ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

লী কোয়ান ইয়ু

প্রকাশিত: ০৪:০৭, ৮ এপ্রিল ২০১৫

লী কোয়ান ইয়ু

সিঙ্গাপুরে ব্রিটিশ প্রজা হিসেবে জন্ম তার ১৯২৩-এর ১৬ সেপ্টেম্বর। মৃত্যু তার ২৩ মার্চ ২০১৫তে সাম্প্রতিককালের এশিয়ার অন্যতম প্রধান রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে। প্রেসিডেন্ট ওবামা ২০০৯-এর ২৯ অক্টোবর তাকে এশিয়ার বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম কিংবদন্তির নায়ক হিসেবে পরিচিতি দিয়েছেন। এর আগে ১৯৯৯ সালে বিশ্ববিখ্যাত টাইমস্ পত্রিকা তাকে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। লী কোয়ান ইয়ুর হাতেখড়ি হয়েছিল সিঙ্গাপুরের তেলক কুউড়াও ইংরেজী স্কুলে। পরে পড়েছেন সেখানকার মেধা আকর্ষণকারী র‌্যাফেলস্ ইনস্টিটিউশন ও র‌্যাফেলস্ কলেজে। এই প্রতিষ্ঠানটি পরবর্তী পর্যায়ে প্রখ্যাত সিঙ্গাপুর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। এর পরে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর লী বিশ্ববিখ্যাত লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস ও ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য যান। ১৯৪৯ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজউইলিয়াম কলেজ হতে তিনি আইনে অসাধারণ কৃতিত্বের সঙ্গে ডিগ্রী অর্জন করে সিঙ্গাপুরে ফিরে এসে আইন ব্যবসা শুরু করেন। ১৯৫০ সালে লী তার মতোই ইংরেজী ভাষী কোয়া গিয়ক চুকে বিয়ে করেন। ১৯৫১ সালে তিনি আইন পেশা থেকে কার্যত সরে এসে রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে থাকেন। ১৯৫৪ সালে তিনি পিপলস এ্যাকশন পার্টি (প্যাপ) নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে সিঙ্গাপুরস্থ চীনা ও মালে জনগণকে নিয়ে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে সিঙ্গাপুরকে মুক্ত করার সংগ্রামে ব্রতী হন। একই বছর তিনি পিপলস এ্যাকশন পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এই পদে তিনি ১৯৫৭ সালের কিছু সময় ব্যতীত ১৯৯২ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৫ সালে লী সিঙ্গাপুরের তানজোন পাগার নির্বাচনী এলাকা থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৯ সালে পিপলস এ্যাকশন পার্টির মোড়কে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে তিনি ব্রিটেনের অধীনে সিঙ্গাপুরের স্বশাসিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথগ্রহণ করেন। ১৯৬১-৬৩ পর্যন্ত তিনি তৎকালীন মালের প্রধানমন্ত্রী টুংকু আবদুল রহমানের সঙ্গে একযোগে মালে, সিঙ্গাপুর, সাবা ও সারওয়াক নিয়ে মালয়েশিয়া প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রাম শুরু করেন। ১৯৬৩-এর ১৬ সেপ্টেম্বর সিঙ্গাপুরকে অন্তর্ভুক্ত করে মালয়েশিয়া স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। মালয়েশিয়া প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরপরই সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার বিভিন্ন এলাকায় মুসলিম মালে এবং বৌদ্ধ ও খ্রীস্টান চীনাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। এর ফলে লীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও টুংকু সিঙ্গাপুরকে মালয়েশিয়ান ফেডারেশন থেকে কার্যত বহিষ্কৃত করেন। ফলত ১৯৬৫ সালের ৭ আগস্ট ক্ষুদ্রাকৃতির সিঙ্গাপুর স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। মালয়েশিয়ার সঙ্গে বিচ্ছেদের জন্য দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে এরপর লী সিঙ্গাপুরকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। বিভিন্ন রাষ্ট্র থেকে স্বীকৃতি পাওয়ার পর ১৯৬৫-এর ২১ সেপ্টেম্বর সিঙ্গাপুর স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে। ১৯৬২ সালের ৮ আগস্ট লী দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আরও ৪টি রাষ্ট্র নিয়ে এ্যাসোসিয়েশন অব সাউথ এশিয়ান নেশনস (আসিয়ান) গঠন করেন। ১৯৯০-এর নবেম্বর পর্যন্ত লী পিপলস্ এ্যাকশন পার্টির প্রধান নির্বাহী হিসেবে পরপর ৭টি নির্বাচনে জয়ী হন এবং ১৯৯০ পর্যন্ত সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শ্রেষ্ঠতম রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে নিজেকে সমসাময়িক ইতিহাসে তুলে ধরেন। ১৯৯০ সালে তিনি যখন বয়সের কারণে তার ছেলে উপপ্রধানমন্ত্রী গহ্ চক টনের কাছে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব তুলে দেন তখন পর্যন্ত তিনি পৃথিবীর দীর্ঘতম সময়ের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এর আগে গহ্ চক টন মেধাবী সেনানায়ক হিসেবে কাজ করার সময় ব্যবসায় প্রশাসনে যুক্তরাষ্ট্র থেকে উচ্চশিক্ষা পেয়ে অসামরিক প্রশাসন ও রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৬৫ সালে স্বাধীন সিঙ্গাপুরে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যখন লী দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন সিঙ্গাপুরের সম্পদের ছিল ২টি উপাদান : (১) মালাক্কা প্রণালীর নৌপথ নিয়ন্ত্রণক্ষম, এর ভৌগোলিক অবস্থান এবং (২) বিশ লাখ সংখ্যক বহু জাতীয় জনগণ। লীর ভাষায় স্বাধীনতায় তারা উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন হৃৎপি- বর্জিত শরীরসম পশ্চাদভূমি বঞ্চিত একটি দ্বীপের। পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সখ্য ও ভিয়েতনাম যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণ সিঙ্গাপুরকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা ও সম্পদ দুই-ই দেয়। অদম্য সাহস ও দৃঢ় সংকল্প নিয়ে লী এই হৃৎপি-বিহীন শরীরসম নগর রাষ্ট্রকে যথার্থ প্রতিরক্ষণ ও দ্রুত উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। তার স্মৃতি কথায় (ঋৎড়স ঞযরৎফ ডড়ৎষফ ঃড় ঋরৎংঃ: ঝরহমধঢ়ড়ৎব ঝঃড়ৎু ১৯৬৫-২০০০) লী বলেছেন যে, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার পর তিনি সবচাইতে বেশি মনোযোগ ও গুরুত্ব নিয়ে গড়ে তুলেছেন মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার আপেক্ষিকতায় অতি ক্ষুদ্র সিঙ্গাপুরের প্রতিরক্ষণ ব্যবস্থা। এই প্রতিরক্ষণ ব্যবস্থা গড়ার প্রক্রিয়ায় তিনি সিঙ্গাপুরের সামরিক ও পুলিশ বাহিনীতে মালেদের সংখ্যা ও প্রতিপত্তি কমিয়ে আনেন, ব্রিটেন, ইসরাইল ও নিউজিল্যান্ডের সহযোগিতায় যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ শুরু করেন, সমরাস্ত্র, যুদ্ধজাহাজ ও বিমান আহরণ করেন। তিনি জাতীয় সার্ভিস আইনের আওতায় সামরিক বাহিনীতে যোগদানকারী তরুণদের সামরিক সার্ভিসের পর বিভিন্ন অসামরিক ক্ষেত্রে সরকারী ও বেসরকারী চাকরির নিশ্চয়তা প্রদান এবং প্রকৃত মেধাবী সামরিক অফিসারদের বিদেশে উদাহরণত যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে অর্থনীতি, ব্যবসায় প্রশাসন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষা লাভ করা এবং এরূপ শিক্ষার পর সরকারের উন্নততর কর্মে নিযুক্তির ব্যবস্থা করেন। তার নিজের ছেলে গহ চক টন এই প্রক্রিয়ায় সামরিক বাহিনীর অফিসার হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ব্যবসা প্রশাসনে উচ্চতর ডিগ্রী লাভ করে দেশে ফিরে আসেন। সামরিক বাহিনীর প্রশিক্ষণের জন্য এ ছিল এক অভিনব এবং প্রশাসনের জন্য সার্বিকভাবে ফলপ্রসূ কার্যক্রম। লী নিজেই বলেছেন যে, এ কার্যক্রমের আওতায় তিনি তার দেশের উচ্চ মেধাসম্পন্ন তরুণদের সামরিক বাহিনী এবং তারপরে রাষ্ট্রের সুশীল প্রশাসনে উৎপাদনশীলভাবে নিয়োজিত করতে সমর্থ হয়েছেন। ১৯৭১ সালের মধ্যে এই প্রক্রিয়ায় সিংঙ্গাপুর প্রায় শূন্য অবস্থান থেকে সেনাবাহিনীর ১৭টি সক্রিয় এবং ১৪টি রিজার্ভ মোট ৩১টি ব্যাটালিয়ন গড়ে তুলেছিলেন এবং এদের জন্য প্রয়োজনীয় হাতিয়ার, যন্ত্রপাতি এবং যানবাহন দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। একই সময়ে সিঙ্গাপুরের বিমান বাহিনীতে ৪ স্কোয়াড্রন প্রশিক্ষণ ও জঙ্গী বিমান এবং দ্রুতগতিসম্পন্ন দুই স্কোয়াড্রন প্যাট্রোল বোট সংগ্রহ করা হয়। জাতীয় সার্ভিস কর্মসূচীর আওতায় লোকসংখ্যার এক বিশাল অংশ প্রয়োজনে সামরিক দায়িত্বে প্রযুক্ত হওয়ার প্রশিক্ষণ লাভ করে। লীকে এই কর্ম সম্পাদনে সহায়তা করেন তার সুযোগ্য সহকর্মী প্রতিরক্ষামন্ত্রী কেং সুই। এভাবে প্রতিরক্ষণ শক্তিশালীকরণের বাড়তি ফলশ্রুতি হিসেবে সিঙ্গাপুরে জাতিগত বৈষম্য ও বিরোধ তিরোহিত হয় এবং জনগণ সশস্ত্র ও নিরাপত্তা বাহিনীকে তাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের বিকল্পে প্রকৃতই প্রতিরক্ষণকারী সার্ভিস হিসেবে স্বীকৃতি দেন। সিঙ্গাপুরের সশস্ত্র ও নিরাপত্তা বাহিনীর পুনর্গঠন ও বিস্তৃতির এ প্রক্রিয়ায় লী সবসময় সচেতনভাবে সামরিক বাহিনীকে রাজনৈতিক নেতৃত্বের আওতাধীন রেখেছেন। সিঙ্গাপুরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুসংহত করার সঙ্গে সঙ্গে লী সিঙ্গাপুরকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্ববৃহৎ বন্দর ও আন্তঃদেশীয় সমুদ্র বাণিজ্যের মাধ্যম হিসেবে গড়ে তুলেছেন। একই সঙ্গে তিনি যথাযথ প্রশিক্ষণ ও সন্দীপনীয় কার্যক্রমের ভিত্তিতে দেশের শ্রমশক্তিকে শৃঙ্খলাবদ্ধ ও উৎপাদনশীল শক্তিতে রূপান্তরিত করেন। এই ধরনের উৎপাদনশীল শ্রমশক্তির সঙ্গে বিদ্যুত কেন্দ্র, সড়ক ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ করে অবাধ বাণিজ্য প্রযুক্ত ও বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করেন। একই সঙ্গে তিনি তার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে শ্রমিক ইউনিয়ন থেকে উগ্র কমিউনিস্টদের দূরে সরিয়ে অধিকতর উৎপাদনে ব্রতী সহযোগী হিসেবে শ্রমশক্তিকে সংগঠিত ও উজ্জীবিত করেন। বন্দর পরিচালনা, বিমান পরিবহন প্রসারণ ও নগরের সৌন্দর্য বর্ধনে এই শ্রমশক্তির ভূমিকা লক্ষণীয়ভাবে ফলপ্রসূ হয়েছে। নগরের সৌন্দর্য বর্ধন করে তিনি একে প্রাচ্যের উদ্যাননগরে উন্নীত করে সফল পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। একই সঙ্গে সাধারণ মানুষের কল্যাণার্থে লী ব্যাপক গৃহায়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন ও সকলের জন্য ভবিষ্যত পেনশন তহবিল গঠন ও পরিচালনা করে তার ভাষায় সিঙ্গাপুরকে কুশলধর্মী নয়, বরং একটি ন্যায়নিষ্ঠ সমাজে উন্নীত করেন। তিনি অসামরিক প্রশাসনে উদ্যম, নিষ্ঠা, উচ্চতর পারিতোষিক প্রদান, নিপুণতা এবং জনস্বার্থের প্রতি অবিচল আনুগত্য এনে দেন। তিনি প্রায় ধর্ম বিশ্বাসের মতো সরকারকে সবসময় ছোট রাখেন। অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য লী বিনিয়ন্ত্রণ ও অবাধ বাণিজ্যকে দর্শন ও নীতি হিসেবে গ্রহণ ও ব্যবহার করেন। এই দুই দর্শন ও নীতি সিঙ্গাপুরে হাল্কা ও মাঝারি শিল্প স্থাপন ও পরিচালনার জন্য বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করে এবং দেশীয় বিনিয়োগকে উৎসাহিত করে। অবাধ বাণিজ্য নীতির সঙ্গে লী সিঙ্গাপুরে উপকূল বহির্ভূত ব্যাংক স্থাপন ও পরিচালনা বিষয়ে বিদেশী আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে আকর্ষণ করেন, ইউরোডলার বাজার অনুসরণ করে এশিয়ান ডলার বাজার প্রতিষ্ঠিত করেন এবং দেশী ও বিদেশী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান সমন্বয়ে নিউইয়র্ক, লন্ডন, টোকিও, হংকংকে অনুসরণ করে অতীব কার্যক্ষম ও সংবেদনশীল মুদ্রাবাজার প্রতিষ্ঠিত করেন। বর্তমানে সিঙ্গাপুরের এশিয়ান ডলার বাজার সকল প্রকার বিদেশী মুদ্রা এবং বিদেশী মুদ্রায় অভিহিত আর্থিক নির্যাস বা ডেরিভেটিভস নিয়ে বাণিজ্যিক ঋণ সিন্ডিকেশন, বন্ড ইস্যু এবং তহবিল ও সম্পদ ব্যবস্থাপনা নিয়ে পৃথিবীর চতুর্থ বৃহৎ ও কার্যশীল মুদ্রাবাজারে উন্নীত হয়েছে। এখানে মুক্তবাজার ও অবাধ বাণিজ্যের সূত্র অনুযায়ী শিকাগোর মার্কেন্টাইল এক্সচেঞ্জ অনুসরণে সাইন্যালাক্স বা সিঙ্গাপুর ইন্টারন্যশনাল মাল্টি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর শেয়ারবাজার বহুজাতিক ও বহু মুদ্রায় অভিহিত শেয়ারবাজারে বিস্তৃত হয়েছে। একই সঙ্গে এই নগর দেশের কেন্দ্রীয় ভবিষ্যত তহবিল (ঈবহঃৎধষ চৎড়ারফবহঃ ঋঁহফ)-এর মোড়কে প্রায় সকল জনগণের সঞ্চয়ের ভিত্তিতে সিঙ্গাপুর ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই বিনিয়োগ সংস্থা সিঙ্গাপুরের জনগণের সঞ্চয়কে সরকারী ও বেসরকারী অবকাঠামো নির্মাণ ও পরিচালনার উৎস হিসেবে প্রযুক্ত করেছে। সিঙ্গাপুর মুদ্রা কর্তৃপক্ষ তাদের কার্যক্রমের মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের জন্য অনুসরণীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে উন্নীত হয়েছে। সৎ, দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ নেতৃত্ব এবং বস্তুনিষ্ঠ বিবেচনার ভিত্তিতে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ফলশ্রুতি হিসেবে লীর নেতৃত্বে সিঙ্গাপুর তৃতীয় বিশ্বের একটি মাছ ধরা ও বিক্রয়ের কেন্দ্র থেকে মাত্র ৪ দশকে প্রথম বিশ্বের সামনের সারির দেশ হিসেবে উন্নীত হয়েছে। ১৯৫৯ সালে যখন লী সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন সিঙ্গাপুরের মাথাপিছু আয় ছিল যুক্তরাষ্ট্রীয় ৪০০ ডলার। ১৯৯০ সালে লী যখন প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে স্বেচ্ছায় সরে যান তখন সিঙ্গাপুরের মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রীয় ১২২০০ ডলার। ১৯৯৯ সালে মাথাপিছু আয় বেড়ে হয়েছিল ২২০০০ ডলার। মাত্র ৪০ বছরে মাথাপিছু আয় বেড়েছিল ৫৪০০%। এই বাড়া এখনও অব্যাহত আছে। এত কম সময়ে অন্য কোন সমপর্যায়ের রাষ্ট্রের এই মাত্রার ও গতির অর্থনৈতিক উন্নয়ন এই সময়ে সম্ভব হয়নি। ধনতান্ত্রিক দেশসমূহের বাইরে কমিউনিস্ট বিশ্বের চীন ও রাশিয়া লীকে অসাধারণ নেতা বলে সম্মানিত করেছে। আধুনিক চীনের সারথি দেং জিয়াও পিং লীর অর্থনৈতিক উন্নয়ন, উদ্যম, সন্দীপন ও প্রশাসনের প্রশংসা করেছেন এবং চীন থেকে ২২ হাজার কর্মকর্তাকে সিঙ্গাপুর সরকারের নীতি ও পদ্ধতি বীক্ষণ করার জন্য পাঠিয়েছিলেন। ব্রিটেনের মার্গারেট থ্যাচার লীকে কখনও অন্যায় না করার রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। এতদসত্ত্বেও লী কোয়ান ইয়ুর নেতৃত্বের এই রকম সফলতা ন্যূনপক্ষে দুটি অপূর্ণাঙ্গতা সংবলিত বলে পশ্চিমা পৃথিবীর সুশীল সমাজের কতিপয় ব্যক্তি মনে করেছেন। এক. তাদের মতে লী গণতন্ত্রের সূত্র অনুযায়ী সিঙ্গাপুরে কোন বিরোধী দল বা মতবাদকে গড়ে উঠতে দেননি। তিনি বিরোধী রাজনৈতিক দল, এমনকি সংবাদ মাধ্যমকেও দৃঢ় হাতে দমন করেছেন। মানহানির মামলা ও দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে তৎপরতার অভিযোগ আনয়ন প্রেস সেন্সরশিপ আরোপণ ইত্যাদির মাধ্যমে লী সিঙ্গাপুরকে প্রায় একমতের সমাজ ও সরকারে রূপান্তরিত করেছেন। এই প্রেক্ষিতে ১৯৯৯ সালে সিঙ্গাপুরের সাবেক রাষ্ট্রপতি দেবন নায়ার কানাডা থেকে লী কর্তৃক রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের প্রখর সমালোচনা করেন। লী কানাডাতে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেও কিছু করতে পারেননি। সিঙ্গাপুর পার্লামেন্টের এক সদস্য জয়রতœামকে তিনি সরকারের সমালোচনার জন্য আদালত কর্তৃক দেউলিয়া ঘোষণা করিয়ে নির্বাচন অযোগ্য