ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ঔপনিবেশিকোত্তর ঔপনিবেশিক মন ॥ মুনতাসীর মামুন

মনোজগতে মুক্তিযুদ্ধের আধিপত্য না থাকলে দেশবোধের সৃষ্টি হবে কিভাবে?

প্রকাশিত: ০৩:৪৫, ১২ এপ্রিল ২০১৫

মনোজগতে মুক্তিযুদ্ধের আধিপত্য না থাকলে দেশবোধের সৃষ্টি হবে কিভাবে?

মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং পরে, এই তত্ত্বই আওয়ামী লীগ প্রচার করেছে যে, বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি করেছে আওয়ামী লীগ যার ফলে মুক্তিযুদ্ধ শুরু ও সফল হয়েছে। এ তত্ত্বের কারণে, ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত সমস্ত রাজনৈতিক দল, নেতা, বিশেষ করে জনতা এবং বামপন্থী বিশেষ করে কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা বাদ পড়ে যায়। এই তত্ত্ব মুক্তিযুদ্ধের সময় সোশ্যাল মবিলাইজেশনে এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জনমত সংগঠনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল। গতকালের পর আজ পড়ুন কমিউনিস্ট নেতা নাম্বুদ্রিপাদ তখন বলেছিলেন, ইন্দিরা গান্ধীর কর্তৃত্বমূলক শাসন ও ডানপন্থী সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে বামপন্থী কমিউনিস্ট দল লড়াই করছে এবং এখন তাদের সঙ্গে জোট বেঁধেছে অকমিউনিস্ট দলগুলো। এতেই দু’পক্ষ আতঙ্কিত হয়েছে। উল্লেখ্য, অরুণ শৌরি এ শতকে বিজেপি সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী হয়েছিলেন। [গৌতম চট্টোপাধ্যায়, অরুণ শৌরিস স্লান্ডারস রিবাটেড; হিস্ট্রি হ্যাজ ভিন্ডিকেটেড দ্য কমিউনিস্টস], কলকাতা, ১৯৮৪ এই ধরনের আঁতাত বিজেপিকে সহায়তা করেছে। পরবর্তীকালে বাবরি মসজিদ ঘটনায় ইতিহাস ব্যবহার করে তারা জনমত সংগঠন করেছে। তারা কতটা উগ্র জাতীয়তাবাদী, সাম্প্রদায়িক ও হিংসাত্মক হয়ে উঠতে পারে তা ব্যক্ত করেছেন কয়েকজন ঐতিহাসিক। “উর্দুকে বিদেশী ভাষা এবং দাসত্বের সূচক বলে নিন্দা করা হয়, যদিও উর্দুর জন্ম ভারতে। একটি প্রবন্ধের জোরালো আওয়াজ : ‘উর্দুর নামে আর একটি পাকিস্তান যেন না হয়।’ অনুরূপভাবে, ভারতীয় খ্রীস্টানরা সংস্কৃত বা হিন্দির পরিবর্তে ইংরেজী ভাষা ব্যবহার করে বলে তাদের নিন্দা করা হয়। জৈনধর্ম বা বৌদ্ধ ধর্মেরও অবমাননা করা হয়। কারণ, তারা অর্থনীতিক দার্শনিক চিন্তায় সেরকম কিছু প্রভাব রাখেনি।’ বিজেপি-ভিএইচপি-আরএসএসের বহুল প্রচার যে তারা মেকি ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে লড়াই করছে (সুতরাং তারাই আসল ধর্ম নিরপেক্ষ); এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে অর্গানাইজারের এই অনুচ্ছেদটি উল্লেখ করা যায় : হিন্দু শুধু চায় যে তার সংস্কৃতি মহিমা অর্জন করুক। সে হতবাক হয় যখন একজন মুসলমানকে রাষ্ট্রপতি আর একজন মুসলমানকে প্রধান বিচারপতি করার পরে তাঁকে বলা হয় যে, মুসলমানদের চাকরি দিচ্ছে না ... মুসলমানদের স্বীকার করতে হবে যে ভারত ঠিক ততটাই হিন্দু রাষ্ট্র যতটা মুসলমান রাষ্ট্র পাকিস্তান অথবা ব্রিটেন খ্রীস্টান রাষ্ট্র।” [তপন বসু, প্রদীপ দত্ত, সুমিত সরকার প্রমুখ, খাকিপ্যান্ট গেরুয়া ঝাণ্ডা, কলকাতা, ১৯৯৩] ৪. একই মনোভাব আমরা লক্ষ্য করি, সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান যখন বাংলাদেশে ক্ষমতা দখল করলেন। ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধান থেকে তিনি বাদ দিয়ে বাঙালী জাতীয়তাবাদকে পুনর্সংজ্ঞায়িত করলেন মুসলমানদের ইতিহাসের ইঙ্গিত করে। ক্ষমতা আরোহণের দু’বছর পর জেনারেল জিয়া সংবিধান সংশোধন করে বাঙালী জাতীয়তাবাদ উৎপাটন করে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ শব্দটি স্থাপন করলেন। আপাতত দৃষ্টিতে বিষয়টি তুচ্ছ মনে হতে পারে। কিন্তু, এই একটি শব্দই বাংলাদেশের মানুষকে দু’ভাগ করে দিয়েছে, জিয়া এই বিভক্তি চেয়েছিলেন তাঁর ক্ষমতার স্বার্থে এবং এর দ্বারা তিনি তাঁর ক্ষমতারোহণের যুক্তি তৈরি করতে চেয়েছিলেন ইতিহাসের আলোকে। এবং এ ঘটনা প্রমাণ করে যে, এই জেনারেল জাতির সঙ্গে কত বড় প্রতারণা করেছিলেন। এই ঘটনা আবার অন্যদিকে প্রমাণ করে তিনি বাধ্য হয়ে যুদ্ধে গিয়েছিলেন যার অনেক প্রমাণ বর্তমান; কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধার সম্মানের কারণে কেউ তা প্রকাশ করতে চায় না। ১৯৭২ সালে জেনারেল জিয়া সে সময়ের জনপ্রিয় সাপ্তাহিক বিচিত্রায় লিখেছিলেন, যেদিন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করলেন, উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা, “আমার মতে ঠিক সেই দিনই বাঙালী হৃদয়ে অঙ্কুরিত হয়েছিল বাঙালী জাতীয়তাবাদ, জন্ম হয়েছিল বাঙালী জাতির।” [জিয়াউর রহমান, বিচিত্রা, ১৯৭২] এখানে লক্ষ্যণীয় ‘বাঙালী হৃদয়’ ও ‘বাঙালী জাতীয়তাবাদ’ শব্দ দুটি। এর ঠিক পাঁচ বছর পর, জেনারেল জিয়া ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ অন্তর্ভুক্ত করলেন সংবিধানে সামরিক আইন মারফত বন্দুকের জোরে। তাঁর বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের তাত্ত্বিক কাঠামো তৈরি করে দিলেন সাংবাদিক খন্দকার আবদুল হামিদ। ১৯৭৬ সালে, ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একডেমির আলোচনা সভায় এক প্রবন্ধে তিনি বললেন, এই বৈশিষ্ট্যগুলোই “বাংলাদেশী জাতীয়তার উপাদান। এগুলো বাকল নয়, আসল সারাংশ। আর এই সারাংশই আমাদের বাংলাদেশী জাতীয়তার আসল শক্তি, ভিত্তি ও বুনিয়াদ।” খন্দকার আবদুল হামিদ, ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’, মুহম্মদ জাহাঙ্গীর সম্পাদিত জাতীয়তাবাদ বিতর্ক। ঢাকা, ১৯৮৭] এই জাতীয়তাবাদে যুক্ত হয়েছিল ধর্ম আর বাঙালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। মুক্তিযুদ্ধের এবং সংবিধানের মূলনীতির একটি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। জিয়াউর রহমান প্রচারিত বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ বাংলাদেশের মানুষকে স্পষ্টত দু’ভাগ করেছিল। এই জাতীয়তাবাদের অনুষঙ্গ হিসেবে প্রচলিত হলো এমন কিছু শব্দ যা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সেøাগানের বিপরীত। যেমন ‘জয় বাংলার’ পরিবর্তে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’। ‘আমার সোনার বাংলা’ পরিবর্তে ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ।’ অথচ জেনারেল জিয়া ১৯৭৫-এর পূর্ব পর্যন্ত ‘জয় বাংলা’ শব্দটি শুধু ব্যবহারই করতেন না কোন বাণী বা ভক্তকে স্বাক্ষর দেয়ার পরও লিখতেন ‘জয় বাংলা’। এভাবে তিনি নিজের স্থান করে নিতে চাইলেন ক্ষমতা ও বৈধতাসহ। ৫ বাংলাদেশে ইতিহাস নিয়ন্ত্রণ, পরিবর্তন ও অন্তিমে দখল করার প্রক্রিয়া আলোচনা করার আগে সার্বিকভাবে ‘নিয়ন্ত্রণ’ প্রত্যয়টি নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। এই নিয়ন্ত্রণ শাসক/রাষ্ট্র বিভিন্নভাবে করতে পারে। এক. ভাবনার জগতে আধিপত্য। দুই. রাষ্ট্রের বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার। তিন. রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের ভয় দেখিয়ে। দক্ষিণ এশিয়ায় কখনও কখনও এর যে কোন একটি বা সব ক’টি মাধ্যমে ব্যবহার করে ইতিহাস নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়েছে। প্রাক-পাকিস্তান পর্বে, এ ভূখণ্ডের মানুষের ভাবনার জগতে আধিপত্য সৃষ্টিতে চেষ্টা করা হয়েছে। পাকিস্তান আমলে রাষ্ট্রের বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে এ আধিপত্য বিস্তার ও বজায় রাখার চেষ্টা হয়েছে। এ আধিপত্য নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করেছে। বাংলাদেশে ওপরের তিনটি মাধ্যমেই ব্যবহৃত হচ্ছে। ১৯৭১-৭৫ পর্বে উপনিবেশবিরোধী ধারার জয়লাভের কারণ, ভাবনার জগতে সেই ধারাই আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হয়েছিল। শরীরে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ আন্দোলনের নেতারা জীবিত থাকায় এ আধিপত্য বিস্তৃত হয়েছে এবং মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শ সাংবিধানিক রূপ পেয়েছে। ১৯৭৫-এর পর এ ধারাকে হটিয়ে জায়গা করে নিতে হয়েছে বা হচ্ছে প্রাক-১৯৭১-এর কলোনির ইতিহাসের ধারাকে। সে ভাবাদর্শ আবার সঞ্চারিত করতে হচ্ছে। ১৯৯০-এর আগে এই সঞ্চারণে সাহায্য করেছে রাষ্ট্রের বিভিন্ন মাধ্যম। এভাবে আবারও ভাবনার জগতে কলোনির ইতিহাসের ধারা বিকশিত হয়েছে। এর একটি কারণ, স্বাধীন হলেও গত তিন দশকে বাংলাদেশের শ্রেণিবিন্যাসে বা অর্থনীতিতে মৌলিক পরিবর্তন তেমন হয়নি। ১৯৯০-১৯৯৫ এবং ২০০১-২০০৪ সালে, ইতিহাস নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রথম দুটি উপাদান ছাড়া তৃতীয় অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় নিপীড়নও ব্যবহৃত হয়েছে। এবং এর ফলে, ভাবনার জগতে আধিপত্য বিস্তারের যে সূক্ষ্ম স্তর থাকে তা না থাকায় নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি এখন সরাসরি দখলের পর্যায়ে চলে গেছে। নিয়ন্ত্রণে একটি আবরণ থাকে, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বন্দ্ব থাকে, সরাসরি দখলে তা আর থাকে না। এবং এটি অবিশ্বাস্য বলে পরিচিত হয়ে ওঠে। অন্তিমে অবশ্য তা শাসকের পতন ডেকে আনে। বাংলাদেশে ইতিহাসের ভাবাদর্শ বিস্তারের ক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীরা বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন। তাই এখানে বুদ্ধিজীবীদের বিষয়টি আলোচনা করব গ্রামসীর অনুসরণে। গ্রামসী দক্ষিণ ইতালির পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছিলেন। আর এর সঙ্গে মিল আছে এখনও বাংলাদেশের। ঔপনিবেশিক আমলে যে সমাজ গঠন হয়েছিল বাংলাদেশে এখন সে ব্যবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন হয়নি। গ্রামসী ভাবনার জগতে যে আধিপত্যের কথা বলেছেন, হালের নোয়াম চমস্কি সেই ‘হেজিমনি’র বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের পরিপ্রেক্ষিতে। যুক্তরাষ্ট্রে সম্পূর্ণ রাষ্ট্র বিশ্বজুড়ে তার আধিপত্য বিস্তারের পক্ষে। এ শতকের গোড়ায় মার্কিন নির্বাচনেও দেখা গেছে, ডেমোক্র্যাট পদপ্রার্থী জন কেরি তাঁর পুরনো উদারনৈতিক আদর্শের জন্য বিব্রত। তাঁকে বারবার প্রমাণ করতে হয়েছিল যে তাঁকে যতটা লিবারেল আখ্যা দেয়া হচ্ছে ততটা লিবারেল তিনি নন। এই হেজিমনিক ধারণা বিস্তৃতকরণে সাহায্য করছে যুক্তরাষ্ট্রের বড় কর্পোরেশনগুলো। চমস্কি লিখেছেন, যে কোন মূল্যে full spectrum dominance এর জন্য যুক্তরাষ্ট্রে কোন আন্তর্জাতিক সনদ মানতেও রাজি নয়। তাঁর ভাষায় “One can discern two trajectories in current history : One aiming toward hegemony acting rationally within a lunatic docrinal frame work as it threatens survival, the other dedicated to the beliey that another world is possible in the words that animate the world social forum, challenging the reigning idealogical system and seeking to create constructive alternatives of thought, action, and institutions. Which trajectory will dominate, no one can foretell. Then pattern is familiar throughout history, a crucial difference to day is that the stakes are far higher.” [নোয়াম চমস্কি, হেজেমনি অর সারভাইভাল : আমেরিকান কোয়েস্ট ফর গ্লোবাল ডমিনেন্স, লন্ডন, ২০০৩] এ আধিপত্য বিস্তারের জন্য শাসকরা দেশের অভ্যন্তরেও রাষ্ট্রশক্তিকে কীভাবে ব্যবহার করেন চমস্কি তাঁর গ্রন্থে তাও দেখিয়েছেন। দক্ষিণ এশিয়ায় বিশেষ করে পাকিস্তান ও বাংলাদেশে রাষ্ট্রের সমস্ত প্রতিষ্ঠান, নির্বাহী থেকে বিচার বিভাগ এবং বড় বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবহৃত হয় রাষ্ট্রীয় আধিপত্য বিস্তারে। এ জন্য প্রণীত হয় আইন। চমস্কি বর্তমান যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে যা উল্লেখ করেছেন তার অনেকটাই প্রযোজ্য বাংলাদেশ/পাকিস্তান সম্পর্কে। হেরফের যেটি সেটি হচ্ছে মাত্রার। দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে গ্রামসীর তত্ত্ব ও চমস্কির ধারণা দুটিই প্রয়োগ করা যেতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষ করে পাকিস্তান ও বাংলাদেশে ভাবনার জগতে আধিপত্যবাদ সৃষ্টি করেছে শাসকরা কীভাবে উপর্যুক্ত আলোচনা তার প্রমাণ। এই আধিপত্য বিস্তারে গ্রামসী উল্লিখিত বুদ্ধিজীবী, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে যেখানে ধর্মের প্রভাব প্রবল-শিক্ষা, আইন সবই ব্যবহার করা হয়। শিক্ষার ক্ষেত্রে পাঠ্যপুস্তকে নিজেদের ধ্যান ধারণার বিস্তার ঘটানো, সামরিক আইনকে পরবর্তীকালে সিভিল আইনে রূপদান ও বিভিন্ন নিবর্তনমূলক আইন পাস করা হয় সমাজ শাসনে। অর্থনৈতিক সুবিধা দিয়ে আমলাতন্ত্র বিশেষ করে সামরিক আমলা, রাজনৈতিক টাউট ও ক্যাডার, ব্যবসায়ী শ্রেণী সৃষ্টি করা হয় যারা শাসকদের মতাদর্শ সংরক্ষণ ও পরিপোষণ করে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সহয়তা পায় প্রায়-ই, কারণ তারা তাদের ‘doctrinal frame work’-এর কারণে এদের সমর্থন করে। বাংলাদেশে যেসব শাসকদের কথা আলোচনা করা হয়েছে তাদের কর্মকাণ্ড ও পররাষ্ট্রনীতি পর্যবেক্ষণ করলে আধিপত্য বা নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি স্পষ্ট হবে। পাকিস্তানের ইসলামী আদর্শ যা আমাদের মনোজগতে প্রোথিত করার চেষ্টা করা হয়েছিল তা হলোÑ পাকিস্তান : মুসলমান যারা শৌর্য বীর্যে শ্রেষ্ঠ। ভারত : হিন্দু, শৌর্যে বীর্যে যারা অধস্তন। পূর্ববঙ্গ/ পূর্ব পাকিস্তানের যোগ আছে ভারতীয়দের সঙ্গে। মুসলমান হলেও তারা ঠিক ততটা মুসলমান নয় যতটা মুসলমান পশ্চিম পাকিস্তানীরা। সুতরাং, হিন্দুদের বিরুদ্ধে পাকিস্তান থাকবে পূর্ব পাকিস্তানসহ, তবে পূর্ব পাকিস্তানী বা বাঙালীরা অধস্তন হবে। ১৯৬৭ সালেও দেখি মুসলিম লীগের মুখপত্র ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক আজাদ ঐ ইতিহাস নিয়েই চিৎকার করছেÑ “পাকিস্তান এছলামী আদর্শ বাস্তবায়নে সুস্পষ্ট কর্মসূচী লইয়া দুনিয়ার বুকে জন্মলাভ করিয়াছে। আমরা পাকিস্তানীরা চাই স্বকীয় তাহজীব তমুদ্দনের পরিপন্থী কোন প্রচেষ্টাই বরদাশত করিতে পারি না। রবীন্দ্রনাথ বহু সঙ্গীতে মুসলিম তমদ্দুনকে অবজ্ঞা প্রদর্শন করিয়া হিন্দু সংস্কৃতির জয়গান গাহিয়াছেন। সুতরাং পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথমদিন হইতেই এই সকল সঙ্গীতের আবর্জনা হইতে রেডিও-টেলিভিশনে পবিত্র রাখা প্রয়োজন ছিল। তাই বিলম্বে হইলেও সরকার এই সঙ্গীত পরিবেশন বন্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়া জনগণের প্রশংসাভাজন হইয়াছেন। আমরা সরকারের এই মহৎ প্রচেষ্টাকে অভিনন্দন জানাইতেছি।” এই ছিল পাকিস্তানী মতাদর্শ যার মূল বিষয়ই ছিল সাম্প্রদায়িকতা, জাতিগত বিভেদ। আরও লক্ষ্য করুন। দৈনিক আজাদের বানানরীতি যা তাদের মতে ছিল ইসলামী বাংলা। এবং কত আক্রমণাত্মক। আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খানের দৃষ্টিভঙ্গিও ছিল একই রকম। ছাত্র জীবনে আমরা যে ইতিহাস পড়েছি পাকিস্তান আমলে, সেখানে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত গুরুত্ব দেয়া হয়েছে সেখানে পূর্ব পাকিস্তান/পূর্ববঙ্গের ইতিহাস প্রায় ছিল না বললেই চলে। এরপর এসেছে ১৯৭১। পাকিস্তানের বর্তমানের ইতিহাসের কোন উল্লেখ নেই। গত এক দশকে আমি কয়েকবার পাকিস্তান গিয়েছি। বিভিন্ন পর্যায়ের নীতিনির্ধারক ও বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। খুব কম মানুষই বাঙালীদের বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরেছেন। পাকিস্তান তত্ত্ব তাদের এতটাই আচ্ছন্ন করে রেখেছে যে, লিবারেল বলে পরিচিত হলেও দেখা গেছে ঐ তত্ত্ব একেবারে পরিত্যাগ করা যায়নি। অধিকাংশই স্বীকার করতে চান না যে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যা হয়েছে কারণ তারা তা জানতেন না। এখনও তাদের ধারণা এখানকার পাকিস্তানীরা ভারতীয় অর্থাৎ হিন্দু প্রভাবান্বিত। তাই বাঙালীরা সমপর্যায়ের হতে পারে না। এবং পাকিস্তান ভাঙার জন্য ভারতই দায়ী। একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। ১৯৭১ সালের ঘটনাবলী নিয়ে মেজর জেনারেল ফজল মুকিম খাঁ একটি বই লিখেছেন। তাতে বলেছেন “The Pakistan cause came to be connected with west Pakistan only.Thus the internal disenssions were being fostered do destroy Pakistan and regional affinities were being encouraged and Pakistan patriotism downgraded. The seeds of the crisis between East and West Pakistan, swon by Professors and Teachers of the minority community, yielded a flourshing crop. In twenty-four years, the type of education imparted to them together with insistent Indian propaganda changed the East Pakistani Muslims to Bengalis. A considerable reaction of young East Pakistan was therefore the first to break away from Pakistan and its basis [মুনতাসীর মামুন, পরাজিত পাকিস্তানী জেনারেলদের দৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধ, ঢাকা, ১৯৯৯] (চলবে)
×