ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাসাবাড়িতে নতুন গ্যাস সংযোগ আর নয়

প্রকাশিত: ০৫:২০, ১০ এপ্রিল ২০১৫

বাসাবাড়িতে নতুন গ্যাস সংযোগ আর নয়

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দুই বছরের ব্যবধানে আবারও আবাসিকে নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। এমনকি আবাসিক এলাকায় গ্যাস সরবরাহ সম্প্রসারণেও নতুন কোন প্রকল্প নেয়া হবে না। বিদ্যুত, জ্বালানি, খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ে বৃহস্পতিবার বৈঠক করার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সংক্রান্ত নির্দেশনা দিয়েছেন। তবে একই সঙ্গে দেশের সকল বিশেষায়িত শিল্প এলাকায় যত দ্রুত সম্ভব গ্যাস এবং বিদ্যুতের সংযোগ দেয়ার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। বৈঠকে তেল চালিত ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্রের মেয়াদ বৃদ্ধি না করা, সকল পুরাতন বিদ্যুত কেন্দ্র অবসরে দেয়া, স্থলভাগে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বিদেশী কোম্পানিকে দিয়ে জরিপ করা, তেল পরিবহনে পাইপলাইন নির্মাণ বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তীব্র গ্যাস ঘাটতি মোকবেলায় ২০০৯ সালের পহেলা অক্টোবর থেকে সিলেট অঞ্চল ছাড়া সারা দেশে নতুন শিল্প ও বাণিজ্যিক সংযোগ প্রদান বন্ধ করে সরকার। পরে ২০১০ সালের ১৩ জুলাই নতুন আবাসিক সংযোগ প্রদানে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। তবে গ্যাসের উত্তোলন দৈনিক দুই হাজার ২০০ মিলিয়ন ঘনফুটে উন্নীত হলে নতুন সংযোগ উন্মুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। পরবর্তীকালে ২০১৩ সালের মে মাসে সরকার আবাসিকে গ্যাস সংযোগ উন্মুক্ত করে। কিন্তু আবাসিক এলাকাতে গ্যাসের অপচয় হয় এই বিবেচনায় আবারও গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দেয়া হলো। শিল্প এবং বাণিজ্যিকে গ্যাস সংযোগ দেয়ার ক্ষেত্রেও প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টার নেতৃত্বে একটি কমিটি রয়েছে। কেবলমাত্র ওই কমিটির অনুমোদন প্রাপ্তরাই শিল্পকারখানায় গ্যাস পেয়ে থাকেন। শিল্পকারখানার চাকা সচল করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই নির্দেশনার পর কমিটির অনুমোদন প্রয়োজন হবে কিনা সে বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি। জানতে চাইলে বিদ্যুত, জ্বালানি এবং খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সাংবাদিকদের বলেন, এখন থেকে নতুন করে আর কোন গ্যাস সংযোগ দেয়া হবে না। এজন্য আগামী তিন বছরের জন্য এলপিজি সহজলভ্য করে সকলের ঘরে পৌঁছে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তবে দেশের সকল বিশেষায়িত শিল্প প্রতিষ্ঠানে গ্যাস এবং বিদ্যুত সংযোগ প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। এজন্য সরকারী বিভিন্ন বিশেষায়িত শিল্প এলাকা ছাড়াও বেসরকারী শিল্প এলাকাও এই সুবিধা পাবে বলে জানান প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী সৌরবিদ্যুতের ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি নতুন নতুন এলাকায় সৌরবিদ্যুতের সম্প্রসারণ করতে বলেছেন। বাপেক্সের এলাকা বাদ দিয়ে স্থলভাগের অন্য এলাকায় আইওসির মাধ্যমে তেল-গ্যাস উত্তোলন