ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

উচ্চ আদালতের আদেশ উপেক্ষিত ॥ ৩শ’ নদী বিপন্ন!

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ৫ এপ্রিল ২০১৫

উচ্চ আদালতের আদেশ উপেক্ষিত ॥ ৩শ’ নদী বিপন্ন!

বিকাশ দত্ত ॥ নদী-খাল দখল দূষণ রোধে উচ্চ আদালতের আদেশ উপেক্ষিত হচ্ছে। উচ্চ আদালতের আদেশ না মানায় বাংলাদেশে ছোট-বড় যে তিন শতাধিক নদী আছে তা আজ হারাতে বসেছে। ত্রিশটি নদী ও খালের দখল, পুনরুদ্ধার ও দূষণ রোধে আদালতের আদেশ থাকা সত্ত্বেও নদী ও ভূমিখেকোদের কবল থেকে নদী ও খালগুলোকে বাঁচানো যাচ্ছে না। রাজধানী ঢাকার চারপাশে বুড়িগঙ্গা-তুরাগ-শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীর অবস্থাও খুবই করুণ। নদীখেকোদের কারণে আজ দেশের নদ-নদীগুলো তাদের মানচিত্রও হারাতে বসেছে। ভরাটের কারণে পানি প্রবাহ কমে গেছে। স্রোতস্বিনী নদীগুলোতে জেগে উঠেছে ছোট-বড় অনেক চর। নদীর নাব্য হারানোর ফলে দূষণের মাত্রাও বেড়ে গেছে। বুড়িগঙ্গার পানিতে ক্রোমিয়াম পাওয়া গেছে প্রতিলিটারে দশমিক ৪৭ মিলিগ্রাম। কোথাও কোথায়ও অক্সিজেনের মাত্রা শূন্যের কোঠায়। পানি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। নদী দখলের কারণে দেশের ছোট-বড় ২৩০টি নদীর মধ্যে ১৭৫টি নদীই মৃতপ্রায়। এ ছাড়া প্রতি বছরই দুই একটি করে নদী মরে যাচ্ছে বা শুকিয়ে যাচ্ছে। নদীগুলো শুকিয়ে যাবার কারণে তার প্রভাব হাওড় বিলেও পড়ছে। যার ফলে বর্ষার সময়ে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। পাশাপশি নদী ভাঙ্গনের মাত্রাও বেড়ে গেছে। অন্যদিকে নদনদী ও মিঠা পানির প্রায় ৬৫ প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। নদী দখলের প্রভাব প্রাণিকুলেও পড়েছে। নদী শুকিয়ে যাবার ফলে পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে এরই মধ্যে ১৮ প্রজাতির প্রাণী হারিয়ে গেছে। সুন্দরবনেও এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। সুন্দরী, কেওড়া, গোলপাতাসহ মূল্যবান সম্পদ ধ্বংসের সম্মুখীন। একই সঙ্গে অনেক পাখি, বন্যপ্রাণী, বনজ উদ্ভিদ ও পোকামাকড়ের বহু প্রজাতিও বিলুপ্তির পথে। সবকিছুর ওপরই প্রভাব পড়েছে নদী দখলের কারণে। পরিবেশ সচেতন আইনজীবীগণ বলেছেন, হাইকোর্টের নির্দেশ অনুসারে পদক্ষেপ নেয়া হলে বুড়িগঙ্গাসহ চার নদী রক্ষা করে রাজধানী ঢাকাকে ভেনিস হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। নদী খাল পুকুর জলাধার ভরাট বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকলেও প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তায় অনেক ক্ষেত্রেই প্রভাবশালীদের কারণে এগুলো ভরাট হচ্ছে। নদীর প্রবাহ কমে যাওয়ায় কারণে অনেক জলজ প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতিতে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। নদী লিজ নেয়ার নামে ব্যবসাটাকে প্রধান হিসেবে দেখছে লিজকারীরা। তারা লিজ নিয়ে নদী দখল করতে থাকে। কিন্ত বিআইডব্লিউটিএ অর্থের স্বার্থে নিষ্ক্রিয় থাকে। যারা আইন অমান্য করে নদী ভরাট, পরিবেশ দূষণের মাধ্যমে গোটা জাতির জন্য ক্ষতিকর ভূমিকা রাখছে, তাদের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির জন্য বিচারের মুখোমুখি করা প্রয়োজন। সূত্র জানায়, ঢাকাবাসী যে পানি ব্যবহার করছে সেটা আসে সায়েদাবাদ প্লান্ট থেকে। বুড়িগঙ্গা নদী থেকে পানি নিয়ে আসা হয় ঐ প্লান্টে। কিন্তু বুড়িগঙ্গায় ধাতব জাতীয় পদার্থ ক্রোমিয়ামসহ অন্যান্য পদার্থের মাত্রা বৃদ্ধির কারণে সায়েদাবাদ প্লান্টের মাধ্যমে পানি সম্পূর্ণ পরিশোধন করা সম্ভব হচ্ছে না। যার ফলে ঐ পানিই পান করা হচ্ছে এবং নানা কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে স্বাস্থ্যের ঝুঁকি বাড়ছে। রাজধানীর ভেতর ও বাইরে ছোট-বড় ১৮টি নদী রয়েছে। আর ঢাকার অভ্যন্তরেই রয়েছে ৪৩টি খাল। কিন্ত সবই আজ বিলীন। একমাত্র এখনও চোখে পড়ে বুড়িগঙ্গা, বালু, তুরাগ ও শীতলক্ষ্যা নদী। তাদের অস্তিত্বও আজ বিপন্ন। বুড়িগঙ্গা নদীর পানি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে সেখানে কোন মাছ বাঁচতে পারে না। নদীর পচা দুর্গন্ধ পানিতে নৌকা লঞ্চ চলাচল করছে। যাত্রীদের মুখে রুমাল দিয়েই এই পানিপথে চলাচল করতে হয়। এই সমস্যার মূলে রয়েছে ট্যানারি কারখানা। ট্যানারিগুলোতে প্রতিদিন প্রায় ২২ হাজার ঘনমিটার তরল বর্জ্য ও ১০ মেট্রিক টন কঠিন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। সেগুলো কোন না কোনভাবে বুড়িগঙ্গায় গিয়ে পড়ছে। এ প্রসঙ্গে হিউম্যান রাইটস এ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) প্রেসিডেন্ট এ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ জনকণ্ঠকে বলেন, নদীগুলোর বর্তমান যে অবস্থা তা ভয়াবহ। সংবিধানে এবং আলাদা আইনে খাল নদী পুকুর জলাধার ভরাট বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকলেও প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তায় অনেক ক্ষেত্রেই প্রভাবশালীদের কারণে ভরাট অব্যাহত রয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ আইনগুলো অমান্য করে প্রজেক্ট গ্রহণ করা হয়। যদিও আদালত প্রায় ক্ষেত্রেই বিভিন্ন প্রতিকার মূলক আদেশ দিচ্ছেন। সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য অনেক ক্ষেত্রেই বেগ পেতে হয়। এমনও ঘটনা ঘটে যে পুকুর দখল করার জন্য বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহার করা হয়। যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুকুর, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের হল নির্মাণের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহার করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, চার নদী রক্ষার ব্যাপারে অনেক সময় পদক্ষেপ নিয়েছি। কোন কোন ক্ষেত্রে কিছু অগ্রগতিও হয়েছে। কপোতাক্ষ নদের অভ্যন্তরে বাঁধ নির্মাণ করে সরকারীভাবেই প্রজেক্ট নির্মাণ করা হয়। সুতরাং বিষয়গুলো প্রশাসনকে সতর্কভাবে দেখা উচিত। কারণ পরিবেশ আমাদের বেঁচে থাকার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নদীর প্রবাহ কমে যাওয়ায় নদীতে অনেক প্রাণীর অস্তিত্ব বিপন্ন হচ্ছে। প্রবাহ কমার অন্যতম কারণ ভারত থেকে যে সমস্ত নদীর পানি প্রবাহ আসে সেগুলোর নিয়ন্ত্রণ। বুড়িগঙ্গাসহ চার নদীকে রক্ষা করে ঢাকাকে ভেনিস হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। যদি হাইকোর্টের নির্দেশ অনুসারে পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা হয়। এদিক থেকে বিআইডব্লিউটিএ’র ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ তাদের নদীর তীর রক্ষা করার দায়িত্ব দেয়া হলেও তারা নিজ ব্যবস্থার মাধ্যমে নদী দখল উৎসাহিত করে। অন্যদিকে সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক সিনিয়র আইনজীবী শ.ম. রেজাউল করিম জনকণ্ঠকে বলেছেন, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়কে উপেক্ষা করে ঔদ্ধত্য দেখাবার দুঃসাহস যাদের রয়েছে তারা আইনের শাসনের শত্রু, পরিবেশের শত্রু, প্রকৃতির শত্রু। এই গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কিছু দুর্নীতিবাজ ব্যক্তির কখনও কখনও কিছু জনপ্রতিনিধিও পরোক্ষভাবে এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন। প্রকাশ্য দিবালোকের মতো সত্য বিষয়কে কোনভাবে তোয়াক্কা না করে যারা নদী ভরাট, পরিবেশ দূষণের মাধ্যমে গোটা জাতির জন্য ক্ষতিকর ভূমিকা রাখছে, তাদের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির জন্য বিচারের মুখোমুখি করা না হলে অপরাধের প্রবণতা বাড়তেই থাকবে। ঢাকার চার নদী রক্ষার জন্য ২০০৯ সালের ২৫ জুন হাইকোর্ট রায় প্রদান করে। এরপর হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আপীল দায়ের করলে ২০১০ সালের ৩ মে আপীল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে আবেদনের নিষ্পত্তি করে দেন। হাইকোর্ট সে সময় চার নদী রক্ষায় ১২ দফা দিকনির্দেশনা দিয়েছিল। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ নদী থেকে উৎপন্ন হয়ে ঢাকা জেলার বিভিন্ন অংশ দিয়ে অবশেষে নারায়ণগঞ্জের কাছে ধলেশ্বরী নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। আবার অনেকে মনে করেন বুড়িগঙ্গার উৎস যমুনা নদী। অন্যদিকে তুরাগ নদী গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর উপজেলার বংশী ভাওয়াল গড়ের পাহাড়ীয়া এলাকা থেকে উৎপন্ন হয়ে বুড়িগঙ্গার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। শীতলক্ষ্যা নদী নরসিংদী জেলা ও বালু নদী গাজীপুর জেলার টঙ্গী খাল থেকে উৎপন্ন হয়ে শীতলক্ষ্যায় মিলিত হয়েছে। সে দিক দিয়ে এই চার নদীর গুরুত্ব অনেক। যে সংগঠনগুলো এগিয়ে এসেছে ॥ নদী বাঁচাতে বেশ কিছু বেসরকারী সংগঠন এগিয়ে এসেছে। এর মধ্যে রয়েছে হিউম্যান রাইটস এ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি), পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা), পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনসহ (পবা) অন্যান্য সংগঠন। তারা নদী দখল দূষণের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট করেছেন। রিটের কারণে আদালত বেশ কিছু আদেশও দিয়েছে। দেশের অধিকাংশ নদীরই নাব্য হারিয়ে গেছে। অনেক জায়গায় নদীর চিহ্নও নেই। দূষণ, দখল, অবৈধভাবে বালু ও পাথর উত্তোলন থেকে নদীগুলোকে রক্ষার জন্য দেশের হাইকোর্ট এগিয়ে এসেছে। নদী রক্ষায় তারা আদেশ দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে ক্ষমতাশালীদের কারণে কিছুই করা যায়নি। বুড়িগঙ্গাসহ যে সমস্ত নদী রক্ষায় আদেশ ॥ নদী ও খাল দখল দূষণ রোধে হাইকোর্টে সবচেয়ে বেশি মামলা করেছে হিউম্যান রাইটস এ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি), এই সংগঠনটি ঢাকার বুড়িগঙ্গা, গাজীপুরের তুরাগ, কপোতাক্ষ, কীর্তনখোলা, মেঘনা, গোমতী, সন্ধ্যা, কালীগঙ্গা, মুক্তেশ্বরী, কর্ণফুলী, বুড়িসাগর, শীতলক্ষ্যা, বালু, ইছামতি, ধলেশ্বরী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ডোলরাঙ্গা নদী। তুরাগ, বুড়িগঙ্গা সংযোগকারী খাল হাইকার খাল, বরিশালের জেল খাল রক্ষায়ও এইচআরপিবি হাইকোটে রিট করেছে। এবং আদালত অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে আদেশও প্রদান করেছেন। অন্যদিকে বেলা বেশ কিছু নদী রক্ষায় এগিয়ে এসেছে যার মধ্যে রয়েছে নাটোরের নারদ নদ, নীলফামারীর বরকোয়া, ভৈরব নদ, সিলেটের যাদুকাঠি, পিয়াইন, ডাউকী, ধলা নদী, বরিশালের রামনাবাদ নদী, সুনামগঞ্জের দাদুকাঠি নদী রক্ষায় হাইকোর্ট কিছু নির্দেশনাসহ আদেশ দিয়েছেন। এর পরও দেশের নদনদীর অবস্থা খুবই করুন। বেশির ভাগ নদীই নিশ্চিহ্ন হবার উপক্রম হয়েছে। আবাসন ও শিল্পায়নের নামে চলছে নদী দখল। বালু দিয়ে রাতারাতি নদী ভরাট করে তৈরি করা হচ্ছে আবাসন শহর। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে নদী। এ সব নদী ছাড়াও অন্যান্য নদীতেও এখন দখল কাজ চলছে। সেখানে ভরাট করে বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে ভৈরব নদ, রূপসা ও ময়ূর নদ, বাঁকখালী, শিববাড়িয়া নদী, বড়াল, আত্রাই, কাকেশ্বরী, সুতিখালি, ইছামতি, করতোয়া, গোহালা, চিকনাই, ধরলা, দুধকুমার, তিস্তা, ঘাঘট, ছোট যমুনা, নীলকুমার, বাঙ্গালী, বড়াই, মানস, কুমলাই, সোনাভরা, হলহলিয়া, জিঞ্জিরাম, বুড়িতিস্তা, যমুনেশ্বরী, মহানন্দা, টাঙ্গান, কুমারী, রতœাই, পুনর্ভবা, ত্রিমোহনী, তালমা, ঢেপা, বুরুম, কুলফি, বালাম, ভেরসা, ঘোড়ামারা, পিছলাসহ দুই শতাধিক নদী, শাখা নদী, উপনদী, চলনবিল, ঘুঘুদহ বিল, গাজনার বিল, শিকর বিল, হাড়গিলার বিল, দীঘলাছড়ার বিল, বোছাগাড়ীর বিল, ইউসুফ খাঁর বিল, নাওখোয়া এসব নদী, নালা, খাল-বিল খনন ও সংস্কার না করায় দিন দিন ভরাট হয়ে যাচ্ছে। যার ফলে মাছের বংশ বৃদ্ধি ও উৎপাদনে ব্যাহত হচ্ছে। বিদেশীদের চোখে বুড়িগঙ্গা ॥ ৪০০ বছর আগে বুড়িগঙ্গার নদীর তীরে গড়ে উঠে ঢাকা শহর। বাংলার সুবেদার মুকাররম খাঁ বুড়িগঙ্গার সৌন্দর্য্যরে জন্য কাজ করেছেন। ১৬১০ সালের বুড়িগঙ্গার তীরেই সামরিক নৌবহর ভিড়িয়ে সুবেদার ইসলাম খান চিশতি ঘোষণা করেছিলেন, সোনারগাঁও নয়, এখানেই হবে বাংলার রাজধানী। ১৮০০ সালে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক আবাসিক প্রতিনিধি জন টেইলর বুড়িগঙ্গা নদী দেখে মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন- বর্ষাকালে যখন বুড়িগঙ্গা পানিতে ভরপুর থাকে তখন দূর থেকে ঢাকাকে দেখায় ভেনিসের মতো। ওইসব বিদেশীদের কথা আজ পৌরানিক কাহিনীর মতোই লাগে। সেই বুড়িগঙ্গার আগের ঐতিহ্য এখন আর নেই। এখন বুড়িগঙ্গা যে চেহারা তা কল্পনা করার মতো নয়। তখন বুড়িগঙ্গার তীরে অপরূপ সৌন্দের্য্যরে সৃষ্টি হতো। আজ তা শুধুই ইতিহাস। বুড়িগঙ্গার পানি দেখলে নামতে ইচ্ছা করে না। ওই পানিতে যারা গোসল করছে তারা নানা ধরনের চর্ম রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদী রক্ষায় হিউম্যান রাইটস এ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরবিপি) একটি রিট দায়ের করে। রিট দায়েরের ফলে ২০০৯ সালের ২৫ জুন হাইকোর্ট ১২ দফা নির্দেশনা দিয়ে একটি মাইল ফলক রায় প্রদান করেন। ঢাকার পাশে চার নদীকে বাঁচাতে বংশী নদী ও ধলেশ্বরী নদী এবং পুলঙ্গী, টঙ্গী, কর্ণপাড় খালের যথাযথ সংরক্ষণের এবং নদীগুলোর সঙ্গে খালগুলোর সঙ্গে যমুনা নদীর সংযোগের বিষয়েও কার্যক্রম গ্রহণে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। উচ্চ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেয় আপীল বিভাগ। এর আগে দখল ও দূষণে জর্জরিত বুড়িগঙ্গাকে রক্ষার জন্য বেলা ১৯৯৮ সালে হাইকোর্ট বিভাগে রিট দায়ের করে। ২০০৮ সালে নাটোরের নারদ নদীকে রক্ষায় বেলা আরেকটি রিট দায়ের করে। ১৭৫টি নদী মৃতপ্রায় ॥ উচ্চ আদালত রায়ের পরও নদীগুলোর চেহারার কোন উন্নতি হয়নি। আরও অবনতি হয়েছে। বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন ওই রায় বাস্তবায়নের দাবিতে সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন কর্মসূচী পালন করছে। অথচ সেই রায়গুলো আজও পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের মূল ভবনের সামনে আয়োজিত এক মানববন্ধনে বক্তারা বলেছেন, পানি ও পরিবেশ আইনের যথাযথ প্রয়োগের ঘাটতিই দেশের নদী দখল ও দূষণের প্রধান কারণ। এদেশের অনেক নদীই রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় পেশীশক্তিধারী ভূমি দস্যুদের দখলে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ও বাংলাদেশ ওয়াটার ইন্টিগ্রিটি নেটওয়ার্কের (বাউইন) আয়োজনে এই কর্মসূচীর মূল উপপাদ্য ছিল ‘টেকসই উন্নয়নে চাই পানি খাতে শুদ্ধাচার’। মানববন্ধনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আমাদের দেশ একটি নদী প্রধান