ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

যে কারণে কালক্ষেপণের চেষ্টা করেছিল কামারুজ্জামান-

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ১২ এপ্রিল ২০১৫

যে কারণে কালক্ষেপণের চেষ্টা করেছিল কামারুজ্জামান-

শংকর কুমার দে ॥ যে কারণে টালবাহানার মাধ্যমে কালক্ষেপণ করেও শেষ পর্যন্ত মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসির দ-িত যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা কামারুজ্জামান রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইলেন না, তার নেপথ্যের কাহিনী বের হয়ে এসেছে গোয়েন্দা তদন্তে। মৃত্যুদ- কার্যকর করার আগেই সকল ধন সম্পদ পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে দিয়ে গেছেন কামারুজ্জামান। তার পাঁচ ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে প্রবাসী দুই ছেলে মৃত্যুদ- কার্যকরের আগে দেশে আসেনি। মৃত্যুদ- কার্যকরের সময় যত ঘনিয়ে আসতে থাকে ততই তিনি নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়ে দোয়াদরুদ পড়ার মধ্য দিয়ে বিমর্ষ সময় পার করেছেন। কামারুজ্জামানের মৃত্যুদ-াদেশ কার্যকর করা সংক্রান্ত সংশ্লিষ্ট সকল মহলের সঙ্গে যোগাযোগ করে এ ধরনের প্রতিবেদন তৈরি করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের ফাঁসির আদেশ বন্ধ করতে দুই ধরনের তৎপরতা চালায় জামায়াত। প্রথমত: বিদেশীদের মাধ্যমে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে ফাঁসি বন্ধ করতে চেয়েছে। দ্বিতীয়ত: পর্দার অন্তরাল থেকে বিদেশীদের মাধ্যমে সমঝোতার প্রস্তাব দিয়ে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে লবিং করে ফাঁসির আদেশ বন্ধ করার সবুজ সঙ্কেত আদায়ের চেষ্টা করা হয়। রাজনৈতিকভাবে সমঝোতার প্রস্তাব দিয়ে সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে সবুজ সঙ্কেত পাওয়ার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে, জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নির্দেশে প্রাণভিক্ষার আবেদন জানায়নি কামারুজ্জামান। এজন্যই গত সোমবার সর্বোচ্চ আদালতে ফাঁসির আদেশ বহল থাকার পর থেকে শনিবার পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন জানাবেন কি, জানাবেন না, এ ধরনের টালবাহানা করে কালক্ষেপণ করা হয়। যারা কামারুজ্জামানের সঙ্গে কারাগারে দেখা করতে গেছে তাদের মাধ্যমে এ ধরনের ছলচাতুরির পরামর্শ দিয়েছে পর্দার অন্তরালে থাকা জামায়াত। কিন্তু সরকারের সর্বোচ্চ মহলের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর করার ক্ষেত্রে অনড় মনোভাবের কারণে জামায়াতের কোন ছলচাতুরিই ধোপে টিকেনি। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, সরকারের সঙ্গে সমঝোতা চেষ্টা করার আগে যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের ফাঁসির আদেশ বন্ধ করতে দেশ-বিদেশে ব্যাপক তৎপরতা চালায় জামায়াত। সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে, বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করে যুদ্ধাপরাধীর বিচার শুরু হওয়ার পর থেকেই আইন, আদালত, বিচার প্রক্রিয়া, সরকার সম্পর্কে নানা ধরনের অপপ্রচার চালানোর জন্য অগাধ অর্থ ব্যয় করে তারা। জামায়াতের নিয়োগ করা লবিস্টের মাধ্যমে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) মাধ্যমে বিচার প্রক্রিয়া ত্রুটিপূর্ণ অভিহিত করে ফাঁসি প্রদান স্থগিত করার অনুরোধ জানানোর বিবৃতি আদায় করার মধ্য দিয়ে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়। একই প্রক্রিয়ায় এর আগে আরেক যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার সময়েও প্রভাবশালী পরাশক্তি রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ বিভিন্ন মাধ্যমে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে ফাঁসির আদেশ স্থগিত করার চেষ্টা করে। কিন্তু সরকার কোন বিদেশী রাষ্ট্র, সংগঠন, মন্ত্রী, রাজনীতিকদের চাপের কাছে নতি স্বীকার না করে কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করেন। এবারও একই পদ্ধতিতে কামারুজ্জামানের ফাঁসির আদেশ স্থগিত করার চেষ্টার মধ্য দিয়ে কালক্ষেপণের সুযোগ নেয় জামায়াত। সূত্র জানায়, মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসির দ- কার্যকরের মুখে থাকা জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামান পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারা ও পরিচালনার অসিয়ত (উইল) করে দিয়ে গেছেন তিনি। শনিবার কারাগারে কামারুজ্জামানের সঙ্গে তার পরিবারের সদস্যরা শেষবারের মতো দেখা করার সময়ে ধন সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ার প্রসঙ্গ আসে। কামারুজ্জামানের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের মধ্যে রয়েছে, ঢাকার মিরপুরে সাংবাদিক আবাসিক পল্লীতে একটি ছয়তলা বাড়ি, শেরপুর শহরে একটি বাড়ি, শেরপুর ও গাজীপুরে জমি এবং উত্তরাধিকারসূত্রে শেরপুরের গ্রামের বাড়িতে পাওয়া জমি ও বাড়ি। ঢাকা ও শেরপুর শহরের বাড়ি থেকে তারা ভাড়া পান। এর বাইরে রয়েছে জমানো টাকা, ব্যাংক ব্যালেন্স। কামারুজ্জামানের পাঁচ ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলেরা হলেন হাসান ইকবাল, হাসান ইকরাম, হাসান জামান, হাসান ইমাম এবং আহমেদ হাসান। আর মেয়ে সবার ছোট আতিয়া নূর। কামারুজ্জামানের স্ত্রীর নাম নূরুন্নাহার। বড় ছেলে হাসান ইকবাল বন্ধ হয়ে যাওয়া দিগন্ত টেলিভিশনের রিসার্চ ডাইরেক্টর পদে কর্মরত ছিলেন। তাদের মধ্যেই স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ভাগ বাটোয়ারা করা হয়। তার পাঁচ ছেলের মধ্যে প্রথম তিন ছেলে বিয়ে করেছেন। দুই ছেলে দেশের বাইরে। হাসান ইকরাম সুইডেনে হিউম্যান রাইটসের ওপর পড়াশোনা করছেন। আর হাসান জামান টেলিকমিউনিকেশনের ওপর পড়াশোনা শেষ করে মালয়েশিয়াতেই চাকরি করছেন। বাবার মৃত্যুদ- কার্যকর করার খবর পাওয়ার পরও দেশে আসছেন না বিদেশে অবস্থানরত দুই ছেলে হাসান ইকরাম ও হাসান জামান। কামারুজ্জামানের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ভাগ-বাটোয়ারা হবে ইসলামী পারিবারিক আইন অনুযায়ী। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গোয়েন্দা সংস্থার দায়িত্ব পালন করেন এমন একজন কর্মকর্তা বলেছেন, সোমবার সর্বোচ্চ আদালতে ফাঁসির আদেশ বহল রাখার পর বুধবার সন্ধ্যায় রিভিউ আবেদন খারিজের রায় পড়ে শোনানো হয় জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানকে। এরপর থেকে খাওয়া-দাওয়া প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। তৃতীয় শ্রেণীর কয়েদি হিসেবে সকালের নাস্তা দুটি আটার রুটি ও গুড় দেয়া হয় তাকে। সেগুলো তিনি খাননি। দুপুরে সাদা ভাত, ডাল ও রুই মাছ দেয়া হয়। এর থেকে সামান্যই খেয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি কারা ক্যান্টিন থেকেও বিভিন্ন পছন্দের খাবার কিনে খেতেন। রায় পড়ে শোনানোর পর সেখান থেকেও আর কোন কিছু কিনে খাননি। ফাঁসির রায় পড়ে শোনানোর পর থেকেই তিনি অনেকটা বিচলিত ও বিমর্ষ হয়ে পড়েন। শনিবার শেষবারের মতো পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাত হওয়ার পর থেকে ওপর দিয়ে দৃঢ়চেতা মনোবল অটুট থাকার ভান দেখানোর চেষ্টা করলেও, ভেতরে ভেতরে কামারুজ্জামান একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছেন।
×