ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

লাভ-ক্ষতির হিসাব কষছে আওয়ামী লীগ-বিএনপি

সিটি নির্বাচন নিয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জে দুই দল

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ৫ এপ্রিল ২০১৫

সিটি নির্বাচন নিয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জে দুই দল

উত্তম চক্রবর্তী ॥ কঠিন চ্যালেঞ্জে দুই দল। তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনই এখন জাতীয় রাজনীতির ‘টার্নিং পয়েন্ট’। বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সিটি নির্বাচনকে সামনে রেখে এমন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। উভয় দলই এই স্থানীয় নির্বাচনকে রাজনৈতিক জয়-পরাজয়ের অগ্নিপরীক্ষা হিসেবেই দেখছে। রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতির হিসাবও কষছে প্রধান এ দু’দলের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক জোটগুলো। প্রায় তিন মাসব্যাপী আন্দোলন করেও কার্যত ব্যর্থ হওয়া বিএনপি এ নির্বাচনকে দেখছে ‘টিকে থাকার’ লড়াই হিসেবে। আর ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ চাইছে, তিন সিটিতে বিজয়ের মাধ্যমে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটকে রাজনৈতিকভাবে আরও অস্তিত্বের সঙ্কটে নিপতিত করতে। রাজনৈতিক মাঠে পরস্পরবিরোধী হুমকি-ধমকি চললেও নির্বাচনের কৌশলী খেলায় ব্যতিব্যস্ত এখন প্রধান দু’দলই। প্রায় আড়াই মাস পর হলেও এখন দেশের রাজনীতি হয়ে উঠেছে নির্বাচনকেন্দ্রিক। চলমান সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে মূলত এই তিন সিটি নির্বাচন জাতীয় রাজনীতিতে ‘নতুন মোড়’ হিসেবেই সামনে চলে এসেছে। টানা আড়াই মাসেরও বেশি সময় দেশের মানুষের দৃষ্টি ছিল অবরোধ-হরতালকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সংঘাত-নাশকতা আর মানুষকে পুড়িয়ে মারার বীভৎসতা, সঙ্কট সমাধানে বিদেশী কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তৎপরতা ও রাজনৈতিক পটপরিক্রমায়। আর এ পরিস্থিতিতে সারাদেশেই সৃষ্ট উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছাপিয়ে জনদৃষ্টি এখন ঘুরছে ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের দিকে। হঠাৎ করেই অনিশ্চিত ও সহিংস রাজনৈতিক পরিবেশ হয়ে উঠেছে নির্বাচনমুখী। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, সংশয় ও পারস্পরিক সন্দেহ থাকলেও প্রায় সব মহলেই আলোচনার শীর্ষে এই তিন সিটি নির্বাচন। বিশেষ করে, দেশের প্রধান দুই শহর রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বাসিন্দাদের চোখ এখন এই নির্বাচনের দিকে। যার কমবেশি ছোঁয়া লেগেছে প্রায় গোটা দেশেই। জনমনেও সৃষ্টি হয়েছে এই নির্বাচনকে উপলক্ষ করে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর ভীতিকর অবস্থা থেকে মুক্তি চাইতে। পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন, এ তিন সিটিতে যে দলের সমর্থিত প্রার্থী বিজয়ী হবে, সেই দলই হবে ভবিষ্যত রাজনীতির মাঠের প্রধান ক্রীড়নক। তবে সেক্ষেত্রে একটু বেশিই চাপে রয়েছে বিএনপি। এ নির্বাচনেও পরাজয় ঘটলে অবশ্যই চরম রাজনৈতিক সঙ্কটে পড়তে হবে দলটিকে। সে কারণেই সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিএনপি চাইছে সহিংস রাজনীতি ছেড়ে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে প্রবেশের মোক্ষম সুযোগ হিসেবে। আর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও চাইছে নির্বাচনে জয়-পরাজয় যা-ই হোক, বিএনপি-জামায়াত জোটকে নাশকতা-সহিংস রাজনীতি থেকে বের করে এনে স্বাভাবিক রাজনীতির পথে ফিরে আসার সুযোগ দিতে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলের অবরোধ-হরতালকে কেন্দ্র করে পেট্রোলবোমায় শতাধিক মানুষকে পুড়িয়ে মারাসহ নানা অমানবিক ঘটনায় গত আড়াই মাস ধরেই দেশের জনগণ ছিল এক ধরনের উৎকণ্ঠা ও অজানা ভিত্তিতে। ‘কবে বন্ধ হবে সন্ত্রাস, স্বাভাবিক অবস্থায় কখন ফিরবে জনজীবন’- দেশের কোটি কোটি মানুষের ছিল অভিন্ন এই একই প্রশ্ন! হঠাৎ করেই তিন সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনী ডামাডোল বেজে উঠায় ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করেছে রাজনীতিতে সৃষ্ট গুমোটভাব। কমে এসেছে পেট্রোলবোমা মেরে নৃশংস কায়দায় মানুষ হত্যার মহোৎসব। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে শুরু করেছে দেশের রাজনীতি। এ অবস্থায় সহিংস রাজনীতির বদলে এখন দেশের সর্বত্র আলোচনায় প্রাধান্য পাচ্ছে তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। ধীরে ধীরে নির্বাচনী জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে দেশের রাজনীতি। দেশের সর্বত্রই এখন হরতাল-অবরোধের পরিবর্তে এই নির্বাচনই আলোচনায় প্রাধান্য পাচ্ছে। এমনকি গণমাধ্যমেও হরতাল-অবরোধের খবরাখবরের পরিবর্তে প্রাধান্য পাচ্ছে তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের নানামুখী প্রতিবেদনই। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও বলছেন, তিন সিটি নির্বাচনকে ঘিরেই পাল্টে যেতে পারে রাজনৈতিক দৃশ্যপট। এ নির্বাচনকে সরকার ও বিএনপি উভয় পক্ষের জন্যই ‘একটা সুযোগ; হিসেবে দেখছেন তাঁরা। তাঁদের মতে, হরতাল-অবরোধে নামে সহিংস-নাশকতার রাজনীতি থেকে বিএনপিকে বের করে এনে নির্বাচনমুখী করা গেলে- সেটি সরকারের জন্যও স্বস্তিদায়ক হবে। আবার ‘অস্তিত্বের সঙ্কট ও ডেডলক’ অবস্থা থেকে বের হওয়ার জন্য বিএনপিরও এই নির্বাচনকে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করা উচিত। এতে করে দেশের জনগণ মুক্তি পেতে পারেন সহিংস-নাশকতামূলক ভয়াবহ রাজনীতির কবল থেকে। সবার অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে সেটি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক হবে, জাতীয় রাজনীতিতেও তা ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতির হিসাব থেকেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দু’পক্ষই চাইছে বিজয়ের সুসংবাদটি নিজেদের ঘরে তুলতে। এক্ষেত্রে বিএনপির জন্য পরীক্ষাটা একটু ভিন্ন। এমনিতেই তাদের আড়াই মাসের ধ্বংসাত্মক রাজনীতি জনগণের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। জনসমর্থন অর্জনের পরিবর্তে টানা সহিংস কর্মসূচী পালন করতে গিয়ে কার্যত অস্তিত্বের সঙ্কটের মুখোমুখি হতে হয়েছে বিএনপিকে। দেশ-বিদেশে ন্যূনতম সমর্থন আদায়ের পরিবর্তে উল্টো ধ্বংসাত্মক রাজনীতির কারণে শত শত মামলায় ২০ দলীয় জোটের ক্যাডার-সন্ত্রাসীরা আন্ডারগ্রাউন্ডে যেতে বাধ্য হয়েছে, আর সহিংস রাজনীতির বিপক্ষে থাকা সাধারণ নেতাকর্মীরাও রাজনীতির মাঠ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। দলটির একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, রাজনৈতিক পরাজয়ের জটিল অঙ্ক থেকেই বিএনপি না পারছে কর্মসূচী সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়ে স্বাভাবিক রাজনীতিতে আসতে, বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াও না পারছেন প্রায় আড়াই মাস ধরেই গুলশানের দলীয় কার্যালয়ে স্বেচ্ছায় অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে। তবে রাজনীতির ওই জটিল অঙ্ক বিএনপির জন্য অনেকই সহজ করে দিয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগই। তাদের দেয়া তিন সিটি নির্বাচনের ঘোষণা লুফে নিয়ে অংশগ্রহণের মাধ্যমে ‘ডেডলক’ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে চাইছে বিএনপি। বিএনপির সূত্রগুলো বলছে, সিটি নির্বাচনের সুযোগ নিয়েই প্রায় তিন মাস ধরে দলীয় কার্যালয়ে স্বেচ্ছায় অবরুদ্ধ থাকা বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া আজ রবিবার সেখান