দেশ। এদেশের নদী খাতের দুর্বাবস্থা নজিরবিহীন। নদীর নাব্যতা রক্ষাই বর্তমানে প্রধান হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে বর্জ্য নিষ্কাশন নীতিমালা মান্য করা হয় না বলেই এই দূষণ অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) তথ্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২০০০ সালের পরিবেশ আইনের ৩৬ নম্বর ধারা অনুসারে প্রাকৃতিক জলাধারা বা মিষ্টি পানির প্রধান উৎস সংরক্ষণে আইনী বাধ্যতা থাকলেও ভূমি দস্যুরা নির্বিচারে এদেশের নদী ও জলাশয়গুলো দখল করেছে। ফলে ২৩০টি নদীর মধ্যে এখন ১৭৫টি নদীই মৃতপ্রায়। এছাড়া প্রতিবছরই দু’একটি করে নদী মরে যাচ্ছে বা শুকিয়ে যাচ্ছে। ভারতের পানি প্রত্যাহার অন্যতম কারণ ॥ ভারতের ইচ্ছামতো পানি প্রত্যাহার, জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব আর প্রভাবশালীদের অবৈধ দখল ও ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলনের মহোৎসবের কারণে অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে রাজবাড়ীর প্রমত্তা পদ্মা ও বালিয়াকান্দি উপজেলার এক সময়ের খরস্রোতা গড়াই, চন্দনা, হড়াই ও চিত্রা নদীকে। ফারাক্কার হিংস্র ছোবলে পদ্মাসহ এই পাঁচটি নদী এখন নাব্য হারিয়ে ধু ধু বালুচরে পরিণত হয়েছে। এখন এই নদীগুলো শুধুই ইতিহাস। পদ্মা নদীতে এক সময় ইলিশের ছড়াছড়ি থাকলেও এখন পানি শূন্যতার কারণে ইলিশ তো দূরে থাক স্বাদু পানির মাছও কমে গেছে। ধ্বংসের মুখে প্রাণীকুল ॥ নদী খাল মরে যাওয়ার ফলে এর প্রভাব পড়েছে প্রাণীকুলে। নদী শুকিয়ে যাওয়ার ফলে পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে এরই মধ্যে ১৮ প্রজাতির প্রাণী হারিয়ে গেছে। এর মধ্যে রয়েছে বন মহিষ, গয়াল, নীল গাই, হায়েনা, হপ ডিয়ার, সাম্বার হরিণ, মার্বেল বিড়াল, গোল্ডেন বিড়াল, গোলাপী মাথার হাঁস, ময়ুর, বেঙ্গল ফ্লোরিকান, বড় মদন টাক, রাজ শকুন, মিঠা পানির কুমির ও মেছো কুমির বা ঘড়িয়াল, ভোদর, কুমির ইত্যাদি। এছাড়া ভাতে মাছে বাঙালী বাস্তবে এ প্রবাদের মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। নদী খাল দখল ও ভরাট হওয়ার কারণে দেশের প্রায় ৬৫ প্রজাতির মাছ আজ বিলুপ্তির পথে। সঙ্কটাপন্ন মাছের মধ্যে আছে ফলি, বামোশ, টাটকিনি, তিত পুঁটি, আইড়, গুলশা, কাজুলি, গাং মাগুর, কুচিয়া, নামাচান্দা, মেনি, চ্যাং ও তারাবাইম। বিপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে চিতল, টিলা, খোকশা, এ্যালং, কাশ খাইরা, কালাবাটা, ভাঙন, বাটা, কালিবাউশ, গনিয়া, ঢেলা, পাবদা, ভোল, দারকিনি, রানি, পুতুল, গুজি আইড়, টেংরা, কানিপাবদা, মধুপাবদা, শিলং, চেকা, একঠোঁট্টা, কুমিরের খিল, বিশতারা, নেফতানি, নাপিত কৈ, গজাল ও শাল বাইন। অন্যদিকে চরম বিপন্ন প্রজাতির মাছের তালিকায় রয়েছে ভাঙন, বাটা, নান্দিনা, ঘোড়া মুইখ্যা, সর পুঁটি, মহাশোল, রিটা, ঘাইড়া, বাছা, পাঙ্গাস, বাঘাইড়, চেনুয়া ও টিলাশোল মাছের নাম।
×