ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

শেরপুরে আনন্দ মিছিল, মিষ্টি বিতরণ

প্রকাশিত: ০৬:১১, ১৩ এপ্রিল ২০১৫

শেরপুরে আনন্দ মিছিল, মিষ্টি  বিতরণ

স্টাফ রিপোর্টার/নিজস্ব সংবাদদাতা, শেরপুর ॥ কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামানের মৃত্যুদ- কার্যকরের পর র‌্যাব-পুলিশের পাহারায় শেরপুরের পৈত্রিক এলাকায়ই দাফন করা হয়েছে। শনিবার রাত ১০টা ৩০ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের পুরাতন ফাঁসির মঞ্চে ঘৃণিত এই যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়। তার আগেই শেরপুর সদর উপজেলার বাজিতখিলা ইউনিয়নে এই জামায়াত নেতার দাফনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল। জেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে তার ভাই কফিল উদ্দিন কবর খুঁড়ে রেখেছিলেন। এদিকে, একাত্তরের এই আলবদর কমান্ডারের মৃত্যুদ- কার্যকর হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছে বিভিন্ন মহল। শেরপুরের বিধবা পল্লীর বিধবা ও তাদের স্বজনদের মধ্যেও ফিরেছে স্বস্তি। মিষ্টি বিতরণ হয়েছে শেরপুরসহ বিভিন্ন অঞ্চলে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা আনন্দ মিছিলও করেছে। শনিবার রাত সাড়ে ১০টায় ফাঁসিতে ঝোলানোর পর ময়নাতদন্তসহ আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া সেরে এক ঘণ্টা পর লাশবাহী এ্যাম্বুলেন্স বের হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ফটক দিয়ে। এটি র‌্যাব-পুলিশের নয়টি গাড়ির পাহারায় সড়কপথে নিয়ে যাওয়া হয় শেরপুরে। লাশের এ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ডেপুটি জেলার আখেরুল ইসলাম রাসেলও শেরপুরে যান। বহরের প্রথমে ছিল র‌্যাবের একটি গাড়ি। এরপর পুলিশের কয়েকটি গাড়ির পর ছিল দুটি এ্যাম্বুলেন্স। এরপর পুলিশের আরেকটি গাড়ির শেষেও ছিল র‌্যাবের একটি গাড়ি। স্ত্রী, পাঁচ ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে ঢাকার মিরপুরের সাংবাদিক কলোনিতে থাকত জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামান। কুখ্যাত এই যুদ্ধাপরাধীকে দাফন করতে তার পরিবারের কেউ শেরপুরে যাননি। তার পৈত্রিক বাড়িতে থাকেন ভাইয়েরা। কামারুজ্জামানের বড় ভাই কফিল উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, বাজিতখিলা মাদ্রাসা ও এতিমখানার পাশে দাফনের ইচ্ছা জানিয়েছিলেন তার ভাই। মৃত্যুদ- কার্যকরের পর রাত সাড়ে ১০টায় কুমরি বাজিতখিলা মাদ্রাসার পাশে জমিতে কবর খোঁড়ার কাজ শুরু হয় বলে সদর থানার ওসি মাজহারুল করিম জানিয়েছিলেন। ভোর সোয়া ৪টায় লাশবাহী এ্যাম্বুলেন্স পৌঁছে কামারুজ্জামানের পৈত্রিক বাড়িতে। সেখানে ভাই কফিল উদ্দিন লাশ গ্রহণ করেন। পরে পারিবারিক উদ্যোগে কুমরি মাদ্রাসা ও এতিমখানা মাদ্রাসা মাঠে জানাজা হয়, যাতে অর্ধ শতাধিক মানুষ অংশ নেন। এরপর ভোর সোয়া ৫টার দিকে কামারুজ্জামানকে দাফন করা হয় বলে ওসি মাজহারুল জানান। কফিল উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, শান্তিপূর্ণভাবে কামারুজ্জামানের লাশ হস্তান্তর এবং জানাজা ও কবর দেয়ার জন্য জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের কাছে অনুমতি নেন তারা। এই যুদ্ধাপরাধীকে কবরের জায়গা না দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন শেরপুরের মুক্তিযোদ্ধারা, যার মধ্যে কামারুজ্জামানের স্ত্রীর এক ভাইও ছিলেন। তবে পরে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে আলোচনার পর তারা কামারুজ্জামানের দাফন প্রতিরোধের ওই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন। এদিকে কামারুজ্জামানের দ- কার্যকরের আগে থেকে শেরপুরে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। শেরপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাকীর হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। র‌্যাবের পাশাপাশি দুই প্লাটুন বিজিবি সদস্য শেরপুরের বিভিন্ন এলাকায় টহলে ছিল। শেরপুর শহরের সজবরখিলা এলাকায় জামায়াত কার্যালয়টি ছিল বন্ধ। বিধবা ও তাদের স্বজনদের স্বস্তি ॥ ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাইয়ের গণহত্যায় স্বামী, ভাসুর, দুই চাচা, দুই চাচাত ভাই ও বোনজামাইসহ ৭ স্বজনকে হারিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী ও শহীদ ইব্রাহিমের স্ত্রী হাফিজা বেওয়া (৬২)। হাফিজা বলেন, ‘টাইবোনালে সাক্ষী দেওয়নের পর থাইকা সবসুমু দুশ্চিন্তায় থাকতাম। পাড়া প্রতিবেশীরা ডর দেহাইতো। আল্লার কাছে নামাজ পইড়া দোয়া করতাম, যারা আমগর স্বামী, ভাই, চাচাগরে বিনাপরাধে মারছে, তাগর যেন শাস্তি অয়। কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকরে সন্তোষ প্রকাশ করেন হাফিজা বেওয়া। সোহাগপুর শহীদ পরিবার কল্যাণ সমিতির সভাপতি, রাষ্ট্রপক্ষের অন্যতম সাক্ষী ও শহীদ ছফির উদ্দিনের ছেলে জালাল উদ্দিন বলেন, ‘আমরা বিধবা পল্লীর শহীদ পরিবারের স্বজনরা কামারুজ্জামানের পক্ষের লোকজনের ভয়ে চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় আছি। এরপরও আমরা কুলাঙ্গার কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় বেজায় খুশি। তার ফাঁসি কার্যকরের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৪ বছর যাবত সোহাগপুরের বিধবাদের বুকে চেপে ছিল যে কষ্ট ও যন্ত্রণা, তার আজ চির অবসান হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। মুক্তিযোদ্ধাদের আনন্দ মিছিল ॥ জামায়াতের শীর্ষ নেতা কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় রবিবার সকালে শেরপুর জেলা সদরসহ উপজেলা পর্যায়ে আনন্দ মিছিল করেছেন একাত্তরের রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধারা। সকাল ১১ টায় শহরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয় থেকে জেলা কামান্ডার নুরুল ইসলাম হীরুর নেতৃত্বে মিছিলটি শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে। পরে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে এক সংক্ষিপ্ত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন জেলা কমান্ডার নুরুল ইসলাম হীরু, সদর উপজেলা কমান্ডার এ্যাডভোকেট মোখলেছুর রহমান আকন্দ, তালাপতুফ হোসেন মঞ্জু প্রমুখ। তারা কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় সরকার ও উচ্চ আদালতের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। সেই সঙ্গে তারা দ্রুত অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিষ্পত্তির দাবি জানান। বিভিন্ন মহলের প্রতিক্রিয়া ॥ কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামানের মৃত্যুদ- কার্যকরে সন্তোষ প্রকাশ করেছে বিভিন্ন মহল। বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবু জাফর আহমেদও সন্তোষ প্রকাশ করেন। বদর নেতা কামারুজ্জামানের মৃত্যুদ- কার্যকর হওয়ায় এক প্রতিক্রিয়ায় শেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট চন্দন কুমার পাল পিপি বলেন, কামারুজ্জামানের মৃত্যুদ- কার্যকরের মধ্য দিয়ে এবারও প্রমাণ হলো, আইনের উর্ধে কেউ নন। তার ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় শেরপুরের সোহাগপুরের বিধবারা, শহীদ গোলাম মোস্তফার পরিবার ও নির্যাতনের ক্ষত নিয়ে বেঁচে থাকা অধ্যক্ষ সৈয়দ আব্দুল হান্নানসহ মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজনের মাঝে বিরাট স্বস্তি ফিরে এসেছে। সেই সঙ্গে জাতি আজ অনেকটাই কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। জেলা সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের সভাপতি, মুক্তিযুদ্ধের যুব সংগঠক মোঃ আমজাদ হোসেন বলেন, শহীদ মোস্তফাসহ সোহাগপুরের গণহত্যায় শহীদদের স্বজনরা দীর্ঘ ৪৪ বছর শেরপুরের ‘কুলাঙ্গার’ হিসেবে চিহ্নিত ঘাতক কামারুজ্জামানের শাস্তি দেখার অপেক্ষায় ছিলেন। তার ফাঁসি কার্যকরের মধ্য দিয়ে শহীদদের স্বজনদের প্রতীক্ষার অবসানসহ শেরপুরবাসী চূড়ান্তভাবে কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় সরকার ও উচ্চ আদালতের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কমান্ডার নুরুল ইসলাম হীরু বলেন, সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় জাতির বুকে চেপে থাকা কামারুজ্জামান উপাখ্যানের শেষ হয়েছেÑএটিই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার ও এ আদর্শে বিশ্বাসীদের বিশাল প্রাপ্তি। শেরপুর পৌরসভার মেয়র হুমায়ুন কবীর রুমান বলেন, এর মধ্য দিয়ে ১৭ কোটি মানুষকে দেয়া বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনা সরকারের নির্বাচনী ওয়াদা পূরণ হচ্ছে। একই কথা জানান সদর উপজেলার চেয়ারম্যান ছানুয়ার হোসেন ছানু, জেলা আওয়ামী লীগের মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক সম্পাদক আলহাজ আব্দুল ওয়াদুদ অদু, চেম্বার অব কমার্স সভাপতি মোঃ মাসুদ, সাবেক সভাপতি ও আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান সংগঠনের সভাপতি গোলাম মোঃ কিবরিয়া লিটন, শেরপুর প্রেসক্লাব সভাপতি রফিকুল ইসলাম আধার, জেলা জাসদ সভাপতি মনিরুল ইসলাম লিটন, আত্মস্বীকৃত আলবদর সদস্য কামারুজ্জামানের নির্যাতন সেলের দারোয়ান ও রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী মোহন মুন্সি, সাক্ষী মজিবর রহমান পানু। রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী মজিবর রহমা পানু তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, কামারুজ্জামানের ফাঁসি না হলে আমাকে এবং আমার পরিবারের সদস্যদের মেরে ফেলা হতো। সাক্ষী না দিতে আমাকে ১০ লাখ টাকার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। ৫ লাখ টাকা পকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে বলা হয়েছিল, সাক্ষ্য দিলে লাশ হয়ে যাবে। এমনকি ট্রাইব্যুনালে কামারুজ্জামানের নিযুক্ত আইনজীবীরা পর্যন্ত হত্যার হুমকি দিয়েছিল। আর সাক্ষী মোহন মুন্সী বলেন, আলবদর হয়ে যে পাপ করেছিলাম, কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকরের মধ্য দিয়ে আমার সেই পাপ ও কলঙ্কও চূড়ান্তভাবে মোচন হয়েছে আজ। শহীদ গোলাম মোস্তফার ভাই মোশারফ হোসেন তালুকদার মানিক বলেন, গোলাম মোস্তফাকে ধরে নিয়ে হত্যার দায়ে আপীল বিভাগে কামারুজ্জামানের মৃত্যুদ- রহিত করে যাবজ্জীবন দেয়া হলেও আজ তার ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় বিধবা পল্লীর স্বজনদের মতো আমরাও খুশি ও তৃপ্ত। ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় মনে হচ্ছে, আমার ভাইয়ের রক্ত বৃথা যায়নি।
×