ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

শখে আঁকা শখের হাঁড়ি

গ্রামীণ আচার উৎসব সংস্কার- লোকচিত্রের বর্ণাঢ্য প্রকাশ

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ৮ এপ্রিল ২০১৫

গ্রামীণ আচার উৎসব সংস্কার- লোকচিত্রের বর্ণাঢ্য প্রকাশ

মোরসালিন মিজান ॥ মাটির হাঁড়ি সত্যি কাজের। গ্রামীণ জীবনে এর বিচিত্র ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। এই কাজে হাঁড়ি। ওই কাজেও। হাঁড়ি ছাড়া চলে না। কুমাররা হাঁড়িটাই বেশি করে গড়েন। তবে শখের হাঁড়ির ব্যাপার আলাদা। এর যেমন চোখ জোড়ানো সুন্দর, তেমনি বিশেষ ব্যবহার। বাংলার প্রাচীনতম লোকশিল্পের এটি অন্যতম। লোকচিত্রের বর্ণাঢ্য নমুনা বহন করে শখের হাঁড়ি। এই ধারার কাজে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্পের সার্থক প্রকাশ ঘটে। মৃৎশিল্পের যত উপাদান আছে, শখের হাঁড়ি তার মধ্যে অন্যতম। ১৪০৬ খ্রিস্টাব্দে চীনা পর্যটক মা-হুয়ানের ভ্রমণবৃত্তান্তে এরূপ চিত্রিত হাঁড়ির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। শখের হাঁড়ির আরও কিছু নাম আছে। যেমন- চিত্রিত হাঁড়ি, আলপনার হাঁড়ি ও রঙের হাঁড়ি। নামগুলোই বলে দেয়, হাঁড়ির গায়ে চিত্র আঁকা থাকে। এ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় দেশীয় রং। উজ্জ্বল রং বেশি প্রাধান্য পায়। লাল হলুদ সাদাসহ বিভিন্ন রঙে ফুল লতা পাতা পাখি মাছ ইত্যাদি মূর্ত হয়। গ্রামীণ জীবনাচার, উৎসব, সংস্কার, ধর্মসহ নানা কিছু ধারণ করে হাঁড়িচিত্র। ফলে সৌন্দর্যপ্রেমীরা খুব সহজেই আকৃষ্ট হন। তবে শুধু রূপ নয়, আছে ব্যবহারিক দিকও। গ্রামে বিয়ে বাড়িতে শখের হাঁড়ির ব্যবহার অতি পুরনো। এ ধরনের চিত্রিত হাঁড়িতে মূলত মিষ্টি বহন করা হয়। তিলা, কদমা, নাড়ু, মুড়কি, মোয়া ও অন্যান্য মিষ্টি খাবার দিয়ে হাঁড়ি ভর্তি করে পাঠানো হয় কুটুম বাড়িতে। জানা যায়, চাঁপাইনবাবগঞ্জে মেয়ে বিদায়ের সময় শখের হাঁড়ি সঙ্গে দেয়ার রেওয়াজ ছিল। প্রথম সন্তান প্রসবের পর স্বামীর বাড়িতে যাওয়ার সময় মেয়েরা বাপের বাড়ি থেকে এই হাঁড়ি নিয়ে যেত। এই হাঁড়ি শখের চুকাই ও ঝাঁপি নামেও পরিচিত। একইসঙ্গে সিকরা হাঁড়ি ও বাটা নামে আরও দুটি হাঁড়ি দেয়া হতো। মৃৎশিল্প নিয়ে অনেকদিন কাজ করেছেন মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম। তিনি জানান, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এখনও দেখা মেলে শখের হাঁড়ির। এ ধরনের হাঁড়ির দুটি ধারা রয়েছে। বিশেষ এক ধরনের কাজ হয় রাজশাহীর বাঁয়া, বসন্তপুর ও নবাবগঞ্জের বারোঘরিয়ায়। এসব হাঁড়ির হলদে জমিন। সে জমিনের ওপর লাল, নীল, সবুজ ও কালো রঙে আঁকা হয় হাতি, ঘোড়া, মাছ, শাপলা ও পদ্ম দলদাম রাজহাঁস, পাতিহাঁস, পেঁচা কবুতর ইত্যাদি। ভিন্নরীতি অনুসরণ করেন নওগাঁর বাঙ্গালপাড়ার মৃৎশিল্পীরা। তাদের হাঁড়িগুলোর গায়ের রং লাল। তার ওপর সাদা কালো ও সরষে ফুলের রঙে আঁকা হয় মাছ, চিরুনি, পাখি ও পদ্ম ফুলের মোটিভ। আট থেকে নয়টি পরিবার এসব হাঁড়ি তৈরির কাজ করেন। ঢাকার আশপাশের কিছু এলাকায়ও শখের হাঁড়ি তৈরির কাজ হয়। নয়ার হাঁট, ধামরাই, রায়ের বাজারে কুমাররা যতেœর সঙ্গে এ কাজ করে থাকেন। এ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শখের হাঁড়ি তৈরির কাজ হয়। অঞ্চল বেধে শখের হাঁড়ির আকার ও স্টাইলে পার্থক্য লক্ষণীয়। কোন কোন শখের হাঁড়িতে হাতল থাকে। কোনটি হাতলবিহীন। কোন অঞ্চলের হাঁড়িতে ঢাকনা থাকে। কোনটির আবার হা করা মুখ। তবে সব হাঁড়ি-ই চিত্রিত। অদ্ভুত সুন্দর। এই সুন্দর, এই ঐতিহ্য টিকে থাকুক।
×