ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মুনতাসীর মামুন

শেখ হাসিনাকে কেন আমরা মনে রাখব?

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ১৩ এপ্রিল ২০১৫

শেখ হাসিনাকে কেন আমরা মনে রাখব?

মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারের ট্রাইব্যুনালে কোন অভিযুক্ত অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত হলে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সাধারণ মানুষ অস্থির হয়ে ওঠেন। একটি প্রশ্নই বারবার করেন কেন দণ্ড কার্যকর হচ্ছে না? বিচার ও দণ্ড প্রদানের একটি প্রক্রিয়া আছে যা নিয়ে অনেকে মাথা ঘামান না। ট্রাইব্যুনালের বিচারেরও কয়েকটি ধাপ আছে। এ পর্যন্ত, গত প্রায় পাঁচ বছরে ট্রাইব্যুনাল ১৭ জনের বিচার করেছে। প্রথমদিকে, প্রসিকিউটর ও বিচারকদের অনভিজ্ঞতায় কিছু সময় নষ্ট হয়েছে। তারপরও বলতে পারি, পৃথিবীর অন্যান্য দেশে বিচারার্থে স্থাপিত ট্রাইব্যুনাল থেকে আমাদের দেশের ট্রাইব্যুনাল বিচারকাজ সম্পন্নে তুলনামূলকভাবে অনেক কম সময় নিয়েছে। ট্রাইব্যুনাল দণ্ড দেয়ার পরপরই যদি দ- কার্যকর হতো তাহলে ‘কেন দেরি হচ্ছে’ এ প্রশ্নটি জাগত না। আইনপ্রণেতারা একটি লেজ যোগ করেছেন আইনে। তা হলো, অপরাধী দ-ের বিরুদ্ধে সরাসরি আপীল বিভাগে আপীল করতে পারবেন। পৃথিবীর কোন দেশে মানবতাবিরোধী অপরাধ আইনে এই ধারা নেই। হয়ত, নীতিনির্ধারকরা মনে করেছিলেন, এতে অধিক স্বচ্ছতার বিষয়টি প্রমাণিত হবে। হয়ত, আমরা একটি বিষয় মনে রাখি না। তা হলো, যারা এ বিচারবিরোধী তাদের কাছে স্বচ্ছতার প্রশ্নটি বড় নয়, বিরোধিতার বিষয়টিই বড়। এই স্বচ্ছতার কারণে কি বিএনপি ট্রাইব্যুনালের পক্ষে কথা বলেছে? বা বিভিন্ন দেশের ‘বিশেষজ্ঞ’ বা পাকিস্তান পক্ষীয়রা? মৃত্যুদণ্ড দেয়ার ব্যাপারে জাতিসংঘ, ইইউ বা অন্যান্য জামায়াতপন্থী মানবাধিকার সংস্থাগুলো এখন বিচার নিয়ে তেমন প্রশ্ন না তুললেও মৃত্যুদণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। নৃশংস মানবতাবিরোধী ক্রিমিনাল কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড রদের ব্যাপারে কি এরা প্রতিবাদ জানায়নি? জানিয়েছে। কিন্তু, ফ্রান্স বা অন্য কোনখানে যখন মানবতা-যুদ্ধাপরাধীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় তারা কি আপত্তি জানায়? গত বছর ইতালিতে এক নাজি যুদ্ধাপরাধীর দণ্ড দেয়া হলে এবং তার মৃত্যু হলে, ইতালীয়রা তাকে ইতালিতে সমাহিত করার ব্যাপারে আপত্তি জানায়। আর্জেন্টিনার এই নাগরিককে আর্জেন্টিনা পর্যন্ত নিতে অস্বীকার করে। পরে, কর্তৃপক্ষ লাশ গায়েব করে দেয়। নাজি/ফ্যাসিস্টদের বিচারে ককেশিয়ানদের কোন আপত্তি নেই। আপত্তি অন্যদের বেলায়। ইহুদী নিধনকারী গণহত্যাকারীদের তারা সহ্য করতে পারে না। কিন্তু, বাঙালী গণহত্যাকারীদের প্রতি তাদের