ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাংলা সন আমাদের ঐতিহ্য

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ১০ এপ্রিল ২০১৫

বাংলা সন আমাদের ঐতিহ্য

বাংলা সন যে হিজরী চান্দ্র সনেরই সৌররূপ তা সর্বজনবিদিত। বাংলাদেশের শতকরা নব্বই ভাগ মানুষ মুসলিম। এই বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর হৃদয়-মনে বিম্বিত, গ্রন্থিত ও লালিত বিশ্বাসের শাশ্বত আলোকধারার চির সুন্দর উৎস থেকে উদ্ভূত ও উৎসারিত রুচিনীতি যে আলোকোজ্জ্বল ও পরিচ্ছন্ন রুচিবোধের সুরম্য সড়ক নির্মাণ করেছে সেটাই এ দেশের মানুষের সংস্কৃতির আসল পরিচয়। একটি জাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সেই জাতির প্রকৃত পরিচয় বিশ্ব দরবারে সমুন্নত করে তোলে এবং সেই জাতির নিজস্বতাকে সুদৃঢ় বুনিয়াদের ওপর সংস্থাপিত করে। সেই বুনিয়াদের ওপর গড়ে ওঠা সুবিশাল সাংস্কৃতিক বলয় অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ থেকে, বিপরীতমুখী সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকে জাতিকে রক্ষা করে এবং সেই জাতির স্বকীয়তাকেও রক্ষা করে। সংস্কৃতির নানামাত্রিক উপাদান রয়েছে। সন বা বর্ষ গণনারীতি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রধান প্রধান উপাদানসমূহের অন্যতম। বাংলাদেশে বর্তমানে যে সনগুলোর প্রচলন রয়েছে তা হচ্ছে হিজরী সন, বাংলা সন ও ইংরেজী সন। ইংরেজী সনকে সংক্ষেপে বলা হয় এডি যার, পূর্ণ বাক্য হচ্ছে অহহড় উড়সরহরং অর্থাৎ আমাদের প্রভুর বছরে। এই ইংরেজী সন আমাদের দেশে খ্রিস্টাব্দ হিসেবে পরিচিত। কেউ কেউ ইংরেজী সনকে ঈসায়ী সন বলার প্রয়াসী হন, কিন্তু মওলানা আকরম খাঁ সম্পাদিত মাসিক মোহাম্মদীতে খ্রিস্টাব্দ ঈসাব্দ শীর্ষক আলোচনায় ঈসাব্দ লেখায় আপত্তি জানিয়ে বলা হয় যে, বাইবেলে বর্ণিত যিশুখ্রিস্ট এবং কুরআনে বর্ণিত হযরত ঈসার শিক্ষা ও জীবনের আদর্শ সম্বন্ধে অনেক পার্থক্য দেখা যায়। বাইবেলের যিশু ও কুরআনের ঈসা দু’জন সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ব্যক্তি। খ্রিস্টাব্দকে ঈসাব্দ বলিয়া গ্রহণ করিলে উভয়ের অভিন্নতা স্বীকার করা হয়। (দ্র. মাসিক মোহাম্মদী, ১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা, অগ্রহায়ণ, ১৩৩৪ সাল, পৃষ্ঠা ১৩৪-১৩৫)। সে যাক, বাংলাদেশে ইংরেজী ক্যালেন্ডারের ব্যবহার শুরু হয় ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত পলাশী বিপর্যয়ের পর। আর এখানে হিজরী সনের প্রচলন শুরু হয় হিজরী সনের প্রবর্তক হযরত উমর রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্্হুর খিলাফতকালের মধ্যভাগে অর্থাৎ ৬৪০ খ্রিস্টাব্দের দিকে যখন বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম প্রচার শুরু হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, একটি ইসলামী পঞ্জিকার প্রয়োজনীয়তার