ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

আপীল বিভাগে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় ॥ ৮ যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি

প্রকাশিত: ০৬:০৯, ১৩ এপ্রিল ২০১৫

আপীল বিভাগে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় ॥ ৮ যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি

বিকাশ দত্ত ॥ ট্রাইব্যুনালের দেয়া দণ্ডের বিরুদ্ধে সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আরও ৯টি মামলা রয়েছে। বদর বাহিনীর কমান্ডার মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও মিরপুরের কসাই কাদের মোল্লার দণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। গোলাম আযম, আব্দুল আলীম এই দুই জন মৃত্যুবরণ করায় আপীল বিভাগ তাদের মামলা অকার্যকর ঘোষণা করেছেন। অন্যদিকে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে আপীল বিভাগ দণ্ড কমিয়ে আমৃত্যু করাদণ্ড প্রদান করেছেন। ৫ জন আসামি পলাতক থাকায় ট্রাইব্যুনালের দেয়া দণ্ড বহাল রয়েছে। ট্রাইব্যুনালে ১৭টি মামলায় ১৮ জনকে দণ্ড দেয়া হয়। এর মধ্যে ১১টি মামলা আপীল দায়ের করা হয়। এদিকে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আশা করছেন, এ বছরের মধ্যে বেশ কয়েকটি মামলার নিষ্পত্তি হবে। এ সময় তিনি মামলাগুলোর মধ্যে মুজাহিদ, সাকা চৌধুরী, নিজামী এই তিনজনের মামলার শুনানির কাজ শুরু হবে বলে জানান। অন্যদিকে মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর বিচার করতে আগামী অধিবেশনের শেষভাগে এ সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করা হবে। এমনটিই আভাস দিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। আপীল বিভাগে নিষ্পত্তির জন্য ৯টি মামলার মধ্যে রয়েছে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী, জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, জামায়াতের নির্বাহী কমিটির সদস্য মীর কাশেম আলী, আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত মোঃ মোবারক হোসেন, জাতীয় পর্টির সাবেক মন্ত্রী সৈয়দ মোঃ কায়সার, জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজাহারুল ইসলাম, জামায়াতের নায়েবে আমির আব্দুস সুবহান ও জাতীয় পাটির সাবেক নেতা আব্দুল জব্বার। ইতোমধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আপীল চূড়ান্ত নিষ্পত্তি শেষে জামায়াতের দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমকে ৯০ বছরের কারাদণ্ড ও আব্দুল আলীমকে আমৃত্যু কারাদণ্ড প্রাদান করেন। এই দুই আসামি অসুস্থ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে আপীল বিভাগ তাদের আপীল অকার্যকর ঘোষণা করেছেন। জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদণ্ড প্রদান করলেও সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগে তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড প্রদান করেন। অন্যদিকে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক দণ্ডপ্রাপ্ত ৫ আসামি পলাতক রয়েছেন। পলাতক থাকার কারণে তারা আপীল করতে পারেনি। কাজেই তাদের দণ্ড বহাল রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বাচ্চু রাজাকার হিসেবে পরিচিত আবুল কালাম আজাদ, বুদ্ধিজীবী হত্যার অন্যতম নায়ক আশরাফুজ্জামান খান, চৌধুরী মাঈনুদ্দিন, বিএনপির নেতা জাহিদ হোসেন খোকন ও আব্দুল জব্বার। আব্দুল জব্বারের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল আমৃত্যু করাদণ্ড প্রদান করেন। রাষ্ট্রপক্ষ ঐ দণ্ড বাড়ানোর জন্য সুপ্রীমকোর্টে আপীল করেছেন। মুজাহিদ ॥ জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসানের বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, লুণ্ঠন,অপহরণ, দেশত্যাগে বাধ্য করা ও অগ্নিসংযোগের দায়ে সাতটি অভিযোগের মধ্যে ৫টি প্রমাণিত হওয়ায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২, ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। সাত অভিযোগের পাঁচটি ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে ট্রাইব্যুনালের রায়ে। মধ্যে সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনসহ বুদ্ধিজীবী হত্যা এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর বর্বর