ভালবাসা অসীম। আমেরিকায় মৃত্যুদ-ে জাতিসংঘ কখনও আপত্তি জানিয়েছে বলে শুনিনি। এসব এক ধরনের বর্ণবাদ কিনা জানি না। যা হোক আপীল বিভাগে গেলে আমরা দেখি সবকিছু ঝুলে যায়। আর মানুষের ক্ষোভ সেখানেই। এই ক্ষোভ হ্রাস পাচ্ছে না। এ পর্যন্ত সব দ-প্রাপ্তরাই আপীল করেছেন। কামারুজ্জামানকে নিয়ে আপীল নিষ্পত্তির সংখ্যা তিন। সংসদ, সাধারণ মানুষের সার্বভৌমত্বের প্রতীক। বিচার বিভাগের হয়ত তাতে মৃদু আপত্তি থাকতে পারে। কিন্তু, সত্য সেটাই। মানুষের ক্ষোভ উপলব্ধি করে সংসদ অনুরোধ রেখেছিল ছয় সপ্তাহের মধ্যে যাতে আপীল নিষ্পত্তি হয়। আদালত যদ্দুর মনে পড়ে জানিয়েছিল, তাদের রীতি অনুযায়ী তারা চলবে। সে অধিকার আদালতের আছে। কিন্তু, অধিকার আইন ও নির্বাহী বিভাগেরও আছে। নির্বাহী ও আইন বিভাগ সহায়তা না করলে আদালত তার অধিকার প্রয়োগ করতে পারে না। একটি উদাহরণ দিই। জনস্বার্থে দেয়া রায় নির্বাহী বিভাগ কি খুব একটা জানে? আদালত কি কখনও তা মনিটর করে? জনগণ সার্বভৌম। সেই জনস্বার্থে করা মামলার রায় যদি না মানা হয় তাহলে রায়ের মর্যাদাটুকু কোথায় থাকে? এ বিষয়গুলোও হিসাবে থাকা উচিত। সুতরাং আদালত তার অধিকার বজায় রাখল। কিন্তু, অধিকার কি শুধু আদালতেরই থাকবে বাংলাদেশে, আর কারও নয়, সেটাতো হতে পারে না। বাংলাদেশ তো আদালত আনেনি, এনেছে সাধারণ মানুষ। তাদের অধিকারও সার্বভৌম যার ওপর রাষ্ট্রের তিন বিভাগ হস্তক্ষেপ করতে পারে না। আদালত বলতে পারে, আমরা অন্ধ। প্রশ্ন, অন্ধ হলেই কি প্রলয় বন্ধ থাকে? প্রক্রিয়ার কথা বলছিলাম। কার্যতালিকা অনুসারে বিচার চলে। মানবতাবিরোধীদেরও। তারপর চূড়ান্ত রায়। সেখানেও যে প্রক্রিয়া চলেছে, অন্তত, কামারুজ্জামানের ক্ষেত্রে তা বিধেয় কিনা সেটি নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। রায়ের পর রিভিউ। পৃথিবীর কোন দেশে মানবতাবিরোধীদের দ-ের রিভিউ করা হয় না। বাংলাদেশে হয়। ভাবটা যেন, তারা বিশাল এক আইনী কাজ করে ফেলেছে। কাদের মোল্লার ক্ষেত্র থেকে রিভিউ প্রচলিত হয়েছে। সেক্ষেত্রে সংক্ষিপ্ত আদেশে সেটি নিষ্পত্তি হয়েছিল। কামারুজ্জামানের ক্ষেত্রে সেটি হয়নি। শুধু তাই নয়, রিভিউ খারিজ করার পর বলা হয়েছে পূর্ণাঙ্গ রায় লিখতে। সেটি লিখতে সময় গেছে। তারপর স্বাক্ষর করাতে সময় লেগেছে। উল্লেখ্য, সেই সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পরও ফাঁসি কখন হবে, অপরাধীর ইচ্ছায় হবে, না, সরকারের ইচ্ছায় হবেÑ সেসব সিদ্ধান্ত নিতেও সময় লেগেছে। আলোচ্য সেটি নয়। আলোচ্য হচ্ছে, সাধারণ বিষয়টি কিভাবে নিচ্ছেন? আদালতের অধিকার প্রয়োগজাত প্রক্রিয়ার কারণে, দোষারোপ হচ্ছে সরকারের ওপর। এ কয় দিন সাধারণের ধারণা ছিল, বিএনপির সঙ্গে যেহেতু একটি সমঝোতা হয়েছে [পত্র-পত্রিকায়ও এ নিয়ে খবর প্রকাশিত হয়েছে] সুতরাং, জামায়াতের