ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এমআরপি না পেলে লাখ লাখ প্রবাসীকে ফিরে আসতে হবে

প্রকাশিত: ০৬:৩৬, ১১ এপ্রিল ২০১৫

এমআরপি না পেলে লাখ লাখ প্রবাসীকে ফিরে আসতে হবে

ফিরোজ মান্না ॥ চলতি বছর নবেম্বরে শেষ হচ্ছে এমআরপি দেয়ার সময়সীমা। এই সময়ের মধ্যে এমআরপি হাতে না পেলে লাখ লাখ প্রবাসীকে দেশে ফিরতে হবে। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে এমআরপি দেয়া সম্ভব হবে না বলে প্রতিনিয়ত প্রবাসীরা অভিযোগ জানিয়ে আসছেন। তারা এমন কথাও জানিয়েছেন, এমআরপি দেয়া নিয়ে দূতাবাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। টাকা না দিলে এমআরপি দেয়া হচ্ছে নাÑ এমন অভিযোগের কথা অস্বীকার করে এমআরপি (মেশিন রিডেবল পাসপোর্র্ট) নিয়ে গঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি বলছে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই এমআরপি দেয়ার কাজ শেষ হবে। অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়টি তাদের কানে এলেও এখন পর্যন্ত কোন দূতাবাস বা হাইকমিশনের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। তবে অনিয়মের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। এমআরপির কারণে কোন প্রবাসীকেই দেশে ফিরতে হবে না, এটা নিশ্চিত করা হয়েছে। বিভিন্ন দূতাবাস ও হাইকমিশনে অতিরিক্ত লোকবল কাজ করছে। এদিকে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, প্রবাসীদের এমআরপি দেয়ার কাজ যথাসময়ের আগেই শেষ হবে। এখন পর্যন্ত ৬৬ লাখ প্রবাসীর হাতে এমআরপি তুলে দেয়া হয়েছে। ৩৫ থেকে ৩৬ লাখ প্রবাসীর হাতে এমআরপি দেয়ার কাজ বাকি রয়েছে। এই পাসপোর্টগুলো ২৪ নবেম্বরের মধ্যে দেয়া শেষ হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। যদিও প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন দুই সপ্তাহ আগেই অভিযোগ করে বলেন, এমআরপি নিয়ে ২০১৫ সালে বড় ধরনের সমস্যা হতে পারে। এ সম্পর্কে আরও দুই বছর আগেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সময়মতো বিষয়টি নিয়ে যথাযথ উদ্যোগ না নেয়ায় প্রবাসীদের জন্য বড় ধরনের সঙ্কটে পড়তে হচ্ছে। সেই সময় তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন পররাষ্ট্র ও বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে। ওই পরামর্শে বলা হয়েছিল মোবাইল টিম গঠন করে প্রবাসীদের হাতে এমআরপি দেয়ার জন্য। এই দুটি মন্ত্রণালয় ক্র্যাশ প্রোগ্রাম হাতে নিয়ে কাজটি শেষ করতে পারত। এখন যে সঙ্কট তৈরি হয়েছে তা সহজেই এড়ানো সম্ভব হতো। দেশে-বিদেশে এমআরপি নিয়ে চরম হৈচৈ শুরু হয় যখন আইকাওয়ের প্রেসিডেন্ট অনুরোধ নাকচ করে দিয়ে সাফ জানিয়ে দিয়েছে, এমআরপি দেয়ার সময়সীমা আর বাড়ানো হবে না। এখন আইকাওয়ের আর কিছু করার নেই। আইকাওয়ের এই জবাবের পর নড়েচড়ে বসেছে বাংলাদেশ সরকার। স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ওই ঘোষণার পর বেশ কয়েক দফা আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক করেছে। এখন আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকের পর বলা হচ্ছে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই প্রবাসীদের হাতে এমআরপি তুলে দেয়া সম্ভব হবে। বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যেই এমআরপির কাজ শেষ করার জন্য বিভিন্ন দূতাবাস ও হাইকমিশনে বাড়তি জনবল নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আন্তঃমন্ত্রণালয়ের গঠিত কমিটির ঘোষণা কতটা সত্য হয় তা দেখার জন্য এ বছরের নবেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কারণ, এর আগে বাংলাদেশ এমআরপির বিষয়ে আরও কয়েক দফা সময়সীমা বাড়িয়ে নিয়েছে। তারপরও বাংলাদেশ প্রবাসীদের এমআরপি দিতে পারেনি। এখন চূড়ান্ত দিন-তারিখ বেঁধে দেয়া হয়েছে। এই সময়ের পর আর কোন সময় দেয়া হবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে আইকাও। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব শহিদুল হক জনকণ্ঠকে জানান, বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। প্রতিটি দূতাবাস ও হাইকমিশনে বাড়তি জনবল নিয়োগ করা হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই এমআরপি প্রবাসীদের হাতে তুলে দেয়া সম্ভব হবে। এমআরপির জন্য আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, যেসব দেশে প্রবাসীর সংখ্যা বেশি সেসব দেশে মোবাইল টিম কাজ করবে; যাতে কর্মীদের কষ্ট করে দূতাবাস বা হাইকমিশনে আসতে না হয়। দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ বিদেশে কাজ করছেন। তাদের কথা চিন্তা করেই এমআরপির কাজটি দ্রুত ও দক্ষতার সঙ্গে করা হচ্ছে। বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বিষয়টি নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। যথাসময়েই এমআরপি প্রবাসীদের হাতে তুলে দেয়া হবে। আইকাওয়ের বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যেই এমআরপি দেয়া হবে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে গত ১৪ জানুয়ারি কানাডায় নিযুক্ত বাংলাদেশের নিযুক্ত হাইকমিশনার কামরুল আহসান বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী মন্ট্রিলে আইকাও প্রেসিডেন্ট ওলুমইয়া ব্র্যান্ড অলিউরের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। সাক্ষাতে তিনি বাংলাদেশ থেকে বিপুলসংখ্যক প্রবাসীর চলতি বছরের ২৪ নবেম্বরের আগে এমআরপি পাসপোর্ট দেয়ার বিষয়ে সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরেন। হাইকমিশনার বলেন, গত মাস পর্যন্ত মাত্র ২৫ শতাংশ প্রবাসীকে এমআরপি পাসপোর্ট দেয়া সম্ভব হয়েছে। এ অবস্থায় আরও ৭৫ শতাংশ প্রবাসীকে পাসপোর্ট দিতে প্রায় তিন বছর সময় লেগে যেতে পারে। এ কারণে তিনি এমআরপি ব্যবহারের বাধ্যবাধকতার সময়সীমা এ বছরের ২৪ নবেম্বর থেকে বাড়িয়ে ২০১৮ সালের ২৪ নবেম্বর করার অনুরোধ জানান। হাইকমিশনারের এই অনুরোধ আইকাও প্রেসিডেন্ট নাকচ করে দিয়েছেন। আইকাও প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশের হাইকমিশনারকে বলেন, আইকাওয়ের কোন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে হলে আইকাও কাউন্সিলের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের মতামত প্রয়োজন রয়েছে। কিন্ত আইকাও’র আগামী গ্রীষ্মকালীন কাউন্সিল অধিবেশনের আলোচ্যসূচীতে এ ধরনের কোন এজেন্ডা ছিল না। এ জন্য চলতি বছরের ২৪ নবেম্বরের মধ্যে হাতে লেখা পাসপোর্ট ব্যবহার করা যাবে। এরপর আর হাতে লেখা পাসপোর্ট ব্যবহার করা যাবে না। বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম জানান, এমআরপির সমস্যা এখন একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের কর্মী যেখানে রয়েছে সেখানেই এই সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। মালয়েশিয়ায় আমরা এ বিষয়ে সফল হয়েছি অনেক কষ্ট করে। মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের কর্মী সংখ্যা অনেক বেশি। এদের এমআরপি যথাসময়ে দিতে না পারলে তারা চরম বিপদে পড়বেন। তাই বিষয়টি নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পাসপোর্ট অধিদফতর ও বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত-হাইকমিশনারদের নিয়ে বৈঠক করা হয়েছে। বৈঠকে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত হয়েছে। জটিলতা নিরসন করে আমরা এমআরপি যথাসময়ে প্রবাসীদের হাতে তুলে দিতে পারব। সরকারের সিদ্ধান্তে প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন্য আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট দেয়া হবে। আউট সোর্সিংয়ের জন্য যে প্রতিষ্ঠান কাজ পেয়েছে তাদের লোকবল ও মেশিনারিজ যথেষ্ট পরিমাণ নেই। এই বিপুলসংখ্যক মানুষকে এমআরপি দিতে হলে অবশ্যই লোকবল বাড়াতে হবে। বেশ কয়েকটি দূতাবাস ও হাইকমিশনে বাড়তি লোকবল পাঠানো হয়েছে। যদিও এমআরপি দেয়ার বিষয়টি পুরোপুরি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাজ। কিন্তু এখানে যেহেতু দূতাবাস ও হাইকমিশন জড়িত রয়েছে। তাই বিষয়টির দায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওপরও এসে পড়ে। সেই দায় থেকেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে। তাই আমরা এ বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি। যেভাবেই হোক এমআরপি নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই দেয়া হবে। এদিকে অনেক দেশ থেকে প্রবাসীরা প্রতিনিয়ত টেলিফোনে অভিযোগ করছেন, তাদের কাছ থেকে এমআরপি ফি’র বাইরে ১০ থেকে ১৫ হাজার করে টাকা বেশি নেয়া হচ্ছে। এই টাকা না দিলে এমআরপি পাওয়া যাচ্ছে না। দূতাবাস বা হাইকমিশনের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রবাসীদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে নিচ্ছেন। এতে বিদেশে অবস্থিত ৮৫ থেকে ৯০ লাখ প্রবাসীর কাছ থেকে এমআরপি বাবদ কয়েক হাজার কোটি টাকা তারা হাতিয়ে নেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যদিও বিষয়টি আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে বলা হয়Ñকোন দূতাবাস ও হাইকমিশনের কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
×