ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আদিবাসীদের ‘সাংগ্রাই’ ঘিরে উৎসব আমেজ পাহাড়ে ॥ নানা আয়োজন

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ১২ এপ্রিল ২০১৫

আদিবাসীদের ‘সাংগ্রাই’ ঘিরে উৎসব আমেজ পাহাড়ে ॥ নানা আয়োজন

নিজস্ব সংবাদদাতা, খাগড়াছড়ি/ বান্দরবান ॥ প্রতিবছর আদিবাসীদের ঘরে সাংগ্রাই আসে নতুন সাজে। দিয়ে যায় আনন্দের ফুলঝুরি, কিছু বেদনার স্মৃতি। এই আনন্দ-বেদনার মিশ্র প্রতিক্রিয়া প্রতিটি আদিবাসীর দেহমনে জেগে ওঠে নতুন পরিবর্তনের শিহরণ, স্বপ্ন দেখে দিন বদলের, স্বপ্ন দেখে যেন নতুন এক সকালের। এদিকে বৈসাবিকে বরণ করতে শনিবার খাগড়াছড়িতে স্মরণকালের বিশাল বর্ণাঢ্য র্যালি হয়েছে। এতে হাজারো পুরুষ বর্ণিল পোশাকে অংশ নেয়। বান্দরবান পার্বত্য জেলায় সংখ্যাগরিষ্ঠ আদিবাসী মারমা, রাঙ্গামাটির চাকমা ও খাগড়াছড়ির ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের বসবাস। চাকমা সম্প্রদায়ের লোকজন এ উৎসবকে বিঝু, মারমারা সাংগ্রাই এবং ত্রিপুরারা বৈসু বা বৈসুক বলে। ত্রিপুরাদের বৈসুর (বৈ), মারমাদের সাংগ্রাইয়ের (সা) চাকমাদের বিঝু (বি) থেকে ‘বৈসাবি’। আর এ উৎসবকে কেন্দ্র করে বর্ষবরণের ভিন্ন আমেজে মেতে ওঠে পাহাড়ের আদিবাসীরা। আজ রবিবার তংচঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থার উদ্যোগে বান্দরবানের রেইছা সিনিয়রপাড়া মাঠে বিঝু উৎসব উৎযাপন করা হবে। এ সময় আদিবাসী তংচঙ্গ্যারা মেতে উঠবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও তাদের ঐতিহ্যবাহী ঘিলাখেলা প্রতিযোগিতায়। বাংলাদেশ তংচঙ্গ্যা জাতীয় ঘিলাখেলা উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব মুক্তধন তংচঙ্গ্যা বলেন, হারিয়ে যাওয়া খেলাটিকে ফিরিয়ে আনতে বর্ষবরণে ঘিলাখেলার আয়োজন করা হয়েছে। সোমবার (১৩ এপ্রিল) সকালে পুরাতন রাজবাড়ী মাঠ থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রার মধ্যে দিয়ে শুরু হবে সপ্তাহব্যাপী বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। ১৪ এপ্রিল (মঙ্গলবার) দুপুরে উজানীপাড়ার পার্শ্ববর্তী সাঙ্গু নদীতে বৌদ্ধ মূর্তিস্নান করা হবে। ১৪ ও ১৫ এপ্রিল পুরাতন রাজার মাঠে মারমা আদিবাসী তরুণ-তরুণীরা জলকেলিতে মেতে উঠবে। ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত রয়েছে মন্দিরে মন্দিরে ধর্ম দেশনা শ্রবণ, বিশেষ প্রার্থনাসহ ছোয়াইং দান অনুষ্ঠান। সাংগ্রাই উৎসব উদযাপন কমিটির সভাপতি মং চিং নু মার্মা বলেন, ১৪ এপ্রিল থেকে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় এ উৎসবে মেতে উঠবে আদিবাসীরা। অনুষ্ঠানগুলোতে প্রধান অতিথি হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লা, জেলা প্রশাসক মিজানুল হক, পৌর মেয়র জাবেদ রেজা, পুলিশ সুপার দেবদাস ভট্টচার্যসহ স্থানীয় আদিবাসী নেতারা উপস্থিত থাকবেন। উৎসবকে ঘিরে পাহাড়ে পর্যটকদের আগমন বাড়ার কারণে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। খাগড়াছড়িতে বৈসাবি মেলা উদ্বোধন ॥ পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর প্রাণের উৎসব বৈসাবি ঘিরে পুরো খাগড়াছড়ি জেলায় আনন্দের রং ছড়িয়ে পড়েছে। ‘বৈসাবি’কে বরণ করতে শনিবার খাগড়াছড়িতে স্মরণকালের বিশাল বর্ণাঢ্য র্যালি হয়েছে। জেলা পরিষদের উদ্যোগে এ র্যালিতে বর্ণিল পোশাকে তরুণ-তরুণী ছাড়াও বিভিন্ন বয়সের হাজারো নারী-পুরুষ অংশগ্রহণ করে। র্যালিটি শহরের প্রধান সড়ক ঘুরে খাগড়াছড়ি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে গিয়ে শেষ হয়। সেখানে উদ্বোধন করা হয় সাত দিনব্যাপী বৈসাবি মেলার। বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে এবং ফিতা কেটে উৎসব উদ্বোধন করেন খাগড়াছড়ি আসনের সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা। এ সময় উপস্থিত ছিলেন খাগড়াছড়ি রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল স ম মাহবুব-উল-আলম, গুইমারা রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তোফায়েল আহমেদ, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী ও পুলিশ সুপার শেখ মোঃ মিজানুর রহমান, জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সালাউদ্দিন, পৌর সভার মেয়র মোঃ রফিকুল আলম, নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুর রহমান তরফদার, সদর উপজেলা চেয়ারম্যান চঞ্চুমনি চাকমাসহ সামরিক বেসামরিক কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি ও বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। ১৯৮৫ সাল থেকে খাগড়াছড়িসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত তিন সম্প্রদায়ের বিভিন্ন সংগঠনের সম্মিলিত উদ্যোগে ‘বৈসাবি’ নামে এ উসব পালন করে আসছে। সময়ের পরিক্রমায় নিজ নিজ সম্প্রদায়ের লোকদের কাছে ‘বৈসাবি’ শব্দটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আজ রবিবার নদীতে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে মূলত খাগড়াছড়িতে শুরু হবে পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর প্রধান সামাজিক উৎসব। আজ চাকমা সম্প্রদায় পালন করবে ফুল বিঝু। ১৩ এপ্রিল মূল বিঝু আর পহেলা বৈশাখ বা গজ্জাপয্যা পালন করবে। ওইদিন ঘরে ঘরে চলবে অতিথি আপ্যায়ন। সেই সঙ্গে সব বয়সী মানুষ নদী, খাল অথবা ঝর্নায় গঙ্গাদেবীর পূজা আরাধনা করবেন। ১৩ এপ্রিল ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের চৈত্র সংক্রান্তি ও গড়িয়া উৎসব। খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের সাত দিনব্যাপী মেলার মধ্য রয়েছে, ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা, ঐতিহ্যবাহী বলি খেলা, দেশী-বিদেশী শিল্পীদের পরিবেশনায় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, গুণীজন সংবর্ধনা ও খাগড়াছড়ি রিজিয়নের পরিচালনায় আনন্দ কনসার্ট। খাগড়াছড়িতে সর্বজনীন বৈসাবি উদ্যাপন কমিটির উদ্যোগে পাঁচ দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে, রবিবার ভোর ছয়টায় চেঙ্গী নদীতে ফুল ভাসানো, একই দিন সকাল নয়টায় ফুল বিঝুর দিন বৈসাবি বর্ণাঢ্য র্যালি এবং র্যালি শেষে উপজেলা মাঠে সংক্ষিপ্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পানি খেলা ও গড়িয়া নৃত্য। ১৪ এপ্রিল সন্ধ্যা ছয়টায় নতুন বছরের সুখ-শান্তি কামনায় প্রদীপ প্রজ্বলন, ১৩-১৬ এপ্রিল চাকমা, ত্রিপুরা ও মারমাদের বৈসাবি উৎসবের মূল দিনগুলোতে বয়স্ক এবং মুরব্বিসহ দলবদ্ধভাবে পারস্পরিক শুভেচ্ছা বিনিময়। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ১৪ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হবে বর্ষবরণ ও মারমা সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী ওয়াটার ফেস্টিভ্যাল বা ‘পানি উৎসব’।
×