সঙ্গেও কিছু একটা হচ্ছে। এ ধরনের ধারণা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু হয়েছে। মানবতাবিরোধী বিচারের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ, ১৪ দলীয় জোট সমঝোতা করতে পারে। শেখ হাসিনা করবেন এটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। এক্ষেত্রে তাঁর ওপর আমাদের অনেকের বিশ্বাস এরকম যে, তিনি সমঝোতা করলে, বাংলাদেশে আর কারও কোন বিশ্বাসযোগ্যতা থাকবে না। তখন যুক্তিবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের দেশ ত্যাগ করাই হবে শ্রেয়। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী, আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে তাঁর স্থান। নিম্নপর্যায়ের একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কথা ধরুন। বিএনপি-জামায়াতকে বিশ্বাস করানো যাবে এই কমিটি এ বিষয়ে সমঝোতা করবে? এই কমিটির ক্ষেত্রে কেউ তা বিশ্বাস করবে না, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে করবে, কারণ, তিনি রাজনীতিবিদ। আদালতের দায়ও তাঁর কাঁধে চাপে। আদালতে সময়ক্ষেপণের জন্য বিবাদীদের প্রকৌশলীরা নানা অপকৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন। সে দৃশ্য ছিল খুবই দৃশ্যমানÑ কিন্তু আদালত তা আমলে নেয়নি। এক্ষেত্রে আদালত অন্ধ ছিল তা তো বলা যাবে না। একটি উদাহরণ দিই। রিভিউর সময় বলা হলো প্রধান কৌশলী বা প্রকৌশলী অসুস্থ। আদালত তা গ্রাহ্য করলেন। টেলিভিশনে দেখা গেল মরহুম মানিক মিয়ার শ্যালক স্বাধীনতাবিরোধীদের পক্ষ নিয়ে আওয়ামী জোটের পি-ি চটকাচ্ছেন। বিচারপতি শামসুদ্দীন চৌধুরীও এই প্রশ্ন তুলেছেন, যা গ্রাহ্য হয়নি। দৃশ্যমান অপকৌশল আদালতের প্রশ্রয় পেলে বিচারপতিদের প্রতি শ্রদ্ধা হ্রাস পায়। তাদের গ্রহণযোগ্যতা কমে যায়। কারণ তখন প্রমাণিত হয়, আইনজীবীদের স্বার্থ প্রাধান্য পাচ্ছে, অন্যদের নয়। মানবতাবিরোধী বিচারে দ-প্রাপ্ত ক্রিমিনাল কামারুজ্জামানের রায় নিয়েই এত বড় ভূমিকা দিতে হলো। মূলকথা হচ্ছে, আপীল বিভাগে যেভাবে বিচার ঝুলে যাচ্ছে তাতে শেখ হাসিনা বা আমরা যাদের বিচার হয়েছে তাদের চূড়ান্ত রায় দেখে যেতে পারব না। একটি প্রস্তাব ছিল যে, এসব আপীলের জন্য আলাদা বেঞ্চ গঠন করা হোক। কিন্তু সেটা আর সম্ভব হচ্ছে না। ১১ জন বিচারকের মধ্যে আছেন ৭ জন। তারা পুরনো মামলাই সামলাতে পারছেন না। এক্ষেত্রে সরকারী শৈথিল্যই দায়ী। আপীল বিভাগে ১১ জন হলে হয়ত আলাদা বেঞ্চ গঠন করা সম্ভব হতে পারে। তবে, খালাসী বিচারক থাকলে অবস্থা আরও জটিল হবে সন্দেহ নেই। এক আলোচনা সভায় এ্যাডভোকেট আমিনউদ্দিন বলছিলেন, আপনারা মানবতাবিরোধীদের আপীল শুনানির ক্ষেত্রে যে অগ্রাধিকারের কথা বলছেন, দুটি মামলার ক্ষেত্রে তা করা হয়েছে। আপীল বিভাগে এখন ২০০৬ সালের মামলা শোনা হচ্ছে সেখানে ২০১৩ সালের মামলার শুনানি তো অগ্রাধিকার বটে। আমরা যে পেশায় আছি সে পেশার বাইরে চিন্তা করি না, চিন্তা করতে চাইও না। অগ্রাধিকারের দাবির পটভূমি ভিন্ন এবং গতানুগতিক চিন্তা নয়, বিষয়টি ভিন্নভাবে বিচার করতে হবে। আমাদের রাষ্ট্রে মুক্তিযুদ্ধ অবশ্যই অগ্রাধিকার পাবে। কেননা, মুক্তিযুদ্ধ থেকেই এ রাষ্ট্র। সংবিধান, আইন উদ্ভূত। এবং এ বিষয়ও মনে রাখতে হবে এই রাষ্ট্রের জন্য ৩০ লাখেরও বেশি শহীদ হয়েছেন। ৬ লাখেরও বেশি নারী নির্যাতিত হয়েছেন। প্রায় ২ কোটি বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হয়েছেন। তাদের একটি অধিকার আছে। সেই অধিকার অবশ্যই সবার আগে বিবেচনা করতে হবে। এখানে ‘প্রচলিত ধারা’ ইত্যাদি বিবেচ্য নয়। বিশেষ করে ৩০ লাখের হত্যার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিচার হচ্ছে। একজনের খুন, একজনের সম্পত্তি দখল, একজনের চাকরিচ্যুতির বিচারের সঙ্গে এ ধরনের মামলা তুলনা করাও শহীদদের অপমান করা। সে কারণেই আমাদের দাবি ছিল, আপীল হলেই তা নিষ্পত্তি করে দেয়া, কারণ সে শুনানিতে তেমন কোন সময় লাগে না। এটি শহীদের অধিকার আর আমাদের দায়। সেভাবেই বিষয়টি বিবেচনার অধিকার রাখে। এ দেশে রাষ্ট্রপতির দায় আছে, প্রধানমন্ত্রীর দায় আছে, আমার মতো সাধারণ একজন শিক্ষকের দায় আছে, আর আদালতের দায় থাকবে না সেটিতো হতে পারে না। আমাদের অধিকার আছে, জোরগলায় বলতে চাই, অধিকার এ জন্য আছে যে, আমরা বাংলাদেশের সমস্ত গণতান্ত্রিক আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৭৫ পরবর্তী স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, যুদ্ধাপরাধের বিচার থেকে এ পর্যন্ত পথে আছি। আজকের বাংলাদেশের জন্য আমরা কণাবিন্দু হলেও করেছি, ধারাবাহিকভাবে। যারা আজ সচিবালয়, আদালত থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে শাসকের ভূমিকায় ছিলেন তারা শুধু আমাদের শাস্তি দিয়েছেন আর ভোগ করেছেন। এই শাস্তি আর ভোগের প্রসঙ্গ মনে হতেই আবার মানবতাবিরোধী অপরাধীদের কথা মনে হলো। আজীবন তারা ভোগ করে গেল আর ক্যামেরার আলো তাদেরই ফলো করল। গোলাম আযম থেকে সাকাচৌ সবাই সব আমলে বহাল তবিয়তে ছিলেন, বিচারের কারণে গ্রেফতার হওয়ার পরও তাদের জামাই আদরে রাখা হলো। বিচারের যেসব সুবিধা ভোগ করার নয় সেসব সুবিধা তাদের দেয়া হলো। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তারা সেলিব্রেটি হিসেবে বিজয় চিহ্ন দেখাল। অনেকে এও বললেন, আহা বেচারার ফাঁসি হচ্ছে। মাঝে মাঝে মনে হয় এবং এখন বিশ্বাস করাও শুরু করেছি যে, আমাদের সবার দিলের এককোণে এক টুকরো হেজাবি [হেফাজত+জামায়াত+বিএনপি] ভাব সঙ্গোপনে লালন করছি। আমরা আজীবন মার খেয়ে গেলাম, নিঃস্ব হয়ে রইলাম আর এরা ধনসম্পদের পাহাড় গড়ল, মৃত্যুর পরও তাদের পরিবার-পরিজনরা তা ভোগ করবে। আর