ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সোহাগপুরের বিধবাপল্লীতে স্বস্তি

‘কামারুজ্জামানের ফাঁসি তাড়াতাড়ি হলে আমরা খুশি অই’

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ৭ এপ্রিল ২০১৫

‘কামারুজ্জামানের ফাঁসি তাড়াতাড়ি হলে আমরা খুশি অই’

রফিকুল ইসলাম আধার একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের আওতায় শেরপুরের সোহাগপুর গ্রামে ১শ’ ২০ পুরুষকে হত্যার দায়ে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের আলবদর প্রধান, জামায়াতের সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের চূড়ান্ত বিচারে দেয়া ফাঁসির দ- পুনর্বিবেচনার আবেদন (রিভিউ পিটিশন) খারিজ হওয়ায় নিজ এলাকা শেরপুরে ও সোহাগপুর বিধবা পল্লীতে স্বস্তি বিরাজ করছে। ৬ এপ্রিল সোমবার সকাল সোয়া ৯টার দিকে আপীল বিভাগের পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজ করে মৃত্যুদ- বহালের আদেশ ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে থাকেন। এক পর্যায়ে তা আনন্দ-উচ্ছ্বাসে রূপ নেয়। দুপুরে শহরে ওই রায়ে স্বস্তি প্রকাশ করে আনন্দ মিছিল করে জেলা ছাত্রলীগ। অন্যদিকে রায়কে কেন্দ্র করে সহিংসতা ও নাশকতামূলক কর্মকা- প্রতিরোধে স্থানীয় প্রশাসন রয়েছে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায়। ফাঁসি কার্যকরের অপেক্ষায় বিধবাপল্লী ॥ ঘাতক কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকরের অধীর অপেক্ষায় রয়েছেন সেই ‘বিধবা পল্লী’র অধিবাসীসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ। সোমবার সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ কামারুজ্জামানের রিভিউ খারিজ করে মৃত্যুদ- বহাল রাখার পর থেকেই সোহাগপুর বিধবা পল্লীর সেই বিধবারা, কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে গোলাম মোস্তফা ও বদিউজ্জামানসহ বিভিন্ন হত্যায় শহীদ পরিবারের সদস্য, দগদগে ক্ষত নিয়ে বেঁচে থাকা নির্যাতিত ব্যক্তি, প্রত্যক্ষদর্শী ও সাক্ষীসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজনদের মধ্যে ওই রায় কার্যকরে শেষ অপেক্ষার পালা শুরু হয়েছে। তারা এখন চূড়ান্ত অপেক্ষার প্রহর গুনছেন। সেই সঙ্গে বাড়ছে ‘ফাঁসি কখন কার্যকর?’Ñ এ মর্মে উৎসুক মানুষের মুহুর্মুহু জিজ্ঞাসা। বিশেষ করে রিভিউ খারিজ হওয়ার পর থেকে উদ্বেগ-আতঙ্কের মধ্য দিয়েও ফাঁসি কার্যকরের অধীর অপেক্ষায় রয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী বিধবা পল্লীর শহীদ রহিমুদ্দিনের স্ত্রী করফুলী বেওয়া, শহীদ আব্দুল লতিফের স্ত্রী হাসেন বানু ও শহীদ ইব্রাহিমের স্ত্রী হাফিজা বেওয়াসহ তাদের স্বজন ও এলাকাবাসী। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রপক্ষের অপর সাক্ষী, শহীদ ছফির উদ্দিনের ছেলে ও সোহাগপুর শহীদ পরিবার কল্যাণ সমিতির সভাপতি মোঃ জালাল উদ্দিন সোমবার বিকেলে জনকণ্ঠকে বলেন, আপীল বিভাগে রিভিউ খারিজ ও ফাঁসি বহাল হওয়ার পরও আমরা বিধবা পল্লীর শহীদ পরিবারের স্বজনরা কামারুজ্জামানের পক্ষের লোকজনের ভয়ে চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রয়েছি। এরপরও আমরা কুলাঙ্গার কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকরের অপেক্ষা করছি। প্রেক্ষাপট সোহাগপুর ॥ শেরপুর জেলা শহর থেকে ৩৬ কিলোমিটার দূরের সীমান্তবর্তী নালিতাবাড়ী উপজেলার কাকরকান্দি ইউনিয়নে সোহাগপুর বিধবা পল্লীর অবস্থান। ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই সোহাগপুর গ্রামে তৎকালীন বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি ও আলবদর কমান্ডার মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নেতৃত্বে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায় পাক-হায়েনার দল ও তাদের স্থানীয় দোসররা। ওইদিন তারা সোহাগপুর গ্রামে নাম না জানা ৪৪ জনসহ ১শ’ ৬৪ জন নিরীহ পুরুষকে নির্মমভাবে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে। ওই গ্রামের অবলা নারীদের উপর চালানো হয় পৈশাচিক নির্যাতন। ঘটনার পর সোহাগপুর গ্রাম পুরুষশূন্য হয়ে পড়ে। সেই থেকে গ্রামটি পরিচিতি পায় ‘বিধবা পল্লী’ হিসেবে। তখন থেকেই সোহাগপুরের স্বামীহারা বিধবা-বীরাঙ্গনাদের কান্নার শেষ ছিল না। আস্তে আস্তে তাদের চোখের জল একেবারেই শুকিয়ে যায়। সময় গড়ায় সময়ের ঘূর্ণাবর্তে। বাড়তে থাকে দিন-মাস-বছর। সেই সঙ্গে গাণিতিক বৈপরীত্যে প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে কমতে থাকে সোহাগপুরের বিধবা-বীরাঙ্গনাদের সংখ্যা। এখন তাদের মধ্যে বেঁচে আছেন মাত্র ৩১ জন। স্বামী হারানোর ব্যথা আর সম্ভ্রম হারানোর ক্ষত বুকে চেপেও এতদিন তারা অপেক্ষায় ছিলেন ঘাতক কামারুজ্জামানসহ তার দোসরদের বিচার দেখার জন্য। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর অবশেষে সোহাগপুরের গণহত্যা-ধর্ষণসহ যুদ্ধাপরাধের মামলায় তার ফাঁসি বহাল হওয়ায় তারা আনন্দিত। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বদর নেতা কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে প্রমাণিত ৫ অভিযোগের মধ্যে সোহাগপুর গ্রামে গণহত্যা ও ধর্ষণ এবং শেরপুর শহরে মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফাকে হত্যার দায়ে মৃত্যুদ- হলেও আপীল আদালত কেবল সোহাগপুর গণহত্যার দায়ে তার মৃত্যুদ- বহাল রাখেন। ফলে গোলাম মোস্তফা হত্যাসহ অন্যান্য অভিযোগের মধ্যে নালিতাবাড়ীর বদিউজ্জামান হত্যা, ময়মনসিংহের দারাসহ ৬ জনকে হত্যার দায়ে যাবজ্জীবন কারাদ- এবং অধ্যক্ষ আব্দুল হান্নানকে নির্যাতনের দায়ে ১০ বছরের কারাদ- বহাল থাকে কামারুজ্জামানের। হত্যা সংক্রান্ত সকল অভিযোগে শহীদ পরিবারের সকল সদস্যরা কামারুজ্জামানের সর্বোচ্চ শাস্তি (মৃত্যুদ-) প্রত্যাশা করলেও চূড়ান্ত বিচারে কেবল সোহাগপুর গণহত্যা ও ধর্ষণের দায়ে তার মৃত্যুদ- বহাল থাকলেও তারা রায়ে তৃপ্ত। বিভিন্ন মহলের প্রতিক্রিয়া ॥ আপীল বিভাগে বদর নেতা কামারুজ্জামানের মৃত্যুদ-ের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজ হওয়ায় এক প্রতিক্রিয়ায় শেরপুর জেলা সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের সভাপতি, মুক্তিযুদ্ধের যুব সংগঠক মোঃ আমজাদ হোসেন বলেন, শহীদ মোস্তফাসহ সোহাগপুরের গণহত্যায় শহীদদের স্বজনরা দীর্ঘ ৪৪ বছর শেরপুরের ‘কুলাঙ্গার’ হিসেবে চিহ্নিত ঘাতক কামারুজ্জামানের শাস্তি দেখার অপেক্ষায় ছিলেন। এজন্য এখন তার ফাঁসি কার্যকরের মধ্য দিয়ে শহীদদের স্বজনদের প্রতীক্ষার অবসানসহ শেরপুরবাসী চূড়ান্তভাবে কলঙ্কমুক্ত হতে চায়। শেরপুর জেলা পরিষদ প্রশাসক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এ্যাডভোকেট আব্দুল হালিম বলেন, রিভিউ পিটিশন খারিজ ও সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি বহাল হওয়ায় জাতির বুকে চেপে থাকা কামারুজ্জামান উপাখ্যানের শেষ হচ্ছেÑ এটিই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার ও এ আদর্শে বিশ্বাসীদের বিশাল প্রাপ্তি। রিভিউ পিটিশন খারিজ করে কামারুজ্জামানের ফাঁসি বহাল রাখায় উচ্চ আদালতের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট চন্দন কুমার পাল পিপি বলেন, এর মধ্য দিয়ে ১৭ কোটি মানুষকে দেয়া বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনা সরকারের নির্বাচনী ওয়াদা পূরণ হচ্ছে। একই কথা জানান শেরপুর পৌরসভার মেয়র হুমায়ুন