ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

কামারুজ্জামানের ফাঁসি বহাল থাকলেও নিজ এলাকায় নীরবতা

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ৮ এপ্রিল ২০১৫

কামারুজ্জামানের ফাঁসি বহাল থাকলেও নিজ এলাকায় নীরবতা

নিজস্ব সংবাদদাতা, শেরপুর, ৭ এপ্রিল ॥ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সুপ্রীমকোর্টের চূড়ান্ত রায়ে জামায়াতের সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল, শীর্ষ বদর নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের রিভিউ খারিজ ও ফাঁসি বহাল হলেও তার নিজ এলাকা শেরপুরে একেবারেই নীরব অবস্থায় রয়েছে জামায়াত নেতা-কর্মীসহ সমর্থকরাও। রিভিউ খারিজের প্রতিবাদে জামায়াতের ডাকা দু’দিনের হরতালের প্রথম দিন মঙ্গলবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শহরের কোথাও দলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি তো দূরের কথা, প্রশাসনের সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের টিকিটি পর্যন্ত দেখা যায়নি। অন্যদিকে নেতা-কর্মী-সমর্থক থেকে শুরু করে তার পরিবারের ঘনিষ্ঠজন এবং বিশেষ করে জামায়াত অধ্যুষিত বাজিতখিলা এলাকার মানুষজনসহ কোথাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে না কষ্ট বা আফসোসের সুর। পূর্বাপর অবস্থা ॥ ১৯৫২ সালের ৪ জুলাই শেরপুর সদর উপজেলার বাজিতখিলা ইউনিয়নের নিভৃত পল্লী কুমড়ি মুদিপাড়ায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী পিতা ইনসান আলী সরকারের ঘরে জন্ম নেয়া মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ৫ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে চতুর্থ। এলাকায় দলীয় নেতা-কর্মীদের মাঝে তিনি ‘জামান সাব’ বা ‘জামান ভাই’ বলেই সমধিক পরিচিত। তার স্কুলজীবন কাটে জেলা শহরের ঐতিহ্যবাহী জিকে পাইলট হাই স্কুলে। এরপর উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হন পার্শ্ববর্তী জামালপুর আশেক-মাহমুদ কলেজে। ১৯৭১ সালে উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র থাকাবস্থায় কামারুজ্জামান জামায়াতে ইসলামীর তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের ময়মনসিংহ জেলার প্রধান বনে যান। মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর ২২ এপ্রিল পাকিস্তানী বাহিনীকে সহযোগিতা করতে জামালপুরের আশেক-মাহমুদ কলেজের ইসলামী ছাত্রসংঘের বাছাই করা নেতা-কর্মীদের নিয়ে তিনি গড়ে তোলেন আলবদর বাহিনী। ওই বাহিনী সে সময় ময়মনসিংহ, জামালপুর, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, শেরপুর ও টাঙ্গাইলে ব্যাপক মাত্রায় যুদ্ধাপরাধ ঘটায়। জামালপুরে আলবদর বাহিনীর ৭টি ক্যাম্পের মধ্যে শেরপুরে সুরেন্দ্র মোহন সাহার বাড়ি দখল করে বানানো ক্যাম্পের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন কামারুজ্জামান। সে সময় বহু মানুষকে হত্যা করা হয় ওই ক্যাম্পে। এছাড়া তার প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ নেতৃত্বে সীমান্তবর্তী নালিতাবাড়ী উপজেলার সোহাগপুর গ্রামে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয় ১৮৭ গ্রামবাসীকে। সেইসঙ্গে পাশবিক নির্যাতন চালানো হয় গৃহবধূদের। স্বাধীনতার পরের বছর ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন কামারুজ্জামান। ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে মাস্টার্স পাস করার পর সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের আমলে ১৯৭৮-৭৯ সালে ইসলামী ছাত্রশিবিরের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৯ সালের অক্টোবরে কামারুজ্জামান মূল দল জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দেন এবং ওই বছর ১৬ ডিসেম্বর রুকনের দায়িত্ব পান। ১৯৮২-১৯৮৩ সালে তিনি জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামের নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্বেও ছিলেন। ১৯৯২ সাল থেকে তিনি দলে সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্বে রয়েছেন। অর্থাৎ পঁচাত্তর পরবর্তী রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে অনুকূল