ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মোজাম্মেল খান

অভিজিতের পর ওয়াশিকুর এরপর কে?

প্রকাশিত: ০৫:০৫, ৬ এপ্রিল ২০১৫

অভিজিতের পর ওয়াশিকুর এরপর কে?

অভিজিত রায়ের নৃশংস হত্যাকা-ের মাত্র একমাস পর অন্য এক ব্লগার এবং অনলাইনকর্মী ৩০ মার্চ একইভাবে প্রকাশ্য দিবালোকে নৃশংসতার শিকার হলেন রাজধানীর তেজগাঁও শিল্প এলাকায়। তিন চাপাতিধারী যুবকের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে জীবন দিলেন ২৭ বছর বয়সী যুবক ওয়াশিকুর রহমান বাবু, যাকে প্রকাশ্য দিবালোকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তবে অভিজিতের হত্যাকারীরা যেভাবে শত শত উদাসীন মানুষ এবং আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষের চোখের ওপর দিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল এবারে সেরকম ঘটেনি। এবারে দু’জন মানুষ, যাদের আমাদের সমাজে ‘হিজড়া’ হিসেবে অভিহিত করা হয়, তারা এক মাইলের মতন হত্যাকারীদের ধাওয়া করে তিনজন হত্যাকারীর দু’জনকে পাকড়াও করতে সমর্থ হয়। এদের মধ্যে একজন চট্টগ্রাম হাটহাজারী মাদ্রাসার ছাত্র জিকরুল্লাহ আর অন্যজন রাজধানীর মিরপুর দারুল উলুম মাদ্রাসার ছাত্র আরিফুল ইসলাম। উভয়েই প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তাদের অপরাধ স্বীকার করেছে। আমি অভিজিতকে পনেরো বছর ধরে জানতাম এবং তাঁর ব্যাপকভাবে পরিচিত মুক্তমনা ব্লগে দীর্ঘ সময় লিখেছি। অন্যদিকে দুর্ভাগা ওয়াশিকুর রহমান সম্পর্কে আমি কোন কিছু জানতাম না। পরে জেনেছি সে প্রচণ্ড ধর্মীয় মৌলবাদবিরোধী ছিল এবং বেশিরভাগ সময়ই সে ফেসবুকে সক্রিয় ছিল এবং তার মতামত এক বাংলা ব্লগোস্ফিয়ারে ব্যক্ত করত। তার হত্যাকাণ্ডের পর সামাজিক মিডিয়ায় নিন্দা আর প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। তার মর্মান্তিক মৃত্যুর পর আমি ফেসবুকে তার একটা স্ট্যাটাস দেখি, যেখানে সে লিখেছিল, ‘না, আর লিখব না, যুদ্ধাপরাধী, মৌলবাদ, জাতি ও রাজনীতি নিয়ে। এমনিতেই লিখলে কিছু হয় না, শুধু মনের ঝালটা মিটাই। কিন্তু তাতেও নাকি অনুভূতি আহত হয়, ‘শান্তি’ বিনষ্ট হয়, উন্নয়ন ব্যাহত হয়। সুতরাং, আমি এমন কিছু নিয়ে লিখব যাতে কারও জন্য কোন সমস্যা তৈরি না হয়। গল্প লিখি। এক যে ছিল রাজা। সর্বশেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় পরাজিত এবং নির্মমভাবে নিহত হয়েছিলেন। অবশ্য মীরজাফর তাঁর কৃতকর্মের শাস্তি ভোগ করেছিলেন অচিরেই। কিন্তু মীরজাফরের চেয়ে শতগুণ ভয়ঙ্কর যুদ্ধাপরাধীরা অনেক বছর এ দেশে শান্তিতে বসবাস করছে। ক্ষমতার স্বাদও নিয়েছে। এসব নিয়ে লিখলেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ব্যাহত হবে। স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকারদের দোসর তিলক পরবে! আমাকে কি কেউ উপদেশ দেবেন আমি কি নিয়ে লিখব যাতে করে সরকার, রাজনৈতিক দল, মৌলবাদীরা, জনগণ, স্বাধীনতার পক্ষের, স্বাধীনতাবিরোধী, সব গোষ্ঠী শান্তিতে থাকবে। আছেন কি কেউ বুদ্ধি দেয়ার মতন?’ অভিজিতের হত্যার পর যেভাবে বিশ্ব গণমাধ্যমে হেডলাইন হয়েছিল ঠিক একইভাবে ওয়াশিকুরের হত্যাকাণ্ড বিশ্ব গণমাধ্যমে প্রাধান্য পেয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমস, ‘বাংলাদেশের হত্যা ধর্মনিরপেক্ষ ব্লগারদের জন্য হিমবার্তা’ হেডিং-এ লিখেছে, ‘সোমবার সকালে ওয়াশিকুর রহমান যখন কাজে যাচ্ছিলেন তখন তিনি তাঁর ফেসবুকে যা লিখছিলেন সে লেখার কারণে তাঁকে হত্যা করা হয়। এটা একই ধরনের হত্যাকাণ্ড প্রায় একমাস আগে যার শিকার হন লেখক ব্লগার অভিজিত রায়, তিনি যখন বইমেলা থেকে ফিরছিলেন। অভিজিতের হত্যাকাণ্ড ওয়াশিকুরের হৃদয়ে এমনভাবে নাড়া দেয় যে, তিনি তার ফেসবুকে প্রোফাইল দেন, ‘আমিই অভিজিত’ এই লিখে’। সিএনএন, ‘ওয়াশিকুর রহমান বাংলাদেশে আর একজন ধর্মনিরপেক্ষ ব্লগারকে কুপিয়ে হত্যা করা হলো’ এ হেডিং করে লিখেছে, ‘সোমবার ২৭ বছর বয়স্ক রহমান তাঁর বাড়ির পাশেই কাজে যাওয়ার পথে একই ধরনের নৃশংসতার শিকার হলেন, যে ধরনের নৃশংসতায় জীবন দিলেন অভিজিত রায়। দু’জনকেই চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।’ অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ থেকে শুরু করে আমরা হারিয়েছি আহমেদ রাজীব হায়দারকে, প্রায় হারিয়েছিলাম আসিফ মহিউদ্দিনকে, হারিয়েছি অভিজিত রায়কে এবং এখন হারালাম ওয়াশিকুর রহমানকে। তবে জনগণের জানা মতে এই ঘৃণ্য অপরাধের অপরাধীদের কেউ এখনও কোন বিচারে সাজাপ্রাপ্ত হয়েছে বলে জানা নাই। গত ছয় বছর ধরে আমাদের দেশে এমন একটি সরকার রয়েছে যে সরকার আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ও গুণাবলী ধারণ এবং লালন করে, যে মূল্যবোধের সর্বাগ্রে রয়েছে চিন্তা ও বিশ্বাসের স্বাধীনতা। আমাদের দেশের ভেতরে এবং বাইরে এটা ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয় যে, আমাদের সমাজ দুর্নীতিগ্রস্ত ও অপরাধে জর্জরিত। তবে এ ধরনের অপরাধের জন্য সাজাপ্রাপ্তদের সংখ্যা খুব কমই যেটা ওই উপলব্ধির বৈধতা প্রতিফলিত করে না। আমাদের সমাজে অপ্রতিরোধ্য অপরাধ এবং দুর্নীতির কারণ নিয়ে যদি কেউ এক গবেষণা-বিশ্লেষণ করেন, তবে তার প্রথম, প্রধান এবং সর্বাগ্রে উত্তর হবে অপরাধীদের দ্বারা আস্বাদিত দায়মুক্তি। প্রতিটি নৃশংস ঘটনার পর আমরা গ্রেফতার, রিমান্ড, স্বীকারোক্তি ইত্যাদি শুনতে পাই; কিন্তু কদাচিৎ আমরা শুনতে পাই অপরাধীদের বিচার বা কোন শাস্তি সম্পর্কে। সবকিছু দেখে মনে হয় আমাদের বিচারব্যবস্থা জামিন প্রদানের ব্যাপারে যতটা উদার ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার ব্যাপারে ততটা নিবেদিত নয়। এই উদার জামিন সন্দেহভাজন অপরাধীদের আরও ভয়ঙ্কর অপরাধ সংঘটনে উৎসাহিত করেছে। অভিজিতের হত্যাকা-ের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার বিভাগের এ দুর্বলতা সামনে নিয়ে একজন প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি, যার মতে ‘দায়মুক্তির সংস্কৃতির জন্য বিচার বিভাগকে অবশ্যই দায় নিতে হবে, যার পরিপ্রেক্ষিতে অভিজিত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। যেহেতু অতীতে মুক্ত চিন্তার মানুষদের হত্যাকারীদের বিচার না হওয়াতে অন্য মৌলবাদীরা অনুরূপ আক্রমণ করার ব্যাপারে উৎসাহিত হয়েছে।’ তিনি হত্যাকা-ের সন্দেহভাজন অপরাধীদের সহজে হাইকোর্ট থেকে জামিন পাওয়ার দিকে ইঙ্গিত করেছেন। তাঁর ভাষায় ‘যারা সন্দেহভাজন হত্যাকারীদের জামিন মঞ্জুর করেছেন তাঁরাও এ রক্তগঙ্গার জন্য দায়ী, অভিজিত যার সর্বশেষ শিকার’, বললেন সাবেক প্রধান বিচারপতি। নির্দিষ্ট অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া অনেক জঙ্গী নেতাকর্মী জামিন নিয়ে জেল থেকে বের হয়ে জঙ্গী কার্যক্রমে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ওয়াশিকুর রহমানের ওপর আক্রমণ চালিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় ধরা পড়া আরিফুল ইসলাম এ প্রক্রিয়ার এক জ্বলন্ত উদাহরণ। ২০১২ সালের ৮ জানুয়ারি নরসিংদীর রায়পুরার অধীনে কাচারকান্দি মিতাউল উলুম মাদ্রাসা থেকে বিভিন্ন ধরনের জঙ্গী প্রশিক্ষণ গ্রহণের অভিযোগে অন্য ১১ জনসহ তাকে গ্রেফতার করা হয়। তাকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে অভিযুক্ত করা হয় এবং কারাগারে পাঠানো হয়। কিন্তু তিন সপ্তাহ পরে নরসিংদীর একটি আদালত থেকে জামিন পায়। অন্য আটককৃতরাও তার সঙ্গে মুক্তি পায়। মুক্তির পর সে ঢাকা ও চট্টগ্রাম অবাধে ঘুরাফেরা করেছে। ওয়াশিকুরকে হত্যা করে পালিয়ে যাওয়ার সময় ধরা না হওয়া পর্যন্ত তাকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সম্পূর্ণরূপে ভুলেই গিয়েছিল। বর্তমান সরকার মৌলবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ক্রুসেড অব্যাহত রাখার দৃঢ়তায় বাইরের বিশ্বে একটি ইতিবাচক প্রতিচ্ছবি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। অবশ্য গত কয়েক বছর ধরে যেসব ভয়ঙ্কর হত্যা সংঘটিত হয়েছে সেসব সন্দেহভাজন অপরাধীকে বিচারের আওতায় এনে যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করার প্রক্রিয়ায় কোন অগ্রগতি হয়নি। মনে হচ্ছেÑ অভিজিত হত্যা মামলার তদন্ত ঝুলে গেছে এবং গত এক মাস ধরে এ তদন্তে কোন অগ্রগতি হয়েছে বলে মনে হয় না। প্রেস রিপোর্ট অনুযায়ী, অভিজিত রায় ও আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী সন্দেহভাজন মৌলবাদী ইসলামী গ্রুপ আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নেতা রেদানুল আজাদ রানা দেশ থেকে পালিয়ে গেছে। অভিজিতের পিতা তদন্ত অগ্রগতির ব্যাপারে হতাশা প্রকাশ করেছেন। অভিজিত রায় হত্যার তদন্তকারী গোয়েন্দা সংস্থা তারা খুনীদের চিহ্নিত করতে এখনও সমর্থ হয়নি বলে স্বীকার করেছে। এ কথাও ঠিক যে, বর্তমান হত্যা বিগত দিনগুলোতে সংঘটিত হত্যাসমূহের দায়মুক্তির ফসল। এই ধরনের হত্যাকাণ্ড পূর্ববর্তী হামলার ও হত্যাকাণ্ডসমূহের সুষ্ঠু তদন্ত করে প্রকৃত দোষীদের উপযুক্ত শাস্তির বিধান করলে ঘটত না। ওয়াশিকুর হত্যায় উভয় সন্দেহভাজন আটক অপরাধী হত্যার কথা স্বীকার করেছে এবং এ হত্যায় তারা মোটেও অনুতপ্ত নয়। সেদিক দিয়ে সরকার রয়েছে এক সময় সন্ধিক্ষণে, যাতে করে ওয়াশিকুর হত্যায় নিয়োজিত বর্তমান সন্দেহভাজন অপরাধীদের এবং তাদের আদেশ দেয়া নেতাদের অপরাধের দ্রুত তদন্তের মাধ্যমে যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করার। সরকার দ্রুত তাদের বিচারের আওতায় আনতে ব্যর্থ হলে, যেমন অতীতে হয়েছে, তখন বড় প্রশ্ন হবে, পরবর্তী শিকার কে হবেন? এ প্রশ্নটি দেশের সেসব মানুষের বিবেকের প্রতিধ্বনি যারা এখনও স্বপ্ন দেখেন যে, তাদের জন্মভূমি হবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, চিন্তা, বিবেক, ধর্ম ও বিশ্বাসের স্বাধীনতার এক পুণ্যভূমি।
×