কবীর রুমান, সদর উপজেলার চেয়ারম্যান ছানুয়ার হোসেন ছানু, জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কমান্ডার নুরুল ইসলাম হীরু, জেলা আওয়ামী লীগের মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক সম্পাদক আলহাজ আব্দুল ওয়াদুদ অদু, চেম্বার অব কমার্স সভাপতি মোঃ মাসুদ, সাবেক সভাপতি ও আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান সংগঠনের সভাপতি গোলাম মোঃ কিবরিয়া লিটন, শেরপুর প্রেসক্লাব সভাপতি রফিকুল ইসলাম আধার, জেলা জাসদ সভাপতি মনিরুল ইসলাম লিটন, শহীদ গোলাম মোস্তফার ভাই মোশারফ হোসেন তালুকদার মানিক, আত্মস্বীকৃত আলবদর সদস্য কামারুজ্জামানের নির্যাতন সেলের দারোয়ান ও রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী মোহন মুন্সি, সাক্ষী মজিবর রহমান পানু। রাজসাক্ষী মোহন মুন্সী বলেন, আলবদর হয়ে যে পাপ করেছিলাম, কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকরের মধ্য দিয়ে আমার সেই পাপ ও কলঙ্কও চূড়ান্তভাবে মোচন করতে চাই। সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থা ॥ রিভিউ খারিজ করে কামারুজ্জামানের মৃত্যুদ- বহাল রাখাকে কেন্দ্র করে সম্ভাব্য পরিস্থিতির আশঙ্কায় শেরপুরে জেলা প্রশাসন এবং পুলিশ প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত অন্যান্য দফতরের সদস্যরা বিশেষ তৎপর হয়ে উঠেছেন। ওই বিষয়ে সোমবার দুপুরে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষ রজনীগন্ধায় এক জরুরী সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে প্রশাসন, পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলার সঙ্গে সম্পৃক্ত অন্যান্য কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাকীর হোসেন ওই সভার সত্যতা নিশ্চিত করে জনকণ্ঠকে বলেন, ওই সভায় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী, ভিকটিম ও জননিরাপত্তাসহ স্পর্শকাতর স্থাপনার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলকে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় থাকতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এজন্য প্রয়োজনে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের নেতৃত্বে জেলা শহরসহ বিভিন্ন এলাকায় স্ট্রাইকিং ফোর্স কাজ করবে। পুলিশ সুপার মোঃ মেহেদুল করিম জানান, জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের মৃত্যুদ- বহালের রায়কে ঘিরে সম্ভাব্য পরিস্থিতি মোকাবেলায় ইতোমধ্যে জেলা পুলিশের তরফ থেকে প্রস্তুতি সভা করা হয়েছে। কামারুজ্জামানের নিজ এলাকা বাজিতখিলাসহ বিশেষ কিছু এলাকায় বাড়ানো হয়েছে নজরদারি। এছাড়া তাদের সম্ভাব্য আস্তানাগুলোর প্রতিও সতর্ক দৃষ্টি রাখা হচ্ছে। র‌্যাব-১৪ (জামালপুর-শেরপুর)-এর ক্যাম্প কমান্ডার মোঃ আনিসুজ্জামান বলেন, মৃত্যুদ- বহালের রায় ঘোষণার পর কামারুজ্জামানের নিজ এলাকা শেরপুরে সম্ভাব্য যে কোন ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় অতিরিক্ত র‌্যাব প্রস্তুত রয়েছে। এজন্য জামায়াত-শিবির ক্যাডারসহ নাশকতা সৃষ্টির পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির সঙ্গে জড়িতদের পাকড়াও করতে বিশেষ অভিযান চলছে। একই কথা জানিয়ে ২৭-বিজিবির (ময়মনসিংহ অঞ্চল) কমান্ডিং অফিসার লেঃ কর্নেল মোঃ নজরুল ইসলাম বলেন, যুদ্ধাপরাধের মামলায় কামারুজ্জামানের চূড়ান্ত রায়কে ঘিরে শেরপুরে সম্ভাব্য পরিস্থিতি বা নাশকতা নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় প্রশাসন সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় রয়েছে। আমরাও সর্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখছি।
×