ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিভিন্ন আর্থিক সূচকে উন্নতি

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে নিয়মের মধ্যে চলার নির্দেশ গবর্নরের

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ৭ এপ্রিল ২০১৫

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে নিয়মের মধ্যে চলার নির্দেশ গবর্নরের

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ বিভিন্ন আর্থিক সূচকে উন্নতি হলেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর সার্বিক পারফরম্যান্সে সন্তুষ্ট নয় বাংলাদেশ ব্যাংক। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে নিয়মের মধ্যে ব্যাংকিং পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ড. আতিউর রহমান। একই সঙ্গে আগামীতে এসব ব্যাংকের কোন ধরনের অনিয়ম ও জাল জালিয়াতি সহ্য করা হবে না বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোন কর্মকর্তার গাফিলতি পরিলক্ষিত হলেও ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছেন তিনি। সোমবার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের নিয়ে বৈঠকে গবর্নর এমন হুঁশিয়ারি দেন। বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গবর্নর এসকে সুর চৌধুরী, নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ নওশাদ আলী চৌধুরী, মহাব্যবস্থাপক রবিউল হাসানসহ উর্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর সঙ্গে করা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমওইউ নিয়ে এই বৈঠক হয়েছে। জানা গেছে, বৈঠকে চলতি বছরের জন্য রিভাইসড এমওইউ হয়নি। তবে সর্বশেষ এমওইউ অনুযায়ী যেসব টার্গেট দেয়া আছে সে অনুযায়ী নিয়মের মধ্যে কার্যক্রম পরিচালনার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া বৈঠকে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা, ঋণ আদায় জোরদার করা, ইন্টারন্যাল কন্ট্রোল এ্যান্ড কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করা ও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অটোমেশন সম্পন্ন করার নির্দেশ দিয়েছেন গবর্নর। বৈঠক শেষে এসকে সুর চৌধুরী সাংবাদিকদের জানান, বিভিন্ন আর্থিক সূচকে উন্নতি হলেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর সার্বিক পারফরম্যান্সে সন্তুষ্ট নয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তাছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতি নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোন সময়ের জন্য একেবারে সন্তোষ প্রকাশ করে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি একেবারে সন্তুষ্ট হয়ে যায়, সেটির সার্টিফিকেট দিয়ে দেয় তাহলে সন্তুষ্টি আর সন্তুষ্টি থাকে না। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মৌলিক দায়িত্বই হচ্ছে যেখানে ভাল সেটি স্বীকার করা। যদিও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো বর্তমানে এমন কোন পর্যায়ে আসেনি যা পুরোপুরি সন্তুষ্টি হওয়ার মতো। তিনি বলেন, তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অগ্রগতি ক্রমশ ভাল হচ্ছে। সুশাসনেও ব্যাংকগুলো এগিয়েছে। এসব ক্ষেত্রে আরও ভাল করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। আর যেসব ক্ষেত্রে দুর্বলতা রয়েছে সেগুলো সমাধানে নজর দিতে বলা হয়েছে। তবে আমাদের কাছে এটি পর্যাপ্ত বা এতে পুরোপুরি সন্তোষ প্রকাশের সুযোগ নেই। তবে সরকারের এই ব্যাংকগুলোকে আগামীতে এমন জায়গায় নিতে যেতে হবে যাতে মানুষের সম্পূর্ণ আস্থার প্রতিফলন ঘটে। এজন্য ব্যাংকগুলোতে আরও দক্ষতা বাড়ানোর ওপর জোর দেয়া হয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে দুর্বলতা রয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তাদের ব্যালেন্সসিট দুই মাসের মধ্যে জমা দেয়ার নির্দেশ ছিল। এক্ষেত্রে যারা সময়মতো দিতে পারেনি তারা আবার সময় চেয়েছে। তাদের আমাদের নিয়ম মোতাবেক এপ্রিল পর্যন্ত সময় দেয়া হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে যাতে ফেল না করে সেই তাগাদা দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে যারা ব্যালেন্সসিট চূড়ান্ত করেছে সেখানেও তথ্যের এদিক সেদিক হয়েছে। দেখা গেছে, তাদের এক্সপোজার অনেক জায়গায় প্রদর্শিত হয়নি। অনেকেই ক্যাপিটাল ১২ শতাংশ দেখিয়েছে। কিন্তু সরকার যদি তাদের ক্যাপিটাল পূরণ না করত, আমরা যদি ক্যাপিটাল ঘাটতি পূরণে সময় বেশি না দিতাম তাহলে চিত্র ভিন্ন হতে পারত। কাজেই তারা যেন ব্যালেন্সসিটে প্রকৃত তথ্য দিয়ে সেটি জনসম্মুক্ষে প্রকাশ করে সেই নির্দেশনা