল্পীরা। এছাড়াও থাকবে আবৃত্তি। তবে আয়োজনের আকর্ষণীয় অংশটিÑ সঙযাত্রা। টাঙ্গাইলের ‘বাদাম্যা’ নামের একটি দল অংশ নেবে সঙযাত্রায়। বিকেলে জাতীয় জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে আয়োজন করা হবে চৈত্রসংক্রান্তি উৎসবের। উৎসবের আহ্বায়ক ড. আবুল আজাদ জানান, আয়োজনের পুরোটা জুড়ে থাকবে লোকজ সংস্কৃতির নানা দিক নিয়ে আলোচনা, গান ও কবিতা পাঠ। অনুষ্ঠানসূচী অনুযায়ী, বিকেল তিনটায় উদ্বোধন করা হবে পটুয়া নাজির হোসেনের পটচিত্র প্রদর্শনী। চৈত্রসংক্রান্তি বিষয়ে আলোচনা করবেন আনু মাহমুদ। কবিয়াল বিজয় সরকারের উপর আলোচনা করবেন আইয়ুব হোসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে নাটম-ল প্রাঙ্গণে সন্ধ্যায় আয়োজন করা হবে চৈত্রসংক্রান্তি উৎসবের। চার দিনব্যাপী আয়োজনের প্রথম দিন থাকবে বর্ষ বিদায়ের আনুষ্ঠানিকতা। জাতীয় জাদুঘর প্রাঙ্গণে আয়োজন করা হবে পিঠা উৎসব ও কারুশিল্প মেলার। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের উদ্যোগে চৈত্রসংক্রান্তি উৎসব উদ্যাপন করা হবে।
×