ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ফাঁসিতে ঝুলিয়ে যেভাবে কার্যকর হয় মৃত্যুদণ্ড

প্রকাশিত: ০৬:৩১, ১১ এপ্রিল ২০১৫

ফাঁসিতে ঝুলিয়ে যেভাবে কার্যকর হয় মৃত্যুদণ্ড

শংকর কুমার দে ॥ যেভাবে একজন দ-িত ফাঁসির কয়েদীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় তা জানা গেল এক উর্ধতন কারাকর্মকর্তার জবানীতে। জেল সুপারের হাতে থাকে লাল রুমাল। লাল রুমাল নামিয়ে ফেলবে জেল সুপার, অমনি কপিকলের গিয়ারে টান দেবে জল্লাদ। গর্তের ওপর থাকা পাঠাতনের কাঠ সরে যাবে। ফাঁসির রুজুতে গর্তের ভেতরে ঝুলতে থাকেন দণ্ডিত কয়েদী। নির্দিষ্ট সময় ঝুলিয়ে রাখার পর নিচের দিকে থাকা গর্তের গেটে প্রবেশ করেন জল্লাদরা। মরদেহ গর্ত থেকে টেনে মঞ্চে উঠানো হয়। তারপর দড়ি খুলে মরদেহ রাখা হয় ফাঁসির মঞ্চের উপস্থিতদের সামনে।এভাবেই হয়ে যায় দণ্ডিত কয়েদীর ফাঁসি কার্যকর। ফাঁসি কার্যকর করার এই পদ্ধতিটি, দড়িতে ঝুলিয়ে ফাঁসি কার্যকর করার প্রত্যক্ষদর্শী ও কারা কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে । ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, দ-িত কয়েদীর ফাঁসি কার্যকর করার আগে মহড়া অনুষ্ঠিত হয়। জল্লাদদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন ডাক্তার। ফাঁসির রায় কার্যকর করার সময়ে ফাঁসির মঞ্চের সামনে উপস্থিত থাকেন ম্যাজিস্ট্রেট, সিভিল সার্জন, কারা কর্মকর্তা, পুলিশ, জল্লাদসহ উর্ধতন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। দ-িত কয়েদীর গলায় ফাঁস লাগিয়ে ঝুলানোর জন্য ব্রিটিশ আমলের তৈরি ম্যানিলা রোপ (দড়ি) পিচ্ছিল করে জল্লাদরা। ম্যানিলা রশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন উর্ধতন কারা কর্মকর্তারাও। রশিতে মাখানো হয় তেল আর পাকা কলা। যে পাটাতনটির উপর দণ্ডিত কয়েদীকে দাঁড় করানো হবে সেই পাটাতন পরীক্ষ-নিরীক্ষা করা হয় কয়েক দফায়। পাটাতন ও রশির কপিকলগুলোতে দেয়া হয় বিশেষ ধরনের তেল। ফাঁসি কার্যকর করার সময়ে বিশেষ ইঙ্গিত বুঝানোর জন্য বিশেষ লাল রুমাল থাকে জেল সুপারের হাতে। লাল রুমাল ফেলে দিতেই জল্লাদ কপিকলের গিয়ারে টান দেয়, অমনি ফাঁসিতে ঝুলে যায় দ-িত কয়েদী। ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর, এভাবেই মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আরেক জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড এভাবেই কার্যকর করা হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, রাতের আঁধার ভেদ করে ফাঁসির মঞ্চের সার্চ লাইটের আলো ছড়ায় কারাগারের ভেতরে বাইরে। ফাঁসি