দেয়া। ব্যাংকগুলোর সঙ্গে এমওইউ অনুযায়ী এক বছরের মধ্যে তাদের প্রত্যেকের মোট শ্রেণীকৃত ঋণের ২০ শতাংশ কমিয়ে আনার নির্দেশনা ছিল। এক্ষেত্রেও তারা ব্যর্থ হয়েছে বলে জানান তিনি। শীর্ষ ২০ ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে আদায়ের বেঁধে দেয়া লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়নি কারও কারও। অনান্য ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে আদায়ের অগ্রগতি কেউ ভাল করলেও কারও অগ্রগতি ততটা সন্তোষজনক নয়। এক্ষেত্রে কেউ লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি, কেউ ৩৭ শতাংশ, কেউ ৩০ শতাংশ, কেউ শতভাগের (জনতা ব্যাংক) বেশি আদায় করেছে। যারা আদায়ে ভাল করতে পারেনি তাদের কাছে এর কারণ জানতে চাওয়া হয়েছে। জানা গেছে, বৈঠকে ব্যাংকগুলোকে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অটোমেশন সম্পন্ন করতে বলা হয়েছে। এই সময়সীমা ২০১৬ পর্যন্ত। তবে ২০১৫ সালের মধ্যে প্রত্যেককে ৫০০টি শাখা অটোমেশনের আওতায় আনার নির্দেশনা রয়েছে। যাদের কম রয়েছে তাদের অটোমেশন কার্যক্রম জোরদারের নির্দেশনা দেন গবর্নর। এ্যাডজাস্টেড লোন গ্রোথের টার্গেট পূরণেও ব্যর্থ হয়েছে ব্যাংকগুলো। এক্ষেত্রে কেউ কেউ নেগেটিভেও রয়েছে। সোনালী ব্যাংক নেগেটিভে থাকলেও জনতা ও রূপালী আবার তাদের লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করেছে। এক্ষেত্রে নেগেটিভে থাকা ব্যাংকে ঋণ বিতরণ কার্যক্রমে গতিশীলতা আনার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। আর যারা লক্ষ্যমাত্রা ছাপিয়ে গেছে তাদের ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে। যাতে করে সার্ভিকভাবে টার্গেটের মধ্যে থাকে। বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মনীতির মধ্যে থেকে ব্যাংকগুলোকে ঋণ বিতরণের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। কোনভাবেই যাতে একক ঋণ গ্রহীতার সীমা অতিক্রম না হয় সে বিষয়ে ব্যাংকগুলোকে যথাযথ সতর্ক অবলম্বরের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। বৈঠক সূত্রে জানা যায়, ব্যাংকগুলোতে সুশাসন নিশ্চিতের ওপর জোর দিয়েছেন গবর্নর। ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমে কোন চাপের কাছে নতি স্বীকার না করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তারা বোর্ড বা অন্য কোন পক্ষের চাপে যেন কোন সিদ্ধান্ত না দেয় সেই ব্যাপারে মাথা উঁচু রেখে প্রফেশনালি সিদ্ধান্ত নেয়ার তাগিদ দিয়েছে গবর্নর। তবে ঝুঁকিপূর্ণ বা বড় বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান বা গ্রহীতার ঋণ দিতে গিয়ে একক ঋণ গ্রহীতার সীমা ভঙ্গ না হয় সেদিকে সতর্ক করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বরং ঝুঁকি কম যেখানে, আর্থিক সামাজিক উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখতে পারে এমন জায়গাগুলোতে ঋণের প্রবাহ বাড়ানোর পরামর্শ দেয়া হয়েছে। প্রবৃদ্ধিতে সহায়তা করে এমন জায়গায় বিশেষ করে কৃষি, এসএমই, নারী উদ্যোক্তা, সবুজ অর্থায়ন প্রভৃতি উৎপাদশীল খাতে ঋণ বিতরণ বাড়ানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ব্যাংকগুলোর ইন্টারন্যাল কন্ট্রোল এ্যান্ড কমপ্লায়েন্স জোরদার করার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। তবে ঢালাওভাবে কমপ্লায়েন্স প্রতিবেদন দাখিলকৃত ব্যাংকগুলোর দায়ী কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ব্যাংকগুলোতে জবাবদিহিতা আওতা জোরালো করার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া বৈঠকে যে কোন ধরনের অনিয়ম, জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন গবর্নর। মামলা হলে সেগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির মাধ্যমে তাদের শাস্তি নিশ্চিতের নির্দেশ দিয়েছেন গবর্নর। জালিয়াতি করে কেউ যাতে পার পেয়ে না যায় সে বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা ও পদক্ষেপ নেয়ার নিদের্শও দেন গবর্নর। পুনঃতফসিল সুবিধা নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে সুর চৌধুরী বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের ঋণ পুনঃতফসিলের যে সুবিধা দেয়ার নির্দেশনা রয়েছে সে অনুযাযীই এগুলো পুনঃতফসিলের কথা বলা হয়েছে। যাচাই-বাছাই করেই এগুলোর অনুমতি দেয়া হবে। বৈঠক শেষে রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম ফরিদ উদ্দিন বলেন, আগের তুলনায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের সার্বিক অবস্থা ভাল। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ অবস্থান আরও সংহত করতে কিছু নির্দেশনা দিয়েছে।
×