ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

চোরাচালান রোধে শুল্ক গোয়েন্দা সংস্থাকে আধুনিক করা হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৬:১৯, ৪ এপ্রিল ২০১৫

চোরাচালান রোধে শুল্ক গোয়েন্দা সংস্থাকে আধুনিক করা হচ্ছে

আজাদ সুলায়মান ॥ প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ, সশস্ত্র নিরাপত্তা ও তদন্তের ক্ষমতায়নসহ ঢেলে সাজা হচ্ছে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতর। হযরত শাহজালালসহ দেশব্যাপী চোরাচালান নিয়ন্ত্রণে মূল ভূমিকা পালনকারী এ সংস্থাকে আরও আধুনিকায়ন ও প্রযুক্তিগত সুযোগ-সুবিধা দেয়ার একটি প্রস্তাব এখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বিবেচনাধীন। ভারতের ডিরেক্টরেট অব রেভিনিউ ইন্টিলিজেন্স (ডিআরআই)-এর আদলে একটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন গোয়েন্দা সংস্থা হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে সংস্থার প্রধান মহাপরিচালক ডক্টর মইনুল খানের সর্বক্ষণিক নিরাপত্তায় একজন গানম্যান মোতায়েন করা হয়েছে। অফিসেও সর্বক্ষণিক আনসার নিয়োগের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। বর্তমানে শুল্ক গোয়েন্দার কাজ চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। জনবল নেই, তথ্যপ্রযুক্তি নেই, নিরাপত্তা নেই, তদন্তের ক্ষমতাও নেই অথচ রাজধানীসহ দেশব্যাপী চোরাচালানের মূল ভূমিকা পালন করছে এ সংস্থা। প্রভাবশালী গডফাদারদের চোরাচালানে আঘাত হানায় হুমকির মুখে পড়েছেন শুল্ক গোয়েন্দার মহাপরিচালকসহ অন্যান্য কর্মকর্তা। সাম্প্রতিক সোনার বড় বড় চালান আটক করে আলোচনার শীর্ষে ওঠে আসা শুল্ক গোয়েন্দা সংস্থাকে আরও শক্তিশালী ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড চেয়ারম্যান মোঃ নজিবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, ‘আধুনিকায়ন সময়ের দাবি। প্রয়োজনের তাগিদেই কিছু পদক্ষেপ নেয়া একান্তই প্রয়োজন। এ সংক্রান্ত প্রস্তাব বিবেচনাধীন রয়েছে। এ বিষয়ে ইতোমধ্যেই প্রধানমন্ত্রী প্রয়োজনীয় সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। একটি শক্তিশালী ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে যা যা করার দরকার, সবই করা হবে।’ জানা যায়, হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর ও চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দরে গত দু’বছরে শুল্ক গোয়েন্দা ইউনিট অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ সোনা আটক করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব মতেই, এ পর্যন্ত প্রায় এক হাজার কেজি সোনা আটক করেছে এ সংস্থা। শাহজালাল বিমানবন্দরের একাধিক সূত্র জানায়, গত দু’বছরে শুল্ক গোয়েন্দা সংস্থা যে পরিমাণ সোনা আটক করেছে, গত চার দশকেও সেটা হয়নি। একের পর এক বড় বড় চালান ধরায় রীতিমতো চোরাচালানীরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। প্রভাবশালীদের সব ধরনের প্রভাব ও তদবির উপেক্ষা করে শুল্ক গোয়েন্দার বর্তমান মহাপরিচালক চোরাচালানের ভীত কাঁপিয়ে দেন। সম্প্রতি প্রভাবশালী দুজন গড ফাদার ধরার পর চোরাচালানীরা দিশেহারা হয়ে শাহজালাল বিমানবন্দর দিয়ে সোনার চালান আনাই বন্ধ করে দেয়। আপাত দৃষ্টিতে বড় বড় চালান আনা অনেকটাই বন্ধ রয়েছে বলে দাবি করেন শুল্ক বিভাগ। সূত্র মতে, শুল্ক গোয়েন্দাদের কঠোর মনোভাবে দেশ-বিদেশের প্রভাবশালী চোরাচালানীরা চরম ক্ষুব্ধ হয়ে আছে। তাদের টার্গেট এখন শুল্ক গোয়েন্দার এ ইউনিট। এমন নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকা শুল্ক গোয়েন্দা কার্যালয়ে নেই কোন কার্যকর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এতে চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগলেও এখনও কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। মগবাজারের ছোট্ট এই অফিসটিতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা বলতে- হাতেগোনা দুজন করে নিরাপত্তা কর্মী গেটে পালাক্রমে ডিউটি করে। দুর্বৃত্তরা অনায়াসে ওই অফিসে ঢুকে কর্মকর্তাদের ওপর হামলা করে অনায়াসে কেটে পড়ার মতো আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন খোদ মহাপরিচালক ডক্টর মইনুল খান। তিনি এ অফিস ও প্রধানের জন্য সর্বক্ষণিক নিরাপত্তার আবেদনও জানিয়েছেন একাধিকবার। অন্তত আনসারের মতো নিরাপত্তাকর্মী মোতায়েনের জন্য আবেদন করা হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। সে আবেদনের কোন সাড়া নেই। তবে এ বিষয়ে রাজস্ব বোর্ড চেয়ারম্যান মোঃ নজিবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, খুব তাড়াতাড়ি আনসার মোতায়েনের বিষয়টি কার্যকর করা হবে। এটার অনুমোদন হয়ে গেছে। জানা যায়, শুল্ক গোয়েন্দা ইউনিটটি এখন আর শুধু চোরাচালান নিয়ে কাজ করছে না। এর পাশাপাশি ভ্যাট ট্যাক্স ফাঁকি দেয়ার ঘটনা, পরিবেশ জনস্বাস্থ্যের প্রতি হুমকিস্বরূপ পণ্য আমদানি নজরদারি, ভেজাল পণ্যের ব্যবসা ও মিথ্যা ঘোষণায় বিদেশী পণ্যের অবাধ আমদানি নিয়ন্ত্রণেও কার্যকর দায়িত্ব পালন করছে। সম্প্রতি সিদ্ধিরগঞ্জের মুন স্টার নামের একটি কারখানায় হানা দিয়ে শুল্ক গোয়েন্দারা জব্দ করে ২০ কোটি টাকা মূল্যের বিদেশী কসমেটিক্স। যেগুলোর কন্টেন্ট ও প্যাকেট আমদানি করা হয় চীন থেকে আর রিফিল করা হতো এ কারখানায়। বিশ্বসেরা ব্র্যান্ডের এসব মালামাল ল্যাবরেটরি পরীক্ষা ছাড়া কারোর পক্ষে ভেজাল পণ্য হিসেবে শনাক্ত করার কোন উপায় নেই। ওই অভিযানের পর শুল্ক গোয়েন্দারা জানতে পারে রাজধানীর অভিজাত বিপণিবিতান ও ডিপার্টমেন্টাল শপে যে সব বিদেশী কসমেটিক্স দেখা যায় তার সবই ওই কারখানা থেকে সরবরাহ করা। সূত্র মতে, ওই কারখানার মালিক বেলায়েত প্রভাবশালী এবং তিনি নিