ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

কয়েকদিন অপেক্ষার প্রহর কাটল যেভাবে-

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ১২ এপ্রিল ২০১৫

কয়েকদিন অপেক্ষার প্রহর কাটল যেভাবে-

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামান। রিভিউ আবেদন খারিজ হওয়ার মধ্য দিয়ে গত সোমবারই মৃত্যুদ- চূড়ান্ত হয়েছিল তার। আর ওই দিন থেকেই দণ্ড কার্যকর নিয়ে শুরু হয় নানা গুঞ্জন। আজই ফাঁসি হচ্ছে, এমন খবর চাউর হয় প্রতিদিনই। আবার ফাঁসি কার্যকর করা হবে এমন ধরনের নানা ইঙ্গিতও পাওয়া যায় বিভিন্ন মাধ্যম থেকে। গত ছয় দিন যাবৎ দেশের গণমাধ্যমেরও প্রধান খবর ছিল কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামান। কুখ্যাত এই যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর নিয়ে অপেক্ষায় ছিল গোটা জাতিও। অপেক্ষার প্রথম দিন (সোমবার) ॥ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদ- বহাল রেখে সুপ্রীমকোর্টের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামানের দায়ের করা রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদন গত সোমবার সর্বসম্মতিক্রমে খারিজ করে দেয় উচ্চ আদালত। এর পর পরই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নেয়া হয় প্রস্তুতি। এমনকি লাশের কফিন পর্যন্ত ঢোকানো হয় কারাগারে। জল্লাদের একটি দলও প্রস্তুত রাখা হয় ওই দিন থেকে। ফাঁসির দড়িও প্রস্তুত করা হয় ওই দিনই। এদিকে সোমবার রিভিউ খারিজ করে সুপ্রীমকোর্ট রায় দেয়ার পর এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের গণমাধ্যমে দেয়া বক্তব্যের মাধ্যমেও দণ্ড কার্যকরের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আর এর পর পরই মিডিয়া কর্মীরা ভিড় করেন কারা ফটকে। এর পর সোমবার কামারুজ্জামানের পরিবারের সদস্যদেরও দেখা করার জন্য ডেকে পাঠানো হয় কারাগারে। পরে ওই দিন সন্ধ্যা পৌনে ৭টায় কামারুজ্জামানের পরিবারের ১৬ সদস্য কারাগারের ভেতরে প্রবেশ করে। ওই দিন পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ছিলÑ স্ত্রী নুরুন্নাহার, দুই ছেলে হাসান ইকবাল ওয়ামি ও হাসান ইমাম ওয়াফি, মেয়ে আতিয়া নূর ও ভাগ্নি রোকসানা জেবিন। সব প্রস্তুতির পরও আদালতের রায়ের অনুলিপি প্রকাশ না হওয়ায় ওই দিন ফাঁসি কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। অপেক্ষার দ্বিতীয় দিন (মঙ্গলবার) ॥ মঙ্গলবার সারাদিন চলে যায় আদালতের রায়ের অপেক্ষায়। ওই দিন রাত ৮টায় সুপ্রীমকোর্টের রেজিস্ট্রার সৈয়দ আমিনুল ইসলামের বক্তব্যে বোঝা যায় ওই দিনও ফাঁসি হচ্ছে না। তিনি বলেন, তখন পর্যন্ত তারা রায়ের অনুলিপি হাতে পাননি। তবে রায়ের অনুলিপি প্রকাশে বিচারপতিরা কাজ করে যাচ্ছিলেন বলে সুপ্রীমকোর্ট সূত্রে জানা গেছে। ওই দিন রাতেই রায়ের খসড়া অনুলিপি প্রস্তুত করা হয় বলে সুপ্রীমকোর্ট সূত্র জানায়। মঙ্গলবার সারাদিন গণমাধ্যমের চোখ ছিল উচ্চ আদালতের ওপর। অপেক্ষার তৃতীয় দিন (বুধবার) ॥ মঙ্গলবার সারাদিন অপেক্ষার পর অবশেষে বুধবার প্রকাশ করা হয় কামারুজ্জামানের রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেয়া সুপ্রীমকোর্টের রায়ের অনুলিপি। বুধবার সকালে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহাসহ বেঞ্চের অন্য বিচারপতিরা রায়ে স্বাক্ষর করার পর তা প্রকাশ করা হয়। বেঞ্চের অন্য বিচারপতিরা হলেনÑবিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্্হাব মিয়া, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। চার সদস্যের এই বেঞ্চের মধ্যে রিভিউর রায়টি লেখেন বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। তিনি বুধবার দুপুরে ৩৬ পৃষ্ঠার রায়টি লেখা শেষ করলে বেঞ্চের বাকি সদস্যরা এ রায়ে স্বাক্ষর করেন। পরে রায়ের অনুলিপি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল হয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছে। এর পর কারা কর্তৃপক্ষ কামারুজ্জামানকে রায়ের অনুলিপিটি পড়ে শোনান এবং রাষ্ট্রপতির কাছে সে প্রাণভিক্ষা চাইবে কিনা, সে বিষয়টি জানতে চান। পরে আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে প্রাণভিক্ষার বিষয়টি জানাবে বলে জানায় কামারুজ্জামান। এর পর তার ইচ্ছা অনুযায়ী বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় কামারুজ্জামানের আইনজীবীদের সাক্ষাত করতে চিঠি দেয় জেল কর্তৃপক্ষ। এর ফলে ওই দিনও জাতির আশা পূরণ হয়নি। অপেক্ষার চতুর্থ দিন (বৃহস্পতিবার) ॥ কারা কর্তৃপক্ষের চিঠি পেয়ে বৃহস্পতিবার কারাগারে পৌঁছেন। এর পর বেলা পৌনে ১২টার দিকে জেল গেটে কামারুজ্জামানের আইনজীবী সাবেক শিবির নেতা শিশির মনির সাংবাদিকদের বলেন, প্রাণভিক্ষার বিষয়ে সে চিন্তা-ভাবনা করবে এবং পরে তার সিদ্ধান্ত জানাবে। এ বিষয়ে কামারুজ্জামান ‘যৌক্তিক’ সময় নিতে চেয়েছে বলেও জানান আইনজীবীরা। তারা বলেন, প্রাণভিক্ষা চাইবে কিনা সে সিদ্ধান্ত সে নিজেই নেবে। আমাদের কাছে তিনি শুধু এ বিষয়ে আইনগত বিভিন্ন দিক জানতে চেয়েছে। আমরা সেসব বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছি। এর পর স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, বৃহস্পতিবারের মধ্যেই প্রাণভিক্ষার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কামারুজ্জামানকে। বৃহস্পতিবার বিকেলের মধ্যে কামারুজ্জামানের সিদ্ধান্ত জানতে একজন ম্যাজিস্ট্রেট তার কাছে যাবেন বলেও তিনি জানান। পরে দিনভর গণমাধ্যমকর্মীসহ গোটা জাতি ম্যাজিস্ট্রেট কারাগারে যাচ্ছেন এমন আশায় থাকলেও বৃহস্পতিবার তিনি যাননি। ফলে ওই দিন কামারুজ্জামানের মৃত্যুদ- কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। অপেক্ষার পঞ্চম দিন (শুক্রবার) ॥ রাষ্ট্রপতির কাছে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত কামারুজ্জামান প্রাণভিক্ষা চাইবে কিনা তা জানতে শুক্রবার সকাল দশটায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রবেশ করেন ম্যাজিস্ট্রেট মাহফুজ জামিল ও তানভীর মোঃ আজিম। বেলা ১১টা ৩৮ মিনিটে তারা কারাগার থেকে বের হন। কিন্তু তারা সাংবাদিকদের কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদনের বিষয়ে কোন মন্তব্য করেননি। ম্যাজিস্ট্রেটরা সাংবাদিকদের প্রশ্ন পাশ কাটিয়ে দ্রুত গাড়ি করে চলে যান। পরে জানা যায়, কামারুজ্জামান রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবে কিনা, তা জানতেই দুই ম্যাজিস্ট্রেট কারাগারে প্রবেশ করেছিলেন। তারা সম্মিলিতভাবে কনডেম সেলের সামনে দাঁড়িয়ে কামারুজ্জামান রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করবে কিনা, তা জানতে চান। পরে জানা যায়, কামারুজ্জামান প্রাণভিক্ষা চাইবে না বলেই ম্যাজিস্ট্রেটদের জানিয়েছে। সন্ধ্যা থেকেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকার নিরাপত্তা জোরদার শুরু হয়। মূল ফটকের সামনে নেয়া হয় দুই স্তরের নিরাপত্তা। এতেই গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে কারাগার এলাকায় যে, শুক্রবার রাতেই কামারুজ্জামানের ফাঁসি হচ্ছে। পরবর্তীতে সিভিল সার্জন, শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তা ও জেল সুপার কারাগারে প্রবেশ করেন। এসব আলামত কামারুজ্জামানের ফাঁসি শুক্রবার রাতেই কার্যকর হওয়ার বিষয়টি একপ্রকার নিশ্চিত করে। ফলে কারাগার এলাকায় মিডিয়া কর্মী ও সাধারণ মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে। ততক্ষণে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের আশপাশের উঁচু ভবনের ছাদে অতিরিক্ত পুলিশ ও র্যাব সদস্য মোতায়েন করা হয়। কারাগারের আশপাশের প্রায় আধা কিলোমিটার এলাকাজুড়ে সমস্ত রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়। রাস্তার মোড়ে মোড়ে বসানো হয় চেকপোস্ট। পরে রাত সাড়ে দশটার পর থেকেই কারাগারের নিরাপত্তা ব্যবস্থা শিথিল হতে থাকে। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা, কারা কর্তৃপক্ষ, পুলিশ ও র্যাবের কর্তাব্যক্তিরা কারাগার এলাকা ত্যাগ করতে থাকেন। রাত বারোটার দিকে কারাগার এলাকায় নিরাপত্তা থাকলেও কড়াকড়ি ছিল না। পরিস্থিতি ছিল একেবারেই স্বাভাবিক। তখনই বোঝা যায় শুক্রবার রাতে আর কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর হচ্ছে না। প্রত্যাশা পূরণ (শনিবার) ॥ অবশেষে শনিবার সকাল থেকেই বোঝা যায় কামারুজ্জামানের দণ্ড কার্যকর হচ্ছে। দিনভর চলে কামারুজ্জামানের দণ্ড কার্যকরের প্রস্তুতি। সে হিসেবে পরিবারের সদস্যদের শেষ দেখাও শেষ হয়।
×