প্রেক্ষিতে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লামের মক্কা মুর্ক্রামা থেকে মদীনা মনওয়ারায় হিযরতের বছর অর্থাৎ ৬২২ খ্রিস্টাব্দকে প্রথম বছর ধরে ৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ হিযরতের ঘটনার ১৬ বছর পর এই ঘটনাকে অবিস্মরণীয় করে রাখবার জন্য হিজরী সনের প্রবর্তন করা হয়। ১২০১ খ্রিস্টাব্দের ইখতিয়ারুদ্দীন মুহম্মদ বিন বখ্্তিয়ার খিলজী কর্তৃক বাংলা বিজয়ের মধ্য দিয়ে এখানে মুসলিম শাসনের বুনিয়াদ স্থাপিত হলে হিজরী সনকে এখানকার রাষ্ট্রীয় সন হিসেবে গ্রহণ করা হয় এবং সরকারী কাজকর্মে এই সনের ব্যবহার শুরু হয়, যা এদেশে ব্রিটিশ শাসন কায়েমের পূর্ব পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। হিজরী সন একটি চান্দ্র সন। এর সঙ্গে মুসলমানদের বহু আচার-অনুষ্ঠান ও ইবাদত-বন্দেগীর দিন-রাত্রি ও মাস ও তারিখের সুনির্দিষ্ট হিসাব সম্পৃক্ত থাকায় এর গুরুত্ব যেদিন এখানে ইসলাম এসেছে সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত এবং অনাগত ভবিষ্যত পর্যন্ত সমানভাবেই রয়েছে এবং থাকবে। হিজরী সন অতি পবিত্র সন। মুঘল বাদশাহ জালালুদ্দীন মুহম্মদ আকবরের আমলে হিজরী সনের মর্যাদা অক্ষুণœ রেখে শুধুমাত্র রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে একটি সৌর সনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কারণ হিজরী সন চাঁদের পরিক্রমার হিসাবে গণনা করায় ঋতুর সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক থাকে না। যে কারণে রাজস্ব আদায়ের জন্য দীর্ঘমেয়াদী সুনির্দিষ্ট মাস নির্ধারণ করে দিলে কয়েক বছর পরপরই প্রজা সাধারণ রাজস্ব পরিশোধ করার ক্ষেত্রে দারুণ কষ্টের সম্মুখীন হতো। আর সৌর সনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে একে গণনা করা হয় সূর্য পরিক্রমার হিসাবে, যে কারণে এর মাসগুলো ঋতুর সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত থাকে। চান্দ্র সনের বছর হয় প্রায় ৩৫৪ দিনে আর সৌর সনের বছর হয় প্রায় ৩৬৫ দি॥ে যে কারণে ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে বাদশাহ আকবরের নির্দেশে আমীর ফতেহ্্ উল্লাহ্ সিরাজী তদানীন্তনকালের নানা পঞ্জিকা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে হিজরী চান্দ্র সনকে সৌর গণনায় এনে অর্থাৎ ৩৫৪ দিনে বর্ষ গণনার স্থলে ৩৬৫ দিনের বর্ষ গণনায় এনে যে নতুন সন উদ্ভাবন করেন সেটিই আমাদের বাংলা সন। ফতেহ্্ উল্লাহ্ সিরাজী হিজরী সনকে সৌর সনের গণনায় আনবার এই রীতি উদ্ভাবন করে তা বাদশাহর দরবারে পেশ করেন। এই নতুন বর্ষ বণনার শুরুর বছর হিসাব ধরা হয় আকবরের মসনদে আরোহণের বছর অর্থাৎ ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ মুতাবিক ৯৬৩ হিজরীকে। হিজরী সনকে সৌর গণনায় আনার ফলে এর নির্দিষ্ট মাস নির্দিষ্ট ঋতুর সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যায়। ১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দে