যে বয়সে ফাঁসি হলো তাতে কিইবা শাস্তি হলো। কামারুজ্জামানের কথা ধরুন। তাকে ক্রিমিনাল বললেও সম্মান করা হয়। সেই লোকটি রাজনীতির নামে ২০১০ পর্যন্ত রক্ষা পেল। আর তার হাতে খুন হওয়া সোহাগপুরের বাসিন্দারা ১৯৭১ সালে যেমন অত্যাচারিত হয়েছে, ১৯৭৫ সালের পর থেকেও তেমন অত্যাচারিত শুধু নয়, নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয়েছে। কামারুজ্জামানের সম্পদ বেড়েছে। মন্ত্রী হওয়াটা বাকি ছিল মাত্র। ধর্ষক ও খুনী এই ব্যক্তি নিরাপদে সংসার করেছেন। মাঝে মাঝে ভেবে অবাক হই তাদের সংসারে যারা আছেন তারা তাদের কীভাবে মেনে নেন। আইন প্রণেতারা তো আইনে এটুকু রাখতে পারতেন যে, যারা অভিযুক্ত হবে তাদের সম্পদ বাজেয়াফত হবে। কিন্তু রাখেননি। কারণ আইন যারা করেছেন তারাও মধ্যবিত্ত, কামারুজ্জামানরাও মধ্যবিত্ত। কামারুজ্জামানের ফাঁসির পরও তার পুত্র-কন্যারা গাড়ি হাঁকাবে, পাকা বাড়িতে থাকবেন। আর কামারুজ্জামানের হাতে যারা খুন হয়েছেন তাদের স্ত্রী-সন্তানরা, কামারুজ্জামান যাদের ধর্ষণ করেছেন তারা খড়োকুটিরে নিরন্ন থাকবেন। তাহলে এটা কেমন ধরনের বিচার হলো? আমাদের আইন প্রণেতারা খ-খ-ভাবে চিন্তা করেন, এডহক চিন্তা করেন, সামগ্রিকভাবে চিন্তা করেন না। যা হোক, কামারুজ্জামানের ফাঁসির পর আমাদের দাবি, অনুরোধ, অনুনয় যাই বলুনÑ আদালত যেন সব সময় প্রক্রিয়ার কথা না বলে ত্বরান্বিত করেন বিচারপর্ব, স্বচ্ছতার কথা বলে তাদের যেন অধিকতর সুবিধা না দেন। কামারুজ্জামানের ফাঁসি অনেক কথা মনে করিয়ে দেয়। সোহাগপুরের বিধবারা কখনও কোন সহায়তা পাননি। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলে তারা সহায়তা পেতে থাকেন। খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে তা বন্ধ করে দেন। ভাবা যায়, সামান্য কয়েকটি টাকা। আর তিনি নিজে বিধবা হয়ে রাষ্ট্রের কত টাকা নিয়েছেন। এদের কোন হৃদয় আছে? নেই যে তার প্রমাণ আবারও গত চার বছর পেট্রোলবোমা মেরে কত মানুষকে তারা হত্যা করেছে। তাদের কাজে ধারাবাহিকতা আছে। আমার একটি মন্তব্য অনেকে অপছন্দ করেন, করতে পারেন; কিন্তু এটা সত্য যে, নির্দয় নৃশংস, নির্লজ্জ না হলে জামায়াত-বিএনপি করা যায় না। তারা যে রাজনীতি করবে তাতে অবাক হই না। অবাক হই যখন দেখি তাদেরও অনুসারী আছে। জিয়াউর রহমান ও তার পতœী দেশটাকে সীমারের দেশ বানিয়ে তোলেন। কামারুজ্জামানের ফাঁসি অনেককে নস্টালজিক করে তুলেছে অন্য কারণে। দেশ-বিদেশ থেকে অনেকে ফোন করেছেন। খুব ভোরে লেখক শেখর ইমতিয়াজ, কবি আসাদ মান্নান ফোন করে জানালেন কিভাবে এই আন্দোলনের সঙ্গে তারা বেড়ে উঠলেন। যুদ্ধাপরাধ বিচার ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে কত মানুষ নিগৃহীত হয়েছেন। এদের মধ্যে সংস্কৃতিকর্মী ও সাধারণ মানুষের সংখ্যাই বেশি। কামারুজ্জামানের ফাঁসি