ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

জাফর ওয়াজেদ

ইসলামিক স্টেটের অন্তরালে

প্রকাশিত: ০৪:০৮, ৮ এপ্রিল ২০১৫

ইসলামিক স্টেটের অন্তরালে

শান্তির ধর্ম ইসলামের নাম ভাঙ্গিয়ে গড়ে ওঠা ইসলামিক স্টেট (আইএস) নামক জঙ্গী সংগঠনটি আল কায়েদা, তালেবানসহ অন্য জঙ্গী সংগঠনগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে। তবে এ সংগঠনটির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে আনুগত্য প্রকাশ করছে অন্য জঙ্গী গোষ্ঠীগুলো। এরা ইরাক ও সিরিয়ার একাংশ দখল করে নতুন রাষ্ট্র ইসলামিক স্টেট ঘোষণা করে ইসলামিয়া শরিয়া আইন শাসিত খিলাফত প্রতিষ্ঠা করেছে। বিশ্বের মুসলমানদের এ খিলাফতের প্রতি আনুগত্য দাবি করছে তারা। আর তা করার জন্য তারা নৃশংসতা, নিষ্ঠুরতা, নারকীয়তা ও অমানবিকতার পথ বেছে নিয়েছে। মধ্যযুগীয় বর্বরতাতে আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তারা ফিরিয়ে আনছে। সন্ত্রাস ও জঙ্গীপনা ছাড়া তাদের আর কোন ভূমিকাই নেই। তাদের হাতে বেসামরিক লোকের মৃত্যুদ- কার্যকর হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এই হত্যাযজ্ঞের দৃশ্য ভিডিও করে তারা ইউটিউবে ছেড়ে দিচ্ছে। আর সে সব চিত্র দেখে শিউরে উঠতে হয়। মানুষ কি করে নৃশংসভাবে অপরাধহীন মানুষকে জবাই, শিরশ্চেদ, অগ্নিসংযোগে হত্যা করতে পারে, তা বিশ্ব বিবেককে ভাবিয়েও কাঁপিয়ে তুলছে। এরা বিদেশীদের জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়ও করছে। পৃথিবীতে যত মন্দ কাজ আছে, সবই তাদের করায়ত্ত এবং তার চর্চাও করছে অব্যাহতভাবে। অন্য জঙ্গী সংগঠনের তুলনায় এরা ভয়ঙ্কর অন্য কারণে। ধর্মভিত্তিক জঙ্গী সংগঠনগুলো চোরাগোপ্তা হামলা করে এলেও আইএস প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। নিয়মিত সেনাবাহিনীর মতো স্থল অভিযানে অংশ নিয়ে এলাকাও দখল করছে তারা। মূলত আল কায়দা থেকে বের হয়ে আসা সংগঠন এই আইএস। সুন্নি আরব জঙ্গীদের সংগঠনটির বিস্ময়কর উত্থান ঘটে ২০১৩ সালে। আগ্রাসন চালানোর পথ সুগম করতে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা তথা সিআইয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় ইসলামিক স্টেট নামক জঙ্গী সংগঠনটি গড়ে উঠেছে বলে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা তথ্য প্রকাশ করেছে গত বছরের সেপ্টেম্বরে। সংগঠনটির বেশিরভাগ নেতা সাদ্দাম হোসেনের সময়ের ইরাকী সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাÑ এমনটাই দাবি করছেন জঙ্গী সংগঠন থেকে বেরিয়ে আসা সিরিয়ার এক সাবেক বিদ্রোহী আবু হামজা। তার ভাষ্য, আইএসয়ের কাল্পনিক ইসলামিক সমাজ বা ইসলামিক ইউটোপিয়া বাস্তবায়ন সম্ভব নয় বুঝতে পেরেই তিনি সংগঠন ত্যাগ করেন। অথচ কী আশ্চর্য, এ ইউটোপিয়ার মোহই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার জিহাদীকে আইএস-এ যোগদানে প্রেরণা যুগিয়ে যাচ্ছে। বিশেষত পশ্চিমা দেশের তরুণ-তরুণীরা এতে যোগ দিচ্ছে। জর্দানের সুন্নি নেতা আবু মুসাব আল জারকাবি ২০০২ সালে তাওহিদ ওয়া আল জিহাদ প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন বাহিনীর আগ্রাসনের পরের বছর ওসামা বিন লাদেনের আল কায়েদার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন তিনি। একই সঙ্গে তিনি আল কায়েদা ইন ইরাক (একিউআই) গঠন করেন। পরবর্তী সময়ে দেশটিতে জঙ্গী তৎপরতায় একটি বড় শক্তিতে পরিণত হয় একিউআই। ২০০৬ সালে জারকাবি মারা যাবার পর একিউআই একটি সমন্বিত সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে। নামকরণ হয় ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক (আইএসআই)। কিন্তু সাংগঠনিক দুর্বলতায় আর এগুতে পারেনি। ২০১২ সালে সংগঠনটির নেতৃত্ব নেয় আবু বকর আল বাগদাদী। ২০১৩ সালে সংগঠনটি শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং ইরাকে একাধিক হামলা চালায়। একইসঙ্গে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বিরদ্ধে বিদ্রোহে যোগ দেয়। এরপর সিরিয়া ও ইরাকে নিজের বাহিনীকে অঙ্গীভূত করেন বাগদাদী। আর গঠিত হয় ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক এ্যান্ড সিরিয়া বা আইএসআইএস। সিরিয়াকে ঘাঁটি করে তারা ইরাকে শিয়া নেতৃত্বাধীন সরকারের সঙ্গে সুন্নি আরব সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক বিরোধের সুযোগ নেয়। ইরাকের ফালুজা, মসুলসহ আরও এলাকা দখলে নেয় । ইরাক ও সিরিয়ায় নিজেদের দখলে থাকা অঞ্চল নিয়ে ২০১৪ সালের ২৯ জুন ‘খিলাফত’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয় এবং সংগঠনের নামকরণ করে আইএস। সংগঠনের প্রধান আবু বকর আল বাগদাদী খলিফা ঘোষণা করেন নিজেকে। তাদের রাজধানী করা হয় সিরিয়ার আল রাকাহ শহর। ইরাক, সিরিয়া, জর্দান ও লেবাননের অংশবিশেষ নিয়ে একটি অঞ্চলজুড়ে ‘খিলাফত’ পদ্ধতির ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে তৎপর আইএস। রাষ্ট্রকে শরিয়া আইনে পরিচালনা করার ঘোষণা রয়েছে। ইতোমধ্যে এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে তাদের অনুগত ও মিত্র জঙ্গী বাহিনীগুলো সন্ত্রাসী তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে একই লক্ষে। গোড়ার দিকে আইএস যোদ্ধা ছিল ১৫ হাজার। বর্তমানে তা লাখ ছাড়িয়েছে। এ জঙ্গীগোষ্ঠীতে ৮১টি দেশের ১২ হাজারেও বেশি বিদেশী যোদ্ধা রয়েছে। এর মধ্যে ৪ হাজার যোদ্ধা পশ্চিমা দেশগুলো থেকে এসেছে। সংগঠনটির প্রায় ২০০ কোটি মার্কিন ডলার সমমূল্যের নগদ অর্থ ও সম্পদ রয়েছে। বিশ্বে তারা এখন সবচেয়ে ধনী জঙ্গীগোষ্ঠী। এদের আয়ের একটা বড় অংশ আসে আরব দেশগুলোর নাগরিকদের কাছ থেকে। তাছাড়া তাদের দখলে থাকা ইরাক ও লিবিয়ার তেল ও গ্যাসক্ষেত্র থেকে লাখ লাখ ডলার আয় করছে তারা। এর বাইরে শুল্ক, টোল, চোরাচালান, চাঁদাবাজি, অপহরণ এবং দখল করা এলাকার ব্যাংকগুলো থেকেও তারা বিপুল অর্থ আয় করে। আইএসের অস্ত্রভা-ারও সমৃদ্ধ। হালকা থেকে ভারি সব ধরনের অস্ত্র চালানায় তারা পারদর্শী। তারা ট্রাকে স্থাপিত মেশিনগান রকেট লঞ্চার, বিমানবিধ্বংসী অস্ত্র, ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারে সক্ষম। তাদের কাছে হেলিকপ্টার, পরিবহন বিমান ও অত্যাধুনিক সব সমরাস্ত্র রয়েছে। সিরিয়া ও ইরাকী বাহিনীর কাছ থেকে দখল করা ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়া যান ব্যবহার করে তারা। একদা সিরিয়ায় আইএস দখল করা একটি কমিউনিটির শাসক দায়িত্বে থাকা আবু হামজার ভাষ্য হচ্ছে, সাদ্দামের সেক্যুলার বাথ পার্টির সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা আইএস নামক ইরাকভিত্তিক জঙ্গী সংগঠনটির মূল সামরিক খুঁটি হিসেবে কাজ করছে। আইএসের প্রায় সব নেতাই সাবেক ইরাকী সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা। আইএসে যোগদানকারী সিরিয়ার স্থানীয় আমিরদের প্রত্যেকেই একজন ইরাকী প্রতিনিধির অধীনে আছেন। ওই প্রতিনিধিই মূল সিদ্ধান্ত নেয়। আইএসের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নীতি নির্ধারণ পর্যায়ের সবাই ইরাকী নাগরিক ও সাবেক সেনা কর্মকর্তা। তারা শুধু আদেশ, কৌশল নির্ধারণ ও যুদ্ধ পরিকল্পনা তৈরিতে কাজ করে। কিন্তু তারা কখনই নিজেরা যুদ্ধের ময়দান নামে না। বরং বিদেশী জিহাদীদের সামনে রেখে পেছন থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করেন তারা। ১৯৭৯ সাল থেকে মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক খ্যাতিমান সংবাদিক প্যাট্রিক ককবার্ন (৬৬) তার সদ্য প্রকাশিত ‘দি রাইজ অব ইসলামিক স্টেট-আইএসআইএস দ্য নিউ সুন্নি রেভ্যুলেশন’ গ্রন্থে আইএসের উত্থানের পিছনে আরবদের পুরনো সময়ের নানা কর্মকাণ্ড তুলে ধরে উল্লেখ করেছেন, আইএস শুধু জঙ্গী সংগঠন নয়, এটি স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা একটি ইরাকী বিদ্রোহী। আইএস ইসলামীও নয় এমনকি রাষ্ট্রও নয়, মূলত ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডই তাদের ধর্ম। তারা ইসলামের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকেও বিনষ্ট করছে। ইসলামের কথা বলা হলেও তাদের জীবনাচরণে ও কর্মে সেই ধর্মের প্রতিফলন নেই। প্যাট্রিক ককবার্ন সৌদি আরবের ওয়াহাবী ধর্মাদর্শসহ শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব এবং ইসলামের নানা মতাবলম্বীদের অবস্থান তুলে ধরে দেখিয়েছেন তাদের কার্যকলাপ ধর্মকে হেয় করছে। শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব নিবারণ সহজতর নয়। তাই জঙ্গীরা এ সুযোগ নিয়ে নারকীয়তা চালু রেখেছে। আইএস ধর্মভিত্তিক সংগঠন নয়, আসলেই তা ধর্মবিরোধী জঙ্গী সংগঠন। [email protected]
×