বাদশাহ আকবর এক শাহী ফরমান জারির মাধ্যমে এই রাজস্ব সন বা ফসলী সন প্রবর্তনের ঘোষণা প্রদান করেন। এখানে উল্লেখ্য যে, বাদশাহ আকবরই আমাদের এই অঞ্চলকে সুবা বাঙ্গালা নাম দিয়ে একে তাঁর বাদশাহীর প্রদেশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। সুবা বাঙ্গালায় এই সন অনুযায়ী রাজস্ব আদায়ের সূচনা করেন সুবাদার শাহবাজ খান। ইসলামী ঐতিহ্য সমৃদ্ধ এই সনটি বাংলার মানুষ রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রেই কেবল নণ্ড বরং দৈনিক কাজকর্মেও একান্ত আপন সন হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে, এই নতুন সনে যে মাসগুলো সংযোজন করা হয় তা এখানে তখন বিদ্যমান শকাব্দের মাসসমূহ থেকে গৃহীত। শকাব্দের নববর্ষ শুরু হয় চৈত্র মাসের ১ তারিখে আর এই নতুন সনের নববর্ষ শুরু হয় ১ বৈশাখে অর্থাৎ শকাব্দের দ্বিতীয় মাসের পহেলা তারিখে। এক তথ্য থেকে জানা যায়, বাদশাহ আকবর প্রবর্তিত সনে হিজরী সনের প্রথম মাস মুর্হরমে যেখানে প্রচলিত বর্ষ গণনার যে মাস ছিল সেই মাসকেই প্রথম মাস হিসেবে ধরা হয়। সম্ভবত সেই কারণে তখন বৈশাখ মাসে এখানে মুর্হরম থাকায় বৈশাখ মাসকেই প্রথম মাস ধরা হয়। ফসল বোনা, উৎপাদন ও কর্তনের সঙ্গে এই সনের মাসগুলো বিন্যাসিত। শকাব্দ থেকে গৃহীত বাংলা সনের মাসগুলোর মধ্যে কেবল অগ্রহায়ণ মাস ছাড়া অন্য ১১টি মাসই এক একটি নক্ষত্রের নামের সঙ্গে সম্পৃক্ত, যেমন : বিশাখা নক্ষত্র থেকে বৈশাখ, যাকে কথ্য ভাষায় বোশেখও বলা হয়, জ্যেষ্ঠা নক্ষত্র জ্যৈষ্ঠ, যাকে জষ্টিও বলা হয়, আষাঢ়া নক্ষত্র থেকে আষাঢ়, শ্রবণা থেকে শ্রাবণ, ভাদ্রপদা থেকে ভাদ্র, অশ্বিনী থেকে আশ্বিন, কৃত্তিকা থেকে কার্তিক, পুষ্যা থেকে পৌষ, অঞ্চল বিশেষে স্থানীয় উচ্চারণে একে পুষ মাসও বলা হয়। মঘা থেকে মাঘ, ফাল্গুনী থেকে ফাল্গুন, একে ফাগুনও বলা হয় আর চিত্রা নক্ষত্রের নামে চৈত্র মাস, একে চৈত মাসও বলা হয়। এই সনের অষ্টম মাস অগ্রহায়ণ শব্দের অর্থ অগ্রবৎসর। ধারণা করা হয় প্রাচীনকালে হেমন্তকালে এই অঞ্চলে নববর্ষ শুরু হতো। তখন যে মাসটিতে নববর্ষ আসত হয়ত সেই মাসের নামকরণ করা হয় অগ্রহায়ণ। এই মাসটি অঘ্রাণ উচ্চারণেও কোন কোন অঞ্চলে পরিচিত। হয়ত প্রাচীনকালে হেমন্তের সোনালী আভা মেখে নবান্নের আনন্দ বৈভব আমেজে এদেশে নববর্ষ আসত। বাংলা সন আমাদের ঐতিহ্যের, আমাদের নিজস্বতার স্বাক্ষর। একে বঙ্গাব্দ না বলে বাংলা সন বা বাংলা সাল বলাটাই উচিত। কারণ আমাদের দেশের নাম যেমন বাংলাদেশ, আমাদের ভাষার নাম যেমন বাংলা, তেমনি আমাদের নিজস্ব সনের নাম বাংলা সন। এখানে উল্লেখ্য যে, সন শব্দটি আরবী থেকে এসেছে এবং সাল শব্দটি এসেছে ফারসী থেকে। হিজরী সনকে সৌর গণনায় এনে বাংলা সন প্রবর্তন করেন সেকালের এক স্বনামধন্য প-িত আমীর ফতেহ উল্লাহ সিরাজী আর বিংশ শতাব্দীর ষাট দশকে এসে বাংলা একাডেমির উদ্যোগে একালের