ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অবশেষে তৈরি হচ্ছে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল নীতিমালা

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ৬ এপ্রিল ২০১৫

অবশেষে তৈরি হচ্ছে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল নীতিমালা

বিভাষ বাড়ৈ ॥ পুনর্ভর্তি ফি বা সেশন চার্জ এবং মাসিক বেতন বছরে দশ শতাংশের বেশি বাড়ানো যাবে না- এমন নিষেধাজ্ঞা দিয়ে অবশেষে প্রস্তুত হচ্ছে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল নীতিমালা। প্রতিষ্ঠানকে তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করে ‘এ’ শ্রেণীর জন্য নীতিমালায় ঢাকা মহানগর এলাকায় সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা ভর্তি ও সেশন ফি নির্ধারণেরও প্রস্তাব করা হয়েছে। দেশের ইংরেজী মাধ্যম স্কুলগুলোর জন্য নীতিমালার খসড়া প্রস্তুত করে ইতোমধ্যেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে এ সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ কমিটি। শীঘ্রই নীতিমালা চূড়ান্ত করে পরিপত্র আকারে প্রকাশ করা হবে বলে আশা করছেন খসড়া নীতিমালা প্রণয়নসংক্রান্ত কমিটির সদস্যরা। তবে সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো কোন্ এলাকার জন্য সর্বোচ্চ কত টাকা সেশন চার্জ ও বেতন শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেয়া যাবে খসড়া নীতিমালায় সে বিষয়েও কিছুই বলা হয়নি। যদিও এসব বিষয় মন্ত্রণালয় দেখবে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। জানা গেছে, ২০১৩ সালের শেষের দিকে গণমাধ্যমে নীতিমালার অভাবে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের বেপরোয়া শিক্ষাবাণিজ্য নিয়ে গণমাধ্যমে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এ বিষয়ে নীতিমালা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন ইংলিশ মিডিয়ামের দুই শিক্ষার্থীর অভিভাবক জাবেদ ফারুক। এতে রাজধানীর ২৪টি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলকে বিবাদী করা হয়েছিল। বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকারের হাইকোর্ট বেঞ্চ ইংরেজী মাধ্যমের স্কুলগুলোয় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সেশন চার্জ আদায় থেকে সংশ্লিষ্টদের বিরত রাখতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে শিক্ষা সচিব, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালককে নির্দেশ দিয়ে রুল জারি করেন। এরপর নানা আলোচনার পর শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের উদ্যোগে কমিটি গঠনের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো শুরু হয় বহুপ্রতীক্ষিত এ নীতিমালা প্রণয়ন কাজ। কমিটির সদস্যদের অন্যতম মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক এম ইলিয়াছ বলেছেন, খসড়া নীতিমালা ইতোমধ্যেই আমরা প্রস্তুত করেছি। আমরা আমাদের কাজ শেষ করে মন্ত্রণালয়ে জমাও দিয়ে দিয়েছি। এখন কাজ মন্ত্রণালয়ের। নীতিমালায় কী আছে সে বিষয়ে কমিটির এ সদস্য কিছু বলতে না চাইলেও জানা গেছে, কমিটির সদস্যদের ভিন্ন ভিন্ন মতের কারণেই সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো কোন্ এলাকার জন্য সর্বোচ্চ কত টাকা সেশন চার্জ ও বেতনÑ ইংলিশ মিডিয়ামের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেয়া যাবে সে বিষয়ে কিছুৃই বলা হয়নি। বিষয়টি নিয়ে কয়েক দফা বৈঠকও হয়েছে। এলাকাভিত্তিক সেশন চার্জ নির্ধারণের পক্ষে মত দিয়েছেন কমিটির অনেকেই। বিশেষ করে গুলশান, বারিধারার মতো অভিজাত এলাকার স্কুলগুলোর ফি তুলনামূলক বেশি করার পক্ষে মত দেন তারা। তাদের যুক্তিÑ এসব এলাকার স্কুলগুলোর ব্যয় বেশি। তবে কমিটির কিছু সদস্য দ্বিমত পোষণ করে বলেন, রাজধানীর জন্য একটাই নিয়ম হওয়া উচিত। কিন্তু ভর্তি ফি কত হবে? এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রুলের জবাবে নীতিমালার খসড়া দাখিল করা হয় আদালতে। এতে বেসরকারী ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল এবং ‘স্কুল এ্যান্ড কলেজকে’ তিন শ্রেণীতে ভাগ করার কথা উল্লেখ করা হয়। ‘এ’ শ্রেণীর প্রতিষ্ঠানে মহানগর এলাকায় সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা ভর্তি ও সেশন ফি নির্ধারণ করা হয়। মহানগরবহির্ভূত এলাকায় তা হবে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা। ‘এ’ শ্রেণীর প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বেতন মহানগর এলাকায় তিন হাজার টাকা ও মহানগরের বাইরে সর্বোচ্চ দেড় হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়। ৭০০ বা তার বেশি শিক্ষার্থী এবং মানসম্মত শিক্ষক, শিক্ষা উপযোগী অবকাঠামোসহ আনুষঙ্গিক সুবিধা থাকলে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘এ’ শ্রেণীতে পড়বে। ‘বি’ শ্রেণীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি ও সেশন ফি মহানগর এলাকায় সর্বোচ্চ ১৮ হাজার টাকা এবং মহানগরবহির্ভূত এলাকায় সর্বোচ্চ সাত হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়। বেতন মহানগর এলাকায় সর্বোচ্চ দুই হাজার টাকা এবং মহানগরের বাইরে সর্বোচ্চ এক হাজার টাকা, ৪০০-৭০০ শিক্ষার্থী এবং মানসম্মত শিক্ষক, শিক্ষা উপযোগী অবকাঠামোসহ অন্যান্য সুবিধা থাকলে ‘বি’ শ্রেণী ধরা হবে। ৪০০ বা এর নিচে শিক্ষার্থীর সংখ্যা থাকলে ওই প্রতিষ্ঠান ‘সি’ শ্রেণীতে পড়বে। এই শ্রেণীতে মহানগর এলাকায় সর্বোচ্চ আট হাজার টাকা ভর্তি ও সেশন ফি এবং মহানগরের বাইরের এলাকায় সর্বোচ্চ চার হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। ‘সি’ শ্রেণীর প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে মহানগর এলাকায় সর্বোচ্চ বেতন দেড় হাজার টাকা এবং বাইরের জন্য সর্বোচ্চ ৮০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে, ভর্তি ফরম ও ফি বাবদ সরকার-নির্ধারিত অর্থের চেয়ে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিবন্ধন বাতিলসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। নীতিমালায় ভর্তি ফরমের মূল্য মহানগর এলাকায় সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা এবং অন্যত্র সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা রাখা হয়েছে। খসড়ায় আরও বলা হয়েছে, ভর্তির ক্ষেত্রে ন্যূনতম যোগ্যতা থাকা সাপেক্ষে শূন্য আসনের ৫ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা এবং প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের মূলধারায় সম্পৃক্ত করতে ন্যূনতম যোগ্যতা থাকা সাপেক্ষে ২ শতাংশ কোটা সংরক্ষিত থাকবে। প্রতিষ্ঠান প্রধান সংশ্লিষ্ট গবর্নিং বডি বা ম্যানেজিং কমিটির অনুমোদন সাপেক্ষে স্বচ্ছতা বজায় রেখে ভর্তি পরীক্ষার যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ করবেন। এর ব্যতিক্রম ঘটলে প্রতিষ্ঠান প্রধান ব্যক্তিগতভাবে দায়ী থাকবেন বলেও উল্লেখ করা হয়েছে নীতিমালায়। দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, শিক্ষার্থী অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্টরা সব সময়ই বলে আসছেন, নীতিমালা না থাকার কারণেই ফ্রি স্টাইলে চলছে স্কুলগুলো। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আমলাদের গাফিলতির কারণে এতদিন নীতিমালাও হয়নি আর স্কুলকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না শিক্ষা বোর্ডগুলো। জানা গেছে, প্রায় তিন বছর আগে শিক্ষা বোর্ডগুলো অবৈধভাবে পরিচালিত হওয়া ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল এসব স্কুলের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা। দেশে পরিচালিত ইংরেজী মাধ্যমের স্কুলের জন্য একটি পৃথক নীতিমালা প্রণয়নের লক্ষ্যে ২০১২ সালেও উচ্চ আদালত নির্দেশনা দিয়েছিল। সে অনুযায়ী ঢাকা শিক্ষা বোর্ড ইংরেজী মাধ্যম স্কুলের জন্য একটি খসড়া নীতিমালা প্রণয়নেও হাত দিয়েছিল। এরপর মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট অনুবিভাগের কর্মকর্তারা এ নিয়ে আগ্রহ দেখায়নি। উল্টো এ বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরির জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি প্রতিবেদন তৈরিতেই সময়ক্ষেপণ করে। ফলে সে সময় পৃথক নীতিমালা প্রণয়ন অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, নীতিমালা না থাকায় এ জাতীয় স্কুলকে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি কখনই। উল্লেখ্য, সব স্কুলকেই দেশের সব জাতীয় দিবস যথাযথভাবে উদ্যাপন এবং সব ধরনের অপসংস্কৃতি চর্চা পরিহারের কথা বলা হয়েছে জাতীয় শিক্ষানীতিতে। পাশাপাশি সাধারণ ধারার মতো বাংলা ও বাংলাদেশের ইতিহাস সম্পর্কিত অভিন্ন পাঠ্যবইয়ের কথা বলা হয়েছে। ঢাকা শিক্ষা বোর্ড সূত্র জানায়, ‘রেজিস্ট্রেশন অব প্রাইভেট স্কুলস অর্ডিন্যান্স-১৯৬২’র অধীনে ২০০৭ সাল থেকে একটি নীতিমালায় বেসরকারী (ইংরেজী মাধ্যম) বিদ্যালয়ের সাময়িক নিবন্ধন প্রদান শুরু হয়। কিন্তু অধিকাংশ ইংরেজী মাধ্যম স্কুলই নিবন্ধন করেনি। সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নীতিমালা অনুযায়ী ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলকে প্রথমে সাময়িক অনুমোদন দেয়া হয় দু’বছরের জন্য। এরপর প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম ও মান যাচাই-বাছাই করে প্রয়োজনানুসারে আরও দু’বছর কিংবা পাঁচ বছরের জন্য সাময়িক নিবন্ধন দেয়া হয়। স্থায়ীভাবে এসব প্রতিষ্ঠানকে নিবন্ধন দেয়া হয় না। পাঁচ বছর পরপর ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের কার্যক্রমের ওপর তদন্ত প্রতিবেদন প্রণয়নের নিয়ম রয়েছে। তবে ভাড়া বাড়িতে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল প্রতিষ্ঠার সুযোগ না থাকলেও অধিকাংশ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলই ভাড়া বাড়িতে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। জানা গেছে, বর্তমানে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে সাময়িক নিবন্ধনপ্রাপ্ত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল এক শ’রও কম। তবে শিক্ষা ২০১১ সালেই তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বেনবেইস) এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, সারাদেশে তিন ক্যাটাগরিতে ১৫৯টি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
×