থেকে বেরিয়ে জনসন্মুখে আসতে পারেন। দুর্নীতির মামলায় আদালতে আত্মসমর্পণ করার মাধ্যমে দলীয় কার্যালয় থেকে বেরিয়ে প্রকাশ্য রাজনীতিতে আসছেন তিনি। তাঁরা এও বলছেন, আজ আদালতে হাজিরা দিলে আর নিজের কার্যালয়ে নয়, নিজ বাড়িতেই ফিরবেন খালেদা জিয়া। বিএনপি নেত্রী যেহেতু এখন বিরোধী দলের নেতাও নন, সাধারণ একজন রাজনীতিবিদ- সে কারণে সিটি নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের বিজয়ী করতে সরাসরি নির্বাচনে প্রচারে নামতে পারেন খালেদা জিয়া। এর মাধ্যমে একদিকে দলীয় প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত, অন্যদিকে মনোবল ভেঙ্গে যাওয়া ও আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা নেতাকর্মীদের প্রকাশ্য রাজপথে এনে দলকে চাঙ্গা করে তোলা- এ দুই টার্গেট থেকেই নির্বাচনী কর্মকৌশল চূড়ান্ত করছে বিএনপি-জামায়াত জোট। এদিকে অতীতের সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে এবার প্রথম থেকেই সাবধানী অবস্থানে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। তারাও এ নির্বাচনকে অনেকটা চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নিয়েছে। দলের মধ্যে অনৈক্য, বিশৃঙ্খলা, দ্বন্দ্ব-বিবাদের কারণে অতীতে সিটি নির্বাচনগুলো একে একে হাতছাড়া হয়েছে আওয়ামী লীগের। এবারও যাতে ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেজন্য আগে থেকেই একক প্রার্থিতা নিশ্চিত করতে মরিয়া দলটি। সেক্ষেত্রে অনেকটাই সফলতা দেখাতে সক্ষম হয়েছে তারা। ঢাকা উত্তর সিটিতে ক্লিন ইমেজের ব্যবসায়ী আনিসুল হককে মনোনয়ন দিয়ে প্রথমেই চমক দিয়েছেন দলটির সভানেত্রী শেখ হাসিনা। আর দক্ষিণে মতবিরোধ থাকলেও শেষ পর্যন্ত সাঈদ খোকনকেই একক প্রার্থীই শুধু নয়, সব পক্ষকেই তাঁর পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে নামাতেও সক্ষম হয়েছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। তবে সিটি নির্বাচনটা সরকারের জন্য পরীক্ষাটাও একটু ভিন্ন। সরকার চায় একদিকে প্রভাবমুক্ত নির্বাচন করার প্রমাণ দিতে, অন্যদিকে জনপ্রিয়তা দিয়েই দলের বিজয় নিশ্চিত করতে। এক্ষেত্রে একক প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিএনপির চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে আওয়ামী লীগ। দলটির সব পর্যায়ের নেতারাই এ নির্বাচনকে সন্ত্রাস-নাশকতা ও জঙ্গীনির্ভর রাজনীতির বিরুদ্ধে গণতন্ত্র-শান্তির পক্ষের নির্বাচনী যুদ্ধ হিসেবে দেখছে। দলটির নেতারা মনে করেন, হিসাব-নিকাশের সামান্য ভুলে বিএনপির প্রার্থীরা বিজয়ী হলে তারা পরবর্তীতে জাতীয় নির্বাচনের দাবি জানাবে। কিন্তু প্রায় আড়াই মাস ধরে বিএনপি-জামায়াতের ভয়াল তা-ব আর পুড়িয়ে পুড়িয়ে নৃশংস কায়দায় মানুষ হত্যার বীভৎসতা প্রত্যক্ষ করেছে দেশবাসী। তাই নেতাদের বন্ধমূল ধারণা, দুই নগরবাসী কোনভাবেই বিএনপি-জামায়াতের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে দেশকে আরও অন্ধকারের দিকে কোনমতেই ঠেলে দেবে না। এমন যুক্তি দেখিয়ে আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলীয় জোটের নেতাদের মত হচ্ছে, বিএনপি যতটা সহজে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার স্বপ্ন দেখছে, তা শুধু স্বপ্নই থেকে যাবে। বাস্তবে কখনও প্রতিফলিত হবে না। কেননা, আন্দোলনের নামে তারা গত প্রায় তিন মাস ধরে যেভাবে সাধারণ মানুষকে আগুন ও পেট্রোলবোমা দিয়ে হত্যা করেছে, চিরতরে পঙ্গু করে দিয়েছে, মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্য ধ্বংস করে পথে বসিয়েছে- তাতে বেশিরভাগ সচেতন মানুষ তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এসব মানুষের কাছে বিএনপি ও ২০ দলীয় জোট একটি সন্ত্রাসী-জঙ্গীবাদী জোটে পরিণত হয়েছে। বিবেকবান ও সচেতন ভোটাররা কোনভাবেই এই সন্ত্রাসী-জঙ্গী জোটের প্রার্থীকে ভোট দেবে না।
×