অনুসন্ধানের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিয়েছেন। উৎপাদন-বণ্টন চুক্তির সংশোধন করার বিষয়ে একমত পোষণ করেছেন। তিন বছরের মধ্যে ৮০ ভাগ এলাকায় প্রিপেইড মিটার চালু, অনলাইনে বিল পরিশোধের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিয়েছেন। পল্লী এলাকায় বিদ্যুত দেয়ার জন্য একটি সমন্বিত প্রকল্প হাতে নেয়ার নির্দেশনা দেন। ইস্টার্ন রিফাইনারির ক্ষমতা দ্রুততম সময়ে বৃদ্ধির নির্দেশনা দিয়েছেন। চট্টগ্রাম থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত তেল আনার জন্য পাইপলাইন নির্মাণ এবং নারায়ণগঞ্জ থেকে শাহজালাল বিমানবন্দর পর্যন্ত আরও একটি তেলের পাইপলাইন নির্মাণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। এতে বছরে ২০০ কোটি টাকার সাশ্রয় হবে। কক্সবাজারে একটি জেট ফুয়েলের ডিপো করা এবং আন্তর্জাতিক বাজারদর অনুযায়ী জেট ফুয়েলের দাম নির্ধারণের নির্দেশ দেন। এছাড়া স্থলভাগে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ, ডিজিটাল অডিট, এনার্জি অডিট, প্রতিবেশী দেশ থেকে বিদ্যুত-জ্বালানি বিনিময়ে সহায়তা বৃদ্ধি ছাড়াও সাশ্রয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বলেছেন। বৈঠক সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর সামনে বিদ্যুত ও জ্বালানি উভয় বিভাগ তাদের কার্যক্রম বিষয়ে পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপন করেন। তবে এক বছরেও প্রধামন্ত্রীর বিভিন্ন নির্দেশনা বাস্তবায়ন না হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী উষ্মা প্রকাশ করেছেন। বৈঠকের শুরুতে জ্বালানি সচিব আবু বক্কর সিদ্দিক গত এক বছরে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়ন না করতে পারায় মার্জনা প্রর্থনা করেন। প্রধানমন্ত্রী এ সময় গতিশীলভাবে কাজ করার নির্দেশনা দেন বলে জানা গেছে। ইতোপূর্বে স্থলেভাগে আর কোন এলাকা আইওসির কাছে না দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত ছিল। সরকার সে জন্য গত কয়েক বছরে স্থলভাগে কোন দরপত্র আহ্বান করেনি। সরকারের নতুন এই সিদ্ধান্তের ফলে আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো স্থলভাগে কাজ করার সুযোগ পেতে যাচ্ছে। এখন স্থলভাগ থেকে ৬০ ভাগ গ্যাসই তুলছে আন্তর্জাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানি। কোন দেশের জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য যা এক ধরনের হুমকি বলে বিবেচনা করা হয়। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর স্থলভাগে নির্দেশনার বিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি সচিব বলেন, আমরা আপাতত জরিপ করব। সাগরে যেভাবে তেল-গ্যাসের জরিপ করা হচ্ছে একইভাবে স্থলভাগের জন্য আগ্রহপত্র চাওয়া হবে। এতে দেশে আর কোন্ এলাকায় কি সম্পদ রয়েছে তা জানা যাবে। তবে বাপেক্সের এলাকাগুলোা এই জরিপের বাইরে রাখা হবে। এর ভিত্তিতে দরপত্র আহ্বান করা হবে। যেখানে বাপেক্সও অংশ নিতে পারবে। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদ্যুত-জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে দেয়া বক্তৃতায় বলেন, মানুষ সুখ পেলে দুঃখের কথা ভুলে যায়। আর দুঃখ পেলে সুখের কথা স্মরণ করেন। আগে ১৪ ঘণ্টা বিদ্যুতের লোডশেডিং ছিল। এখন এক ঘণ্টা করে করা হচ্ছে। আগের অবস্থা রাখলে অভ্যাস ঠিক থাকত। বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী নতুন শিল্প এলাকায় আলাদা করে বিদ্যুত সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, দেশের ২১টি অঞ্চলে শিল্প এলাকা গড়ে তোলা হবে। এসব শিল্প এলাকায় আলাদা আলাদা বিদ্যুতকেন্দ্র করতে হবে। এজন্য এখনই পরিকল্পনা করে আগাতে হবে। বেসরকারী বিনিয়োগে এই কেন্দ্র করতে হবে। বিদ্যুত সাশ্রয় করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ঘর থেকে বের হওয়ার সময় সুইচ বন্ধ করে বের হতে হবে। বিদ্যুত কম ব্যবহার করলে বিলও কম আসবে। বিল কম আসলে ঘুষ দিয়ে বিল কমানোর ব্যবস্থা করতে হবে না। প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশে এখন ৭০ ভাগ মানুষ বিদ্যুত পাচ্ছে। খুব দ্রুত সময়ে শতভাগ মানুষের কাছে বিদ্যুত পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে। দেশের উন্নয়নের প্রধান চালিকাশক্তি জ্বালানি। দেশকে মধ্য আয়ের দেশ করতে, অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে উন্নয়ন হবে না। শহরের সঙ্গে সঙ্গে গ্রামেরও উন্নয়ন করতে হবে। দুর্গম এলাকায় সৌরবিদ্যুত পৌঁছে দিতে হবে। তবে সৌরবিদ্যুতের জন্য কৃষি ও শিল্প জমি নষ্ট করা যাবে না। যে জমিতে শিল্প কারখানা হতে পারে কিংবা ফসল হয়, সেই জমি নষ্ট করা যাবে না। এসব জমি রক্ষা করেই সৌর প্যানেল বসাতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ছাদে সৌর প্যানেল বসানোর পরামর্শ দেন তিনি। ভারত থেকে আরও বিদ্যুত আনা হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত আমদানি করা হচ্ছে। আরও ৫০০ মেগাওয়াট একই পথে আনা হবে। ত্রিপুরা দিয়ে ও১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত আনা হবে। প্রতিবেশী দেশে থেকে বিদ্যুত আনার বিষয়টি ছিল যুগান্তকারী। এই অঞ্চলের অন্য কোন দেশ এমন করতে পারেনি। ভারত থেকে বিদ্যুত আমদানিতে দেশের লাভ হয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, নেপাল, ভুটান থেকে বিদ্যুত আনতে ভারত ট্রানজিট দিতে সম্মত হয়েছে। সেখানে যৌথভাবে বিনিয়োগ করা যেতে পারে। পর্যায়ক্রমে পুরনো বিদ্যুতকেন্দ্র বাদ দিয়ে নতুন যন্ত্র স্থাপন করতে হবে। এতে অল্প জ্বালানিতে বেশি উৎপাদন করা যাবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানুষের চাহিদার পরিবর্তন হয়ে গেছে। আগে মানুষ ভাত চাইত। এখন চায় বিদ্যুত। এতে বোঝা যায় মানুষের জীবনমান বদলেছে। অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে। মানুষের আর অভাব নেই। গ্রামের অর্থনীতি যত শক্তিশালী হবে তত ভাল। তিনি বলেন, আন্দোলনের নামে মানুষ পুড়িয়ে মারার রাজনীতি হয়েছে গত তিন মাস। রাজনীতি জনগণের জন্য। আর সেই জনগণকে পুড়িয়ে রাজনীতি করা হয়েছে। বৈঠকে জানানো হয় আপাতত কয়লা না তোলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তবে বিদেশে খনি ইজারা নিয়ে সেখান থেকে কয়লা এনে বিদ্যুত কেন্দ্র চালানোর পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, বিদ্যুত জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, বিদ্যুত সচিব মনোয়ার ইসলাম, জ্বালানি সচিব আবু বক্কর সিদ্দিক ছাড়াও বিদ্যুত-জ্বালানি বিভাগের সকল পদস্থ কর্মকর্তা এবং সংস্থাপ্রধানরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
×