হত্যা-নির্যাতনের দায়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ প্রদান করেন ট্রাইব্যুনাল। সাতটি অভিযোগের মধ্যে ২টি অভিযোগ (২ ও ৪) প্রমাণিত না হওয়ায় অভিযোগের দায় থেকে মুজাহিদকে খালাস দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে ৫টি অভিযোগ (১,৩,৫,৬ ও ৭) সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল তাকে ৩ নং অভিযোগে ৫ বছর ও ৫নং অভিযোগ যাবজ্জীবন কারাদ- প্রদান করেছে। ৬ ও ৭নং অভিযোগে মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়েছে। ১নং অভিযোগটি ৬নং অভিযোগের সঙ্গে একীভূত করায় ১নং অভিযোগে পৃথক কোন দণ্ড দেয়া হয়নি। আসামি পক্ষ এ রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের ১১ আগস্ট আপীল করেন। সাকা চৌধুরী ॥ বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল -১ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। তার বিরুদ্ধে হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, নির্যাতন জোর করে ধর্মান্তরিত করাসহ ২৩ অভিযোগের মধ্যে ৯টি অভিযোগ প্রমাণিত হয়। এর মধ্যে চারটি চার্জ ৩, ৫, ৬ ও ৮ নম্বর অভিযোগে হত্যা ও গণহত্যার দায়ে সাকা চৌধুরীকে মৃত্যুদ- দেয়া হয়। ১৭ ও ১৮ নম্বর অভিযোগে অপহরণ ও নির্যাতনের দায়ে ৫ বছর করে ১০ বছর কারাদণ্ড। ২, ৪ ও ৭ নম্বর অভিযোগে হত্যা, গণহত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও দেশান্তরে বাধ্য করার মতো অপরাধে জড়িত থাকা এবং এর পরিকল্পনা করার দায়ে ২০ বছর করে ৬০ বছর কারাদ- দেয়া হয়েছে। আর অপহরণ ও নির্যাতন সংক্রান্ত অভিযোগে আনা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। ১৭ নম্বর অভিযোগে নিজাম উদ্দিন আহম্মেদকে অপহরণ ও নির্যাতন, ১৮ নম্বর অভিযোগে সালেহ উদ্দিন আহমেদকে অপহরণ ও নির্যাতন- এ দুই অভিযোগে সাকাকে দেয়া হয়েছে ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। ২, ৪ ও ৭ নম্বর অভিযোগে তাঁকে দেয়া হয়েছে ২০ বছরের কারাদণ্ড। আর যে সব অভিযোগ থেকে তাঁকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে সেগুলো হলো ১, ১০, ১১, ১২, ১৪, ১৯, ২০ ও ২৩। এ ছাড়াও যে অভিযোগগুলো নিয়ে আদালত কিছু বলেনি সেগুলো হলো ৯, ১৩, ১৫, ১৬, ২১ ও ২২ নম্বর অভিযোগ। মৃত্যুদন্ডের বিরুদ্ধে সাকা ২০১৩ সালের ২৯ অক্টোবর সুপ্রীমকোর্টে আপিল করেন। মতিউর রহমান নিজামী ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনক্সা বাস্তবায়ন, হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন সম্পত্তি ধ্বংস, দেশত্যাগে বাধ্য করায় আলবদর বাহিনীর প্রধান বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সাবেক মন্ত্রী ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায়ে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামীকে ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর ফাঁসির আদেশ দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ১৬টি অভিযোগের মধ্যে ৮টি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। ৪ অভিযোগে তাঁকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ-ের আদেশ দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। অপর ৪টি অভিযোগে তাকে যাবজ্জীন কারাদ- দেয়া হয়েছে। বাকি ৮টি অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাকে খালাস দেয়া হয়েছে। বিচাররপতি চেয়ারম্যান এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুাল-১ এ আদেশ প্রদান করেন। এ রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের ২৩ নবেম্বর নিজামীর আপীল করেন। মীর কাশেম আলী ॥ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আলবদর বাহিনীর তৃতীয় শীর্ষনেতা তৎকালীন ইসলামী ছাত্রসংঘের সাধারণ সম্পাদক, চট্টগ্রামের বাঙালী খান, জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাশেম আলীকে ২০১৪ সালের ২ নবেম্বর ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের রায় প্রদান করেছে ট্রাইব্যুনাল। মীর কাশেম আলীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ১৪টি অভিযোগের মধ্যে হত্যা, অপহরণ নির্যাতনের ১০টি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। দুই অভিযোগের মধ্যে একটিতে সর্বসম্মতিতে আরেকটি সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে তাঁকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেয়া হয়। অপর ৮টি অভিযোগে সর্বমোট ৭২ বছর করাদ- দেয়া হয়েছে। বাকি ৪টি অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাকে খালাস দেয়া হয়েছে। চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহীনের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ আদেশ প্রদান করেন। এ রায়ের বিরুদ্ধে মীর কাশেম আলী ২০১৪ সালের ৩০ নবেম্বর আপীল করেন। খোকন রাজাকার ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের অভিযোগে ফরিদপুরের নগরকান্দা পৌর মেয়র ও পৌর বিএনপির সহসভাপতি পলাতক জাহিদ হোসেন খোকন ওরফে খোকন রাজাকারকে ২০১৪ সালের ১৩ নবেম্বর ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেছে ট্রাইব্যুনাল। খোকনের বিরুদ্ধে আনা ১১টি অভিযোগের মধ্যে ১০টি অভিযোগ প্রমাণিত। এর মধ্যে ছয়টি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড ও চারটি অভিযোগে ৪০ বছর কারাদণ্ড প্রদান করেছে। একটি অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাকে খালাস দেয়া হয়েছে। চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এই রায় প্রদান করেন। মোবারক হোসেন ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীর সাবেক রোকন আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রাজাকার কমান্ডার মোঃ মোবারক হোসেনকে ২০১৪ সালের ২৪ নবেম্বর ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- প্রদান করেছে ট্রাইব্যুনাল। হত্যা, গণহত্যা, অপহরণ, জোরপূর্বক আটক রাখা, নির্যাতন, লুটপাটের পাঁচটি অভিযোগের মধ্যে অভিযোগ-১ এ তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড এবং অভিযোগ-৩ এ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে। অন্য তিনটি অভিযোগ-২, ৪, ৫ প্রমাণিত না হওয়ায় আসামিকে খালাস প্রদান করা হয়েছে। চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ আদেশ প্রদান করেছেন। এ রায়ের বিরুদ্ধে মোবারক হোসেন আপীল করেছেন। সৈয়দ মোঃ কায়সার ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত জাতীয় পার্টির সাবেক কৃষি প্রতিমন্ত্রী কায়সার বাহিনীর প্রধান সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারকে ২০১৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৬টি অভিযোগের মধ্যে হত্যা-গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, আটক, মুক্তিপণ আদায়, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠন এবং ষড়যন্ত্রের ১৪টি প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে ৭টি অভিযোগে ফাঁসি, ৪টিতে আমৃত্যু কারাদণ্ড, ৩টিতে ২২ বছরের কারাদণ্ড ও দুটি অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় খালাস দেয়া হয়েছে। চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহীনের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ আদেশ প্রদান করেছেন। কায়সার এই রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করেছেন। এটিএম আজাহারুল ইসলাম ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও আলবদর কমান্ডার এটিএম আজাহারুল ইসলামকে ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের ৬টি অভিযোগের মধ্যে হত্যা-গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, আটক, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠনের ৫টি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে ৩টি অভিযোগে ফাঁসি, ২টিতে ৩০ বছরের কারাদণ্ড ও একটিতে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় খালাস দেয়া হয়েছে। চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ আদেশ প্রদান করেছেন। তিনি এ রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করেছেন। ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল জব্বার ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত পলাতক পিরোজপুরের রাজাকার কমান্ডার জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল জব্বারকে ২০১৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি আমৃত্যু কারাদণ্ড প্রদান করেছেন ট্রাইব্যুনাল। আসামি জব্বারের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন পক্ষেও আনা পাঁচটি অভিযোগের সবকটি প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে তারা। রায়ে আনা অভিযোগের মধ্যে এক, দুই, তিন এবং পাঁচে মৃত্যুদণ্ড ও চার নম্বর অভিযোগে ২০ বছরের কারাদণ্ড এবং ১০ লাখ টাকা জরিমানা করেছেন রায়ে। আনাদায়ে আরও দুই বছরের সশ্রম কারাদ- প্রদান করা হয়েছে। অভিযোগ মৃত্যুদণ্ড যোগ্য হলেও বয়সের বিবেচনায় তাকে এই দণ্ড দেয়া হয়েছে। চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ মঙ্গলবার এই রায় ঘোষণা করেন। রাষ্ট্রপক্ষ এ রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করেছেন। আব্দুস সুবহান ॥ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর সংগঠক আবদুস সুবহানকে ২০১৫ সালের ৪ ডিসেম্বর মৃত্যুদ- দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। আসামির বিরুদ্ধে আনা ৮ ধরনের ৯টি মানবতাবিরোধী অভিযোগের মধ্যে গণহত্যা, হত্যা, অপহরণ, আটক, নির্যাতন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও ষড়যন্ত্রের ৬টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে ১, ৪ ও ৬ নম্বর অভিযোগে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন ট্রাইব্যুনাল। ২ ও ৭ নম্বর অভিযোগ আমৃত্যু কারাদ- ও ৩ নম্বর অভিযোগে ৫ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় ৫, ৮ ও ৯ নম্বর অভিযোগ থেকে খালাস পেয়েছেন আবদুস সুবহান। চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহীনের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ রায় প্রদান করেছেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে সুবহান আপীল করেছেন। আইনমন্ত্রী ॥ মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর বিচার করতে জাতীয় সংসদে এ সংক্রান্ত আইনের সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করা হবে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। আসছে বাজেট অধিবেশনের শেষভাগে এ সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করা হবে বলে তিনি জানান। রবিবার সকালে বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে ১২৬তম রিফ্রেশার্স কোর্সের উদ্বোধন শেষে সাংবাদিকদের এ কথা জানান আইনমন্ত্রী। জ্যেষ্ঠ সহকারী বিচারকরা এ কোর্সে অংশ নিচ্ছেন। মন্ত্রী বলেন, আগামী বাজেট সেশনের শেষের দিকে আমরা আইনটি জাতীয় সংসদে উত্থাপন করব। আশা করছি, বাজেট শেষ হওয়ার আগেই এ আইন পাস হবে। শনিবার জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় কার্যকর করার বিষয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, বর্তমান সরকার মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের ব্যাপারে কখনই পিছপা হয়নি, হবেও না। এই বিচার সম্পূর্ণ স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিকমানের হচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি। আনিসুল হক বলেন, অপরাধ সংগঠনের প্রায় ৪৪ বছর পর হলেও আমরা এ বিচার পেয়েছি। এর মাধ্যমে এটা প্রমাণিত হয়েছে, আমরা বাংলাদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি। এ্যাটর্নি জেনারেল ॥ এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার রায় নিয়ে আমার আক্ষেপ রয়ে গেল। তাকে ফাঁসি দেয়া গেল না। সাঈদীকে ফাঁসি দেয়ার সব তথ্য প্রমাণই ছিল। শুধু প্রসিকিউসন এবং তদন্ত সংস্থার গাফেলতির কারণে ফাঁসি দেয়া গেল না। দ্বিতীয় যুদ্ধাপরাধী হিসেবে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- কার্যকর করার পর রবিবার দুপুরে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এই বছরের মধ্যে আরও তিনটি মামলার রায় কার্যকর করা হবে। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সুপ্রীমকোর্ট খুব দ্রুতই এসব মামলা নিষ্পত্তির কাজ করছে। এ সময় তিনি মামলাগুলোর মধ্যে মুজাহিদ, সাকা চৌধুরী, নিজামী এই তিনজনের মামলার শুনানির কাজ শুরু হবে বলে জানান। সাংবাদিকরা সাঈদীর মামলার রায়ের রিভিউ করার আবেদন করা হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, সাঈদীর মামলার রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি এখনও প্রকাশিত হয়নি। প্রকাশিত হওয়ার পর রিভিউ আবেদনের মাধ্যমে ফাঁসির রায় পুনর্বহালের আরজি জানানোর চিন্তা করা হবে।
×