ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ড. জীবেন রায়

হাজারো কথা লুকিয়ে থাকা একটি ছবি

প্রকাশিত: ০৪:২২, ৭ এপ্রিল ২০১৫

হাজারো কথা লুকিয়ে থাকা একটি ছবি

[এই ছবিটি, সেই ছবি যেখানে লুকিয়ে আছে হাজারও কথা] কবিগুরু এ ছবিটা দেখে কিছু লিখতেন কি? রবীন্দ্রনাথের সারাটাজীবন কেটেছে মৃত্যুর সঙ্গে খেলা করে। ঘনিষ্ঠ আপনজন থেকে শুরু করে কয়েক ডজন প্রিয় মানুষকে হারিয়েও তিনি থেমে যাননি। রবীন্দ্রনাথ সত্যি সত্যিই মৃত্যুঞ্জয়ী মহামানব। ব্রিটিশ চলে গিয়ে ভারতবর্ষ স্বাধীন হোক, তিনি চাইলেও নিরীহ মানুষের মৃত্যু তাঁর সহ্য করতে কষ্ট হতো। একসময় বিপ্লবী ক্ষুদিরামের বোমা হামলায় দু’জন ইংরেজ নারী মারা যান। রবীন্দ্রনাথ সঙ্গে সঙ্গে এর প্রতিবাদ করেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী কালীমোহন ঘোষকে (শান্তিদেব ঘোষের বাবা) লিখিত চিঠিতে সেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ‘মজঃফরপুরে বম্ব ফেলিয়া দুটি ইংরেজ স্ত্রীলোককে হত্যা করা হইয়াছে শুনিয়া আমার চিত্ত অত্যন্ত পীড়িত হইয়াছে। এইরূপ অধর্ম ও কাপুরুষতার সাহায্যে যাহারা দেশকে বড় করিতে চায় তাহাদের কিসে চৈতন্য হবে জানি না।’ রবীন্দ্রনাথ ছবিটা দেখে কি কবিতা লিখতেন? রবীন্দ্রনাথ তো মৃত্যুর ভেতরেও সুন্দর খুঁজেছেন। যা হোক রবীন্দ্রনাথ তো আর ফিরে আসবে না। তার চাইতে বাংলাদেশের প্রিয় কবি নির্মলেন্দু গুণ (ঈশ্বর উনাকে সুস্থ রাখুন) ছবিটা দেখলে তাৎক্ষণিক একটা কবিতা লিখতে পারতেন। আমি কবি নই, কাজেই ছন্দ মিলাতে যাচ্ছি না। তবে ছবিটার পটভূমি তুলে ধরছি কবিতাসম ভাষায় : ও খুকি, তুমি এমন মন মরা কেন? তোমার কি মাও নেই, বাবাও নেই, তুমি এতিম? তোমার মুষ্ঠিবদ্ধ দুটি ছোট্ট হাত আকাশমুখী। তুমি কি আতঙ্কিত? বন্দুকের গুলিতে প্রাণ যাবে এক্ষণি? তোমার এই কাতর মুখশ্রী বিশ্বব্যাপী লক্ষাধিক হৃদয়ক্ষরণ ঘটিয়েছে। বছর চারেকের হিউদিয়া নাম তোমার। টেলিফোটো লেন্স ক্যামেরাকে ভেবেছ, মেশিনগান, এক্ষণি নিবে তোমার প্রাণ। তাই তুমি শিখে ফেলেছ কিভাবে করে হ্যান্ডস আপ। তোমারই মতো দশ হাজার সিরীয় শিশুর শরীরে বিঁধেছে মৃত্যুবাণ। তুর্কী ফটোগ্রাফার ওসমান সাগির্লির এই ছবিটি কথা বলে হাজারোটা। আজকের এই সন্ত্রাসী জামানায় রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে কী করতেন? আমার দৃঢ়বিশ্বাস, রবীন্দ্রনাথ কবিতা লিখাই বন্ধ করে দিতেন। এই তো সেদিন বাংলাদেশে ক্ষমতালোভী এক জোটের অযৌক্তিক হরতাল-অবরোধে একজন হতভাগী মায়ের একমাত্র দু’তিন বছরের মেয়েটি পেট্রোলবোমায় মারা যায় হাসপাতালে। ভদ্রমহিলার স্বামী ক’দিন আগে মারা যায়। ভদ্রমহিলার শেষ অবলম্বন ছিল ওই মেয়েটি। হায়রে বাঙালী জাতি আমরা ক্রমান্বয়ে হারিয়ে ফেলছি আমাদের সহানুভূতি, দয়া-মায়া, ধৈর্য, সর্বোপরি শুদ্ধতম মন। তবু আমরা তুলনামূলক অনেক ভাল আছি। একদল সন্ত্রাসী কেনিয়ায় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বেছে বেছে খ্রীস্টান ছাত্রছাত্রীদের তাৎক্ষণিক মৃত্যুদ- দিয়ে দেয়। তাও একটি নয় দুটি নয়, এক শ’ পঞ্চাশ জন। এই তো গেলবার পাকিস্তানে একটি স্কুলে শতাধিক স্কুল ছাত্রছাত্রীর নিষ্প্রাণ করে ফেলে একদল সন্ত্রাসী। ইয়েমেনে দুটি মসজিদে প্রার্থনারত অবস্থায় শতাধিক লোককে মুহূর্তের মধ্যে পরপারে পাঠিয়ে দেয়। তিউনিশিয়ায় একটি মিউজিয়ামে একদল টুরিস্টকে সন্ত্রাসী বন্দুকধারীরা অতর্কিত আক্রমণ করে ‘না ফেরার দেশে’ পাঠিয়ে দেয়। তাছাড়া লিবিয়া, ইরাক, সিরিয়া, নাইজেরিয়ায় প্রায় প্রতিদিনই মৃত্যু সাইরেন বেজে উঠছে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় এটা কি অধর্মীয় কাজ? আমার কথা, ধর্মটা কার জন্য? যারা মরছে তাদের জন্য, না যারা মারছে তাদের জন্যই ধর্ম? বিষয়টা হয়ত আসলেই কঠিন। তুর্কী ফটোগ্রাফারের তোলা এ ছবিটিই বলে দিচ্ছে গত ৩-৪ বছর ধরে সিরিয়ায় কী হচ্ছে? প্রায় দশ হাজার শিশু মারা গেছে। কুড়ি লাখ লোক শরণার্থী হয়েছে। প্রায় ষাট লাখ লোক সিরিয়াতে মানবেতর জীবনযাপন করছে। একটা দেশ ক্রমান্বয়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। ফটোগ্রাফার ওসমান সাগির্লি এক ক্লিকে একটা সত্যি ঘটনা লিখে ফেলেছেন। তেমনি আর একটা ছবি তুলে ধরছি, যা একটা সিনেমা থেকে নেয়া। পাঠকরা ইচ্ছে করলেই ‘ইউটিউবে’ সিনেমাটি দেখতে পারবেন। ‘দি বয় ইন দি স্ট্রিপ্ড পায়জামা’ ইহুদীদের গ্যাস চেম্বারে মৃত্যুকাহিনী নিয়ে সিনেমাটি নির্মিত। অজস্র সিনেমা নির্মিত হয়েছে নাৎসি বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ ও মানুষ হত্যার পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিয়ে। কিন্তু উল্লিখিত সিনেমাটি অন্তিম হৃদয়বিদারক। কেননা একটি ইহুদী বালক এবং একটি নাৎসি বালক ঘটনাক্রমে গ্যাস চেম্বারে প্রাণ হারায়। ‘দি বয় ইন দি স্ট্রিপ্ড পায়জামা’ সিনেমাটির সেই দুটি বালক; একজন বন্দী। ছয় বছরের ইহুদী বালকটি এবং একই বয়সী নাৎসি বালকটি রাজনীতি বুঝে না (দি বয় ইন দি স্ট্রিপ্ড পায়জামা)। যুদ্ধও বুঝে না। ইহুদীদের বন্দীশালায় সম্প্রচার করা হলো, সবাইকে গোসল নেয়ার জন্য পাশে নবনির্মিত শাওয়ার হলে যাওয়ার জন্য। বালক দুটিও ন্যাংটো হয়ে নাচতে নাচতে শাওয়ার হলে গেল। পুরো হলটাই ছিল একটা পরিকল্পিতভাবে তৈরি একটি গ্যাস চেম্বার। হাজারও লোকের সঙ্গে বালক দুটিও বিষাক্ত গ্যাসের প্রতিক্রিয়ায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। ‘দি বয় ইন দি স্ট্রিপ্ড পায়জামা’ সিনেমাটির শেষ দৃশ্যটি এ রকমই। লাখ লাখ নিরীহ ইহুদীর মৃত্যুর বিনিময়ে ইহুদীরা একটি স্বাধীন দেশ, ইসরাইল পেয়ে গেল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এতবড় একটা জঘন্য ঘটনার ছাব্বিশ বছর পর আবার একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল বাঙালীদের ওপর। বিনিময়ে বাঙালীরা বাংলাদেশ পেল। তারপর? আমরা এখনও ফাইট করছি। একে অন্যকে অহেতুক ‘না ফেরার দেশে’ পাঠিয়ে দিচ্ছি। রাজনীতি তো মানুষের কল্যাণের জন্যই। স্বাধীন বাংলাদেশে আর কেন মারামারি, হানাহানি। এর থেকে রেহাই পাওয়ার একটি উপায় আছে, তা হলো সাধারণ জনগণকে রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ দূরে থাকতে হবে। শুধু যে কোন রাজনৈতিক দলের রেজিস্ট্রিকৃত সদস্যগণই রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করবে। সভা করবে, প্রসেশান করবে, স্লোগান দেবে। রাজনীতির বাইরে থাকা জনগণ শুধু ভোটের সময় ভোট দেবে। জনগণ, আপনারাই আপনাদের মৃত্যু বন্ধ করতে পারেন। আপনারা রাজনৈতিক কোন সভা সমিতি বড় দেখানোর জন্য অংশগ্রহণ করবেন না। লেখক : প্রাবন্ধিক
×