পরিবেশে ধাপে ধাপে কেন্দ্রীয় শিবিরসহ জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্বে চলে যায় কামারুজ্জামান। ওই অবস্থায় আন্তর্জাতিক লবিতে বিচরণ করে প্রচুর বিত্ত-বৈভবের মালিক বনে যান তিনি। সেই সুবাদে জাতীয় নির্বাচনে ১৯৮৬ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত ৩ বার জামায়াতের ব্যানারে এবং ২ বার বিএনপির নেতৃত্বাধীন ৪ দলীয় জোটের ব্যানারসহ সর্বমোট ৫ বার শেরপুর-১ (সদর) আসন থেকে প্রার্থী হলেও প্রতিবারই শেরপুরবাসী তাকে প্রত্যাখান করে। ২০০৮ সালে দ্বিতীয় দফায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার গঠিত হলে দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ওই অবস্থায় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে ২০১০ সালের ১৩ জুলাই কামারুজ্জামান হাইকোর্ট এলাকা থেকে গ্রেফতার হয়। একই বছরের ২ আগস্ট তাকে গ্রেফতার দেখানো হয় একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায়। এরপর থেকে টানা দীর্ঘ সময় কারাগারে আটক এবং ২০১৩ সনের ৯ মে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদ-ের রায় ঘোষিত হয়। চূড়ান্ত রায় পরবর্তী অবস্থা ॥ ওই রায়ের প্রেক্ষিতে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে দেশব্যাপী হরতালের ডাক দেয়া হলেও তার নিজ নির্বাচনী এলাকা শেরপুরে তেমন কোন প্রতিক্রিয়াই দেখা যায়নি। সর্বশেষ ৬ এপ্রিল সোমবার উচ্চ আদালতে তার করা রিভিউ পিটিশন খারিজ ও মৃত্যুদ- বহাল হওয়ায় শেরপুরে আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের নেতা-কর্মী ও সংগঠক এবং একাত্তরে শহীদদের স্বজন, মুক্তিযোদ্ধা ও সাক্ষীসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের মাঝে আনন্দ-উচ্ছ্বাসের বহিঃপ্রকাশ ঘটলেও গত দু’দিনেও দলীয় নেতা-কর্মী, সমর্থক ও কামারুজ্জামানের আত্মীয়-স্বজনদের মাঝেও বিপরীত অনুভূতি প্রকাশের কোন বিন্দুমাত্র উদাহরণ বা দৃষ্টান্ত পাওয়া বা দেখা যায়নি। মঙ্গলবার দুপুরে কামারুজ্জামানের জন্মস্থান বাজিতখিলা এলাকা ঘুরে এমন চিত্রই পাওয়া যায়। কুমড়ি মুদিপাড়া গ্রামে কামারুজ্জামানের পৈত্রিক বাড়িতে বর্তমানে তার বড় দু’ভাই বসবাস করছেন, বাড়িটি এখন পুলিশ পাহারায় রয়েছে। কামারুজ্জামান অনেকদিন ধরে ঢাকায় থাকেন। স্বজনদের প্রতিক্রিয়া ॥ চূড়ান্ত রায়ের পর ফাঁসি কার্যকরে সকল প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। বিষয়টি জানার পরও কষ্ট বা দুঃখে তেমন ভারাক্রান্ত নন তার স্বজনরাও। তবে রায়ের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে কামারুজ্জামানের বড় ভাই আলমাছ আলী বলেন, আমার ভাই কোনও অপরাধ করে নাই, আমার ভাই নির্দোষ’। আর কামারুজ্জামানের বোন আমেনা বেগম বলেন, ‘আমার ভাই কোনও ঘটনার সঙ্গে জড়িত না। ওই সময় দলের নেতৃস্থানীয় দু’চার জন কথা বললেও নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, কৃতকর্মের ফল ভোগের ঘোষণা হয়েছে, তাতে কষ্ট বা দুঃখের কি আছে? আর কামারুজ্জামানের নিজ ইউনিয়ন বাজিতখিলার চেয়ারম্যান আব্দুল হান্নান বলেন, ‘এটা ভাল-মন্দ বিচারের বিষয় নয়। সর্বোচ্চ আদালতে যে রায় হয়েছে, তা আমাদের মেনে নিতেই হবে’। নীরব-নিষ্ক্রিয় জামায়াত ॥ বার বার এ এলাকা থেকে কামারুজ্জামান জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী হলেও এবং একটি পৌরসভাসহ ১৪টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত শেরপুর-১ (সদর) নির্বাচনী এলাকায় জামায়াতের বিশেষ অবস্থান থাকলেও তিনি গ্রেফতারের পর থেকেই স্থানীয়ভাবে জামায়াত মুখ থুবড়ে পড়ে। দীর্ঘদিন থেকেই দলের জেলা আমীর ও সেক্রেটারি জেনারেলের লাপাত্তাসহ সদর ও শহর ইউনিটের কোন কার্যক্রম বা তৎপরতা নেই। কোন কোন সময় বিশেষ ইস্যুর সুযোগে জামায়াত নেতা-কর্মীরা সু-কৌশলে কর্মসূচী হাতে নিলেও পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর বিশেষ তৎপরতার কারণে সেগুলোও ভেস্তে যায় এবং আটক হয়েছে নেতা-কর্মীদের একাংশ। সর্বশেষ রিভিউ পিটিশন খারিজ ও ফাঁসি বহাল হওয়ায় কেন্দ্র ঘোষিত দু’দিনের হরতালের প্রথম দিন মঙ্গলবার কোথাও কোন প্রভাবই পড়েনি কামারুজ্জামানের নিজ এলাকা শেরপুরে।
×