তো আমাকেও মনে করিয়ে দিচ্ছে, আমাদের অগ্রজ যারা এই আন্দোলন শুরু করেছিলেন যাদের অধিকাংশ এখন আর নেই। তাঁদের কথা আমার এখনও মনে আছে ১৯৭২ সালের সেই গ্রীষ্মের সকালে শহীদ মিনারের কথা। সদ্য বিধবা শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, পান্না কায়সার, নাফিসা কবিরসহ আরও অনেকের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ আমি আর শাহরিয়ার কবিরও দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের বয়স তখন একুশ। আমি আর শাহরিয়ার গেছি কায়েতটুলিতে শহীদুল্লা কায়সারের বাসায়। বিধবা পান্না কায়সারের কোলে এক বা দুই বছরের শমী। তখনও তরুণ আনিসুজ্জামান, সৈয়দ শামসুল হক, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, হাসান ইমাম, মধ্যবয়সী আহমদ শরীফ, বিচারপতি সোবহান, শামসুর রাহমান, জাহানারা ইমাম, আরেকটু বয়সী সুফিয়া কামাল, কলিম শরাফী, কবীর চৌধুরী, রাজনীতিবিদদের মধ্যে কাজী আরেফ, আবদুর রাজ্জাক, রাশেদ খান মেননÑ কে ছিলেন না এই আন্দোলনে। অনেকে বয়স ও নানা কারণে দূরে থেকেছেন, নতুনরা এসেছেন, বয়সী হয়েছেন চলে গেছেন। আবার কেউ না কেউ এসেছেন। তাদের অনেকে নেই। বিচারপতি সোবহান ও অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর জন্য আফসোস বেশি। বয়সের ভার নিয়েও কত সক্রিয় ছিলেন। আর দু’একটি বছর বাঁচলে এই আলবদরদের বিচারটা দেখতে পেতেন। যারা ছিলেন অপেক্ষাকৃত তরুণ আজ তাঁরা বয়সের ভারে ন্যুব্জ। সেই শমী এখন মাঝ বয়সে। সেই অতি তরুণ শাহরিয়ার বা আমি এখন প্রৌঢ়। সেই তরুণী শ্যামলী নাসরিন চৌধুরীও প্রৌঢ়ত্বে শেষ সীমায়। কতদিন কত অপমান, কত নির্যাতন, কত হুমকি মেনে নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছি। মনে পড়ে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর কথা, যিনি নৈঃশব্দ্যের দেয়াল প্রথম ভেঙ্গেছিলেন। এখনও তারা সবাই রাস্তায় থাকেন। তবে, এই আন্দোলনের চালিকাশক্তি ছিলেন শাহরিয়ার কবির। তাকে কিনা দালাল, বঙ্গবন্ধুর খুনীদের সহযোগী, ভারতের এজেন্ট, পাকিপ্রেমীÑ কত কথা শুনতে হয়েছে। অবিচল থেকে নিজের কাজটি করে গেছেন। আর শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী। সেই যে অল্পবয়সে শহীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য শহীদ মিনারে দাঁড়িয়েছিলেন, এখনও সেখানে আছেন। শেখর বা মান্নানের কথায় এটিই মনে হলো আসলে একা তো কিছু করা যায় না, একা বিজয়ও আনা যায় না, সমগ্র দিয়েই বিচার করতে হয়। আরেকটি কথা মনে হয়, নরঘাতকদের বিচারের আন্দোলন যারা শুরু থেকে এ পর্যন্ত করে গেছেন তারা কিন্তু নড়েননি, একই জায়গায় থেকে গেছেন। কামারুজ্জামানের ফাঁসির দ- বহাল আমাদের সেই মুক্তিযুদ্ধকেই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, যেখানে