করেন। ২০০৮ সালে ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউর বিরুদ্ধে লী মানহানির মামলা করে সিঙ্গাপুর হাইকোর্ট থেকে তাদের বিরুদ্ধে রায় পান। ২০১০ সালে ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন লী এবং তার দুই ছেলের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে অর্থ অর্জনের অভিযোগ আনে। লী এবং তার দুই পুত্রের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে মামলা করে ক্ষতিপূরণ আদায় করেন। এর ফলে এশিয়া ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে লীর বিরুদ্ধে এই ধরনের অভিযোগ আনা বন্ধ হয়ে যায়। একই সময়ে লী ট্রেড ইউনিয়নকে কমিউনিস্টদের প্রভাব থেকে দূরে সরিয়ে এনে জাপানীদের অনুসরণ করে শিল্প ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর আন্দোলন ও তৎপরতা শুরু করেন। ট্রেড ইউনিয়নের উগ্র তৎপরতার বিকল্পে তিনি শ্রমিক-মালিক আলোচনা, সমঝোতা ও আপোসের মাধ্যমে শ্রমিক ও মালিকের পারস্পরিক স্বার্থসংরক্ষণের ওপর জোর দেন। ১৯৯০ সালে লী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন ও সিনিয়রমন্ত্রী পদবী নিয়ে উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করতে থাকেন। পরে তাকে মিনিস্টার মেন্টর বা বিজ্ঞ মন্ত্রী পদবী দেয়া হয়। ২০১০ সালে লীর জীবন সঙ্গিনী কোয়া গিয়ক চু ৮৯ বছর বয়সে মারা যান। লী তার শেষকৃত্যে বলেছিলেন, চুকে ছাড়া তিনি হয়ত ভিন্নতর ব্যক্তি হতেন, তার জীবন ভিন্নরকম হতো। স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি ক্রমান্বয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন। ২০১১ সালে তার দল প্যাপ নির্বাচনে ৬০% ভোট ও ৯০% আসন পায়, যা তার দলের ইতিহাসে নিম্নতম। জীবনের মৌলিক প্রয়োজন মিটে যাওয়ার পর সম্ভবত সিঙ্গাপুরের জনগণ ব্যক্তি স্বাধীনতাসহ পরিপূর্ণ মানুষের মর্যাদা নিয়ে বিমুক্ত হতে চেয়েছিল। সকল সমাজেই বস্তুগত সমৃদ্ধি অর্জনের পর মানবিক বিকাশের প্রয়োজন বড় হয়ে মানুষের অস্তিত্বকে সফলতার বৈশিষ্ট্য দেয়। এই প্রেক্ষিতে সিঙ্গাপুর সামাজিক অধিকার, মুক্ত চিন্তা ও বহুবাচনিক বাসভূমি হওয়ার দিকে নিশ্চিতভাবে এগিয়ে যাবে। কিন্তু লী কোয়ান ইয়ু যে এভাবে এগিয়ে যাওয়ার বস্তুগত ভিত্তি ও প্রক্রিয়া দিয়েছিলেন তা তারা সবসময় স্বীকার করে যাবেন। তিনি এখনকার প্রধানমন্ত্রী ও তার পুত্রের ভাষায় সিঙ্গাপুরের জনগণকে সিঙ্গাপুরিয়ান হিসেবে গর্বিত করেছিলেন। ১৯৯৮ সালের কোন এক সময়ে সিঙ্গাপুরের সংসদ ভবনের এক কোনায় কয়েক মিনিটের জন্য দেখা হয়েছিল সিঙ্গাপুরের ইতিহাসের এই মহানায়কের সঙ্গে। তখন আমি জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী। পরিচয় পেয়ে বলেছিলেন লী : ‘কখনও নিচে তাকিও না, সামনে আর উপরে তাকিয়ে এগিয়ে যাও।’ তার বর্ণাঢ্য সংগ্রামী ও সফল জীবনের শেষে এই সম্ভবত সকল উঠতি দেশের তরুণদের জন্য তার কার্যক্ষম উপদেশ আর অনুশাসন। লেখক : সংসদ সদস্য, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
×