ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মাসুদা ভাট্টি

ভোট চাওয়ার নৈতিক শক্তিটি ওদের আছে তো?

প্রকাশিত: ০৪:২১, ৭ এপ্রিল ২০১৫

ভোট চাওয়ার নৈতিক শক্তিটি ওদের আছে তো?

কোন নির্বাচনকে ঘিরেই জনগণের ভেতর এক ধরনের উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এই উত্তেজনার মূল কারণ কেবলমাত্র নির্বাচনের ক্ষেত্রেই জনগণের ক্ষমতার ওপর ভরসা করতে হয় প্রার্থীদের। এমনিতে জনগণ এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে দূরত্ব বিশাল ও ব্যাপক- এই সত্যটি কেবল বাংলাদেশের মতো শিশু গণতন্ত্রের দেশের ক্ষেত্রে সত্য নয়, উন্নত ও অনুন্নত সকল গণতন্ত্রের ক্ষেত্রেই কথাটি সত্য। ব্রিটেনের মতো প্রথম সারির গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও নির্বাচনের সময়ই কেবল জনগণকে উদ্দীপিত হতে দেখা যায় রাজনীতি নিয়ে, বাকি সময়টা সরকারী সিদ্ধান্ত কিংবা বিরোধী দলের প্রতিবাদ, প্রায়শই জনগণের এতে কোনরকম অংশগ্রহণ থাকে না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প-িতগণ গণতন্ত্রের এই গণবিমুখী প্রবণতা নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন, কারণ নির্বাচন হয়ে গেলেই সরকার ও জনগণের মধ্যে তৈরি হওয়া এই দূরত্ব আসলে দেশে দেশে গণতন্ত্রের ভিতকেই আলগা করে দিচ্ছে বলে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। মানুষ অনেক বেশি রাজনীতিবিমুখ হয়ে পড়েছে এবং শেষাবধি রাজনীতিবিদদের কেউ বিশ্বাস করতে চাইছে না- এই প্রবণতা কোনভাবেই রাজনীতির স্বাস্থ্যের জন্য ভাল নয়। যা হোক, বাংলাদেশে এখন নির্বাচনের হাওয়া বইছে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা ও বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামে মেয়র নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা এতদিন ধরে বাংলাদেশে চলে আসা রাজনৈতিক অস্থিরতার সম্পূর্ণ বিপরীত। বিগত তিন মাসে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আমরা দেখেছি পেট্রোলবোমা হামলায় শতাধিক মানুষের মৃত্যু, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মানুষের আর্তচিৎকার আর হরতাল-অবরোধে দেশের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত হতে। অনেকেই বলতে শুরু করেছিলেন যে, বাংলাদেশের পক্ষে এরপর আর ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হবে না। কথাটি সর্বাংশে না হলেও অনেকাংশেই যে সত্যি তা ব্যাখ্যা করে বোঝানোর প্রয়োজন নেই। কারণ রাজনৈতিক অচলাবস্থার প্রাথমিক শিকার যে দেশের অর্থনীতি তা আমরা সকলেই জানি এবং বুঝি। কিন্তু বিএনপি-জামায়াতের বিশেষ করে বেগম জিয়ার অনড় অবস্থান দেখে অনেকেই মনে করেছিলেন যে, এরা বুঝি আর কোনদিনই জনগণের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে চাইছেন না। কারণ, জনগণের সামনে যেতে হলে জনগণের জন্য অতীতে কাজ করার উদাহরণের সঙ্গে ভবিষ্যতে জনগণের জন্য কিছু করার স্বপ্নও থাকতে হবে। বিএনপি-জামায়াতের আসলে তেমন কিছু আছে কি না, অন্ততপক্ষে ২০০১ সালের পর থেকে, তা নিয়ে গবেষণা হওয়াটা জরুরী। কিন্তু বিগত ৫ জানুয়ারির পর থেকে বিএনপি-জামায়াত যে তা-ব জনগণের সামনে উপস্থাপন করেছে তাতে এই রাজনৈতিক শক্তিটি দেশের মানুষের জন্য রাজনীতি করেছে কোনকালে বা ভবিষ্যতে করবে তার কোন প্রমাণ লক্ষ্য করা যায়নি। সরকার হঠানোর নাম করে সারাদেশের মানুষকে অমানবিক কষ্টের মধ্যে ফেলাটা যে রাজনীতি হতে পারে না, তা একুশ শতকে এসেও যদি কোন রাজনৈতিক শক্তি বুঝতে না পারে তাহলে তা একদিকে যেমন ক্ষমাহীন অপরাধ তেমনই তা বাংলাদেশের মতো উঠতি অর্থনীতির দেশের জন্য চরম অমঙ্গলেরও বটে। কিন্তু এই অচলাবস্থা চলাকালে দেশের বিবেকবান নাগরিকের কাছ থেকেও কিন্তু জনগণ সেই অর্থে কোন প্রকার সহযোগিতা পায়নি। টেলিভিশনের কল্যাণে পরিচিত চেহারার নাগরিককুলকে আমরা দৌড়ঝাঁপ করতে দেখেছি কেবল কী করে অচলাবস্থা ও সহিংসতাকে আরও ঘনীভূত করা যায় এবং অস্থিরতার সুযোগে শেখ হাসিনার সরকারকে উৎখাত করা যায় সে লক্ষ্যে। জনগণের জীবন ও জীবিকা কোন কিছুই তাদের কাছে প্রাধান্য পায়নি। ক্ষমতাসীন সরকারের কঠোর হওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করেছি আমরা, দেখেছি প্রয়োজনের বাইরেও শক্তি প্রয়োগ করতে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপও গ্রহণ করতে। কিন্তু এখন যখন পরিস্থিতি মোটামুটি শান্ত হয়ে এসেছে তখন এ প্রশ্ন কেউ তুলতেই পারেন যে, সরকারের শক্ত হওয়াটা আসলে অপ্রয়োজনীয় ছিল না। জনগণের জানমাল রক্ষার দায়িত্ব সরকারের এবং সরকার তা যে কোন মূল্যেই করবে এবং করা উচিতও। কিন্তু যারা জানমালের প্রভূত ক্ষতি সাধন করেছে তাদের চেনা গেলেও তাদেরই পক্ষ নিয়ে বিবেকবান নাগরিককুলের দূতিয়ালি এবং তাদের পক্ষে দাঁড়িয়ে গণতন্ত্রের আবেগী বক্তব্য রাখাটা বাংলাদেশের জনগণের জন্য কোন উপকারেই যে আসেনি, তা বলাইবাহুল্য। অথচ আজকে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, শ’দেড়েক মানুষকে পুড়িয়ে মেরে, দেশের অর্থনীতির কোমর ভেঙে দিয়ে যখন বিএনপি নেত্রী আদালতে হাজিরা দিয়ে জামিন নেন এবং তার দল নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য তোড়জোড় শুরু করে তখন এই নাগরিককুলের কারও কাছ থেকে এই প্রশ্ন উত্থাপিত হয় না যে, ‘সেই তো গেলি, তবে কেন মানুষ পোড়ালি?’ আমি জানি না, এখন কোন্্ মুখ নিয়ে বিএনপি প্রার্থীরা জনগণের কাছে ভোট প্রার্থনা করবে? জনগণের কাছে ভোট চাইতে যাওয়ার আগে নিজেদের চেহারার ওপর লেগে থাকা পোড়া মানুষের ছাই তারা কোথায় লুকোবে? নাকি রাজনীতিবিদদের চেহারা সবসময়ই সফেদ? তাতে কোন দাগ লাগে না কোনকালে? নাকি রাজনীতি মানেই লজ্জাহীনতার প্রাকটিস? কোনকিছুতেই লজ্জিত হওয়ার কিছু নেই রাজনীতিতে? আর এত কা-ের পরে বিএনপি-জামায়াতের এই নির্বাচনে অংশগ্রহণকেইবা আমাদের বিবেকবান মানুষ কিভাবে দেখছেন? একবারও তাদের সামনে সেই পোড়া মানুষগুলোর মুখ ভেসে উঠবে না? নাকি রাজনীতির জন্য, ক্ষমতার জন্য সকলই জায়েজ? আমাদের সুশীল বিবেক এবং গণমাধ্যম এখন দু’পক্ষকে নমনীয় হতে দেখছেন। কিন্তু এই নমনীয় হওয়ার আগের ভয়ঙ্কর সময়টুকু নিয়েও কথা হওয়া খুব জরুরী। বিশেষ করে যারা এরকম জনগণের সম্পূর্ণ বিপরীতে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে তাদের হাতে ক্ষমতা যাওয়াটা কতটা জনগণ ও রাষ্ট্রের জন্য নিরাপদ সে প্রশ্ন নিয়ে আমাদের কথা বলতেই হবে। এখন নির্বাচন নিয়ে সাজ সাজ রব চারদিকে। প্রার্থীরা তো বটেই, রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরও জনপ্রিয়তার শক্তি প্রদর্শনের লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠছে ক্রমশ। থিওরি বলে যে, জনগণের স্মৃতিশক্তি মূলত দুর্বল, জনগণ কোনকিছুই দীর্ঘকাল মনে রাখে না, বিশেষ করে নিও-মিডিয়ানির্ভর সময়ে জনগণের পক্ষে কোনকিছু দীর্ঘকাল মনে রাখাটা দুরূহ। ফলে বিগত তিন মাসে বা ২০১৩ সালে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক সহিংসতার কথা জনগণকে ভুলতে দেয়া যাবে না বলেই আমি মনে করি। কেউ কেউ হয়ত বলতে পারেন যে, এর ফলে তো সমাজ বা রাষ্ট্র থেকে কোনদিনই অস্থিরতা দূর হবে না। অতীতচারী না হয়ে সামনের দিকে তাকানোর পরামর্শও কেউ কেউ দিতে পারেন। কিন্তু জনগণের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতায় রাজনৈতিক দলগুলোর অতীত কীর্তিও সমানভাবে উচ্চারিত হওয়াটা জরুরী। না হলে ভবিষ্যত সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ না নেয়ার ভুল এক ব্যাপার। আর সে ভুলকে বৈধতা দিতে দেশকে চরম নাশকতার দিকে ঠেলে দেয়ার অপরাধ আসলে ক্ষমার অযোগ্য ভুল। অপরদিকে সে ভুলকে উপেক্ষা করার পরও ২০১৫ সালের প্রথম তিন মাস দেশকে সম্পূর্ণ অচল করে দেয়াটা আসলে ভুলও নয়, অন্যায়ও নয়, এ রাজনৈতিক পাপাচার। এই পাপাচারের আইনগত বিচার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জনগণের আদালতে তার চূড়ান্ত শাস্তি হওয়াটা অত্যন্ত জরুরী। আর নির্বাচনের চেয়ে বড় জন-আদালত আর কী হতে পারে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোয়? সুতরাং, আসছে নির্বাচনে জনগণকে বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন করার দায়িত্ব আসলে অনেকটাই পড়ে গণমাধ্যমের ওপর। লক্ষ্য করার মতো বিষয় হলো, ঢাকার দুটি ও চট্টগ্রামের সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে চলমান নির্বাচনী পরিস্থিতিকে অনেকেই নানাভাবে ব্যাখ্যা করতে শুরু করেছেন। কোন কোন সংবাদ-মাধ্যম দু’পক্ষের নমনীয় হওয়ার কথা বলতে চাইছেন। কিন্তু এই ‘নমনীয়’ হওয়ার বিনিময় মূল্য কিন্তু দেশের জন্য সত্যিকার অর্থেই বিরাট। এতগুলো মানুষের মৃত্যু, সম্পদের সীমাহীন ক্ষতি, গোটা দেশকে বার্ন ইউনিটে পরিণত করার পর কেউ নমনীয় হলে তা নিয়ে উত্তেজিত হওয়ার মধ্যে আমি কোনরকম কৃতিত্ব দেখি না। বরং আমার মনে হয়, নির্বাচনের ফলাফল বিপক্ষে গেলেই আবার শুরু হবে নতুনতর তা-ব এবং নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শক্তি সঞ্চয় করার সুযোগ লাভ সেই ভবিষ্যত তা-বে নতুন মাত্রা যে দেবে না তার কোন নিশ্চয়তা আছে কি? তাই এই মুহূর্তে প্রয়োজন রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে প্রকাশ্য প্রতিশ্রুতি আদায় করে নেয়া যে, পরিস্থিতি যত খারাপই হোক আর কোন সহিংসতা বা তা-ব দেশের মানুষ দেখতে চায় না। মানুষকে মুক্তি দিতে হবে, মানুষকে জিম্মি করে কোন রাজনৈতিক সুবিধা আদায় করা যাবে না। এটা কেবল বিএনপি-জামায়াত নয়, আওয়ামী লীগসহ প্রতিটি রাজনৈতিক দলকেই এই প্রতিশ্রুতি দিতে হবে যে, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য কিংবা ক্ষমতায় থাকার জন্য জনগণকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। গণমানুষকে পুড়িয়ে তন্ত্র রক্ষা করার এই রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে। না হলে নির্বাচন যত সুষ্ঠুই হোক কিংবা যত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণই হোক না কেন, মানুষের প্রকৃত বিজয় অর্জিত হবে না। নির্বাচনে অংশগ্রহণের আগে বিএনপি-জামায়াতকে স্পষ্টত জনগণের সামনে ক্ষমা চাইতে হবে তাদের নির্বাচন ঠেকানোর লক্ষ্যে এবং সরকারের প্রথম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে চালানো তা-বের জন্য। আর সরকারী দলকে ক্ষমা চাইতে হবে যে, এই চরম দুর্যোগে জনগণের পাশে দাঁড়াতে না পারার ব্যর্থতার জন্য। একটি কার্যকর রাষ্ট্রে রাজনৈতিক শক্তির হাতে জনগণ পুড়ে কয়লা হবে আর নির্বাচিত সরকারের দাবিদার হয়ে তা ঘটতে দেয়ার ব্যর্থতা আসলে বড় ধরনের অপরাধ। বিএনপি-জামায়াতের রাজনৈতিক ভুলের বিচার হয়ত জনগণ করবে, কিন্তু মানুষ হত্যা করে, দেশের সম্পদ নষ্ট করে যে ফৌজদারি অপরাধ তারা করেছে, তার বিচার আইন ও বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে হওয়াটা জরুরী। নমনীয় হওয়ার নামে এই বিচার না হওয়াটা বংলাদেশ রাষ্ট্রের ভবিষ্যতের জন্য সুফল বয়ে আনবে না। আসন্ন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে জনগণ যদি এই বিষয়গুলো মনে রাখে তাহলে সঠিক প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রভাব পড়ার সঙ্গে সঙ্গে গণতন্ত্রকেই শক্তিশালী করা হবে বলে আমার বিশ্বাস। কিন্তু সেটা জনগণকে মনে করিয়ে দেয়ার দায়িত্বটি গণমাধ্যম কতটা সঠিকভাবে পালন করে, সেটিই এখন দেখার বিষয়। নির্বাচন বিষয়ে বলার আরও কথা আছে, তা আগামী সপ্তাহে বলার ইচ্ছে রইল। ৬ এপ্রিল ২০১৫ [email protected]
×