স্বনামধন্য শ্রেষ্ঠ প-িত বহু ভাষাবিদ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র নেতৃত্বে গঠিত বাংলা পঞ্জিকা উপসংঘ দ্বারা এর কিছুটা সংস্কার সাধন করা হয়। এ সংস্কারের ফলে বাংলা সনের প্রথম মাস বৈশাখ থেকে পঞ্চম মাস ভাদ্র পর্যন্ত প্রত্যেক মাস ৩১ দিনে এবং ষষ্ঠ মাস আশ্বিন থেকে দ্বাদশ মাস চৈত্র পর্যন্ত প্রত্যেক মাস ৩০ দিনে গণনার সিদ্ধান্ত বলবৎ হয়। লিপইয়ার বা অতিবর্ষ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, লিপইয়ার বা অতিবর্ষের চৈত্র মাস ৩১ দিনে হবে। ৪ দ্বারা যে সাল বিভাজ্য হবে সেই সাল থেকে অতিবর্ষ বা লিপইয়ার ধরার সিদ্ধান্তও গৃহীত হয়। পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের বর্তমানে প্রচলিত সর্বপ্রাচীন সন হচ্ছে হিজরী আর এই হিজরী সন থেকেই বিকশিত হয়েছে বাংলা সন। বহু পরে এখানে ইংরেজী সন বা খ্রিস্টাব্দ প্রচলিত হয়েছে। হালখাতা, খাজনা আদায়, ফসল তোলা, ফসল বোনা, বিয়ে-শাদী ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলা সনের হিসাব এখনও এখানে রয়েছে। বাংলাদেশে বহু ধর্মসভা, ইসলামী জলসা, ইসালে সওয়াব ও ওয়াজ মাহফিল, উরস মুবারক বাংলা সনের নির্ধারিত তারিখে অনুষ্ঠিত হয়, যেমন: ফুরফুরা শরীফের ইসালে সওয়াব ও ওয়াজ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয় প্রতি বছর ফাল্গুন মাসের ২১, ২২ ও ২৩ তারিখে, খড়কী শরীফের উরস মুবারক অনুষ্ঠিত হয় প্রতি বছর চৈত্র মাসের ১৬ তারিখে, দ্বারিয়াপুর শরীফের ইসালে সওয়াব ও ওয়াজ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয় প্রতি বছর মাঘ মাসের ৪ তারিখে, শর্ষিনা শরীফের ইসালে সওয়াব ও ওয়াজ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয় প্রতি বছর অগ্রহায়ণ মাসের ১৪, ১৫, ও ১৬ তারিখে এবং ফাল্গুন মাসের ২৭, ২৮ ও ২৯ তারিখে। গ্রাম বাংলার মানুষের মধ্যে বাংলা তারিখের ব্যবহার ব্যাপকভাবে রয়েছে। বর্তমানে বাংলা সনের তারিখ বাংলাদেশের সরকারী চিঠিপত্রে ইংরেজী সনের তারিখের পাশাপাশি ব্যবহৃত হলেও শহর-নগর জীবনে বাংলা তারিখ একেবারেই অনুপস্থিত। কেবলমাত্র পয়লা বৈশাখ এলে এই সনকে নগরের অধিবাসীরা ওই একদিনের জন্যই কেবল স্মরণ করে। সেই স্মরণের মধ্যেও অপসংস্কৃতির উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়, যা আদৌ কাম্য নয় বলে স্বকীয় সংস্কৃতিসচেতন মহল মনে করেন। আমাদের নিজস্বতা, আমাদের স্বকীয়তা বজায় থাকে সেদিকে খেয়াল রেখেই, আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই বাংলা নববর্ষ পালন করা উচিত। হিজরী সনের সঙ্গে বাংলা সনের যেমন অতিঘনিষ্ঠ বন্ধন রয়েছে, তেমনি এ দুটি সনই বাংলাদেশের একান্ত আপন সন। লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ, উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা) সাবেক পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
×