কামরুজ্জামানের দল জামায়াতে ইসলামী মানুষ হত্যায় সোৎসাহে অংশগ্রহণ করেছিল। কামারুজ্জামানের ফাঁসির দ- আমাদের আবার মনে করিয়ে দেয়, এই রাষ্ট্রটি গঠনের পেছনে ছিল কত হাহাকার, কষ্ট, দুঃখ ও বেদনা। কামারুজ্জামানের ফাঁসির দ-াদেশ বহাল থাকা মনে করিয়ে দেয়, সমাজে এদের রাজনীতি যদি বহাল থাকে, ভবিষ্যতেও একই ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। এবং লক্ষণীয়, গত তিন বছরে যেভাবে বিভিন্ন অজুহাতে মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে, যেভাবে মানুষ জবাই করা হয়েছে, যেভাবে দেশের সম্পদ বিনষ্ট করা হয়েছে, যেভাবে শিশুহত্যা হয়েছে, যেভাবে অজস্র পরিবারের অবর্ণনীয় দুঃখকষ্ট ডেকে আনা হয়েছে, তা ১৯৭১ সালের কামারুজ্জামানদের রাজনীতির কথাই মনে করিয়ে দেয়। আমরা পত্রিকায় দেখেছি, সরকার একটি ট্রাইব্যুনাল বিলুপ্ত করে দেয়ার চিন্তাভাবনা করছে। আমরা মনে করি, সাধারণ মানুষের কাছে এটি গ্রহণযোগ্য হবে না। আমরা শুধু ১০ জন বা ১১ জন শীর্ষ অপরাধীরই বিচার চাইনি; বিভিন্ন পর্যায়ে যারা গণহত্যা করেছে, তাদেরও বিচার চেয়েছি। গণহত্যা-নির্যাতন জাদুঘর ও আর্কাইভ ট্রাস্ট থেকে যে গণহত্যা নির্ঘণ্ট গ্রন্থমালা প্রকাশিত হচ্ছে সেখানে দেখা যাচ্ছে, স্থানীয় পর্যায়ে এমন অনেকে আছে, যারা কমপক্ষে ১০০ জনের হত্যার সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু এখনও তারা বহাল তবিয়তে বসবাস করছে। সমাজে খুনী ও ভিকটিম একই সঙ্গে অবস্থান করতে পারে না। করলে সেক্ষেত্রে সেখানে ন্যায়বিচার বলে কিছু থাকে না। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বলবত থাকে না। আমরা মনে করি, ভবিষ্যতের স্বার্থে তাদেরও বিচারের আওতায় আনা উচিত। সে জন্য দুটি ট্রাইব্যুনালই রাখা জরুরী। বরং প্রসিকিউশনের অবস্থা কিভাবে আরও উন্নত করা যায়, সেটি বিবেচনায় আনা উচিত। সব শেষে আমরা এই বিচারের সঙ্গে যারা যুক্ত ছিলেন বিভিন্ন পর্যায়ে, তাঁদের সবাইকে অভিনন্দন জানাই। একটি কথা বাঞ্ছনীয়। ট্রাইব্যুনালের বিচারকরা যে রায় দিয়েছেন তার প্রতিটি ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকবে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে উদ্ধৃত হবে। শেখ হাসিনা না থাকলে কি বিচার হতো? হতো না। শেখ হাসিনা অটল না থাকলে কি দ- কার্যকর হতো? হতো না। শুরু থেকেই শেখ হাসিনা আমাদের আন্দোলনকে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছেন। শেখ হাসিনা যে দায়বদ্ধতার সমাজ ফিরিয়ে আনতে চাচ্ছেন সেজন্যই তিনি স্মরিত হবেন। দক্ষিণ এশিয়ায় তাঁর সাহসী ভূমিকা সব সময় প্রশংসিত হবে। অভিনন্দন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সব শেষে বলব, আবারও বলব, বারবার বলবÑ জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় মুক্তিযুদ্ধ!
×