দেয়ার আগে কয়েদীকে মৃত্যু পরোয়ান পড়ে শোনানো হয়। কি খেতে চান, শেষ ইচ্ছার কথা জানতে চাওয়া হয়। রক্তচাপসহ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেন একজন সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে ডাক্তার। গোসল করানো হয়। নিয়মনীতি অনুযায়ী একজন ফাঁসির কয়েদীকে মৌলভী এনে তওবা করানো হয়। ফাঁসি দেয়ার আগে প্রথমে কনডেম সেলে গিয়ে দ-িত ব্যক্তিকে কালেমা পড়ান হয়। সামনেই থাকেন একজন ইমাম। কালেমা পড়ানোর পর কালো রংয়ের জমটুপি পরিয়ে মাথা ও মুখম-ল ঢেকে দেয়া হয়। দু’হাত পেছন দিকে বাঁধা হয়। এর পর দ-িতকে নিয়ে কনডেম সেলের সামনের খালি জায়গা ধরে হেঁটে বেরিয়ে যান জল্লাদরা। জল্লাদ ধরে, ধীরে ধীরে হাঁটিয়ে নিয়ে যায় ফাঁসির মঞ্চে। একটু দক্ষিণে গিয়ে ফাঁসির মূল মঞ্চ সামনে রেখে চলে যান পশ্চিমে। সেখান থেকে ঘুরে উত্তরে এগোলেই মূল ফাঁসির মঞ্চের সিঁড়ি। সিঁড়ির পাঁচটি ধাপ পেরিয়ে মঞ্চে উঠতে হয়। মঞ্চে ওঠানোর পর যে গর্তটি কাঠের পাটাতন দিয়ে ঢাকা থাকে সেখানে দাঁড় করানো হয় দ-িতকে। এরপর দু’পা সাদা কাপড় দিয়ে বাঁধা হয়। তারপর ফাঁসির মঞ্চের সামনে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আদেশ দানের অপেক্ষায় থাকেন ম্যাজিস্ট্রেটসহ কারা কর্মকর্তারা। ঘড়ি দেখে ইশারা দিতেই কারা কর্মকর্তার হাতের লাল রুমাল পড়ে যাবে, অমনি জল্লাদ ফাঁসির মঞ্চের কপিকলের দঁড়িতে টান দেবে। ফাঁসির রশিতে ঝুলে কূপের ভেতরে পড়ে দড়িতে ঝুলতে থাকে দ-িত। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের একজন কর্মকর্তা জানান, সর্বোচ্চ আদালতে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় বহাল রাখার পর এবং রায়ের কপি কারাগারে পৌঁছানোর আগে পরে ফাঁসি কার্যকরের প্রক্রিয়ার মহড়া অনুষ্ঠিত হয়েছে কয়েক দফায়। এ জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে জনি, রাজু, পল্টু, আলমগীর, এরশাদ, সাত্তার, রানাসহ দশ থেকে বারো জন জল্লাদকে। জল্লাদরা ফাঁসিতে ঝুলানোর মহড়া দিয়েছে। এর মধ্যে জল্লাদ জনির নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়। সেই জনির নেতৃত্বেই কাদের মোল্লার পর এবারও কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় কার্যকর করার মহড়া দেয়া হয়েছে। কাদের মোল্লাকে যেই ফাঁসির মঞ্চে ঝুলানো হয়েছে, সেই ফাঁসির মঞ্চেই ঝুলানোর জন্য দেয়া হয়েছে মহড়া। ফাঁসির মঞ্চের সামনে বসানো হয়েছে ইলেকট্রিক কেবল ও উচ্চ আলোর বাল্ব, সার্চ লাইট। কারাকর্তৃপক্ষ এখন ফাঁসি কার্যকর করার সব প্রস্তুতিই নিয়ে আছে সময়ের অপেক্ষায়। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের একজন কারা কর্মকর্তা জানান, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের এক কোনার দিকে রয়েছে ফাঁসির মূল মঞ্চ। ফাঁসির মঞ্চের দৈর্ঘ্য ৮ ফুট ও প্রস্থ সাড়ে ৪ ফুট। পাশাপাশি দু’জন দ-প্রাপ্তের মৃত্যুদ- কার্যকর করার ব্যবস্থা রয়েছে ফাঁসির মঞ্চে। মঞ্চের উপরে যে ফাঁসির কাষ্ঠ তার উচ্চতা ৮ ফুট। আর মঞ্চ থেকে নিচের দিকে যে গর্ত আছে তা ১২ ফুট গভীর। গর্তটি কাঠের পাটাতন দিয়ে ঢাকা। ফাঁসি কাষ্ঠের লাগোয়া উত্তর দিকে আছে কপিকলের গিয়ার। এই কপিকলের সঙ্গে ফাঁসির দড়ির একপ্রান্তে লাগানো থাকে। যেই দঁড়ি দিয়ে ঝুলানো হবে সেটা থাকে ফাঁসির কাষ্ঠের আরেক প্রান্তে। কপিকলের গিয়ারের দায়িত্ব থাকে একজনের কাছে। তার পাশে পূর্ব দিকে আরও তিনজন অবস্থান নেন। মূল মঞ্চসহ পুরো ফাঁসির মঞ্চটি আরও বড়। মূল মঞ্চের পূর্ব দিকে রয়েছে ৩টি কনডেম সেল। দক্ষিণে একটি লম্বা টেবিল আছে, যার পাশে বসতে পারেন অন্তত ১০ জন। তার সামনে আরেকটি টেবিল থাকে, যাতে ফাঁসি কার্যকর করার পর রাখা হয় মৃতদেহ। ফাঁসি কার্যকর করার সময়ে সতর্ক প্রহরায় অবস্থান নেয় অন্তত ১০ জন সশস্ত্র কারারক্ষী। সবার হাতে থাকে ভারি আগ্নেয়াস্ত্র। একটি ফাঁসির দ- কার্যকর করতে সময় লাগে সর্বোচ্চ ৩০ মিনিট। আনুষ্ঠানিকতা শেষে মূল ফাঁসির মঞ্চে সময় নেয় ১৭ মিনিট। মূল ফাঁসির মঞ্চের কাছেই আছে তিনটি কনডেম সেল। ফাঁসি দেয়ার আগে দ-প্রাপ্ত আসামিকে রাখা হয় এই কনডেম সেলেই। কনডেম সেল থেকে ফাঁসির মঞ্চের দূরত্ব ৫০ গজেরও কম। জল্লাদরা কনডেম সেল থেকে দ-িতকে হাঁটিয়ে নেন মূল ফাঁসির মঞ্চে। ফাঁসির মঞ্চের কপিকলের গিয়ারের কাছে অবস্থান নেয়া ব্যক্তিরা প্রস্তুত হন। জলাদরা ফাঁসির রজ্জু পরিয়ে দেয় দ-িতের গলায়। কনডেম সেল থেকে মঞ্চ পর্যন্ত এ সকল আনুষ্ঠানিতা সম্পন্ন করে একজন কয়েদিকে নিতে সময় লাগে ৮ থেকে ১০ মিনিট। ১৭ মিনিট ঝুলিয়ে রাখার পর নিচের দিকে থাকা গর্তের গেট দিয়ে গর্তের ভেতরে প্রবেশ করেন জল্লাদরা। মরদেহ আবার গর্ত থেকে টেনে মঞ্চে ওঠানো হয়। তারপর দড়ি খুলে মরদেহ রাখা হয় সরকারের প্রতিনিধি ও কারা কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিদের সামনে রাখা টেবিলে। লাশ নেয়া হয় পাশের মর্গে। স্পাইনাল কর্ড ও হাত-পায়ের রগ কেটে দেয়া হয়। তারপর ময়নাতদন্ত শেষে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এভাবে আধা ঘণ্টায় শেষ হয় মৃত্যুদ- কার্যকরের যাবতীয় আনুষ্ঠনিকতা। এখন ফাঁসির মঞ্চ লাগোয়া কনডেম সেলেই আছেন মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত মুহাম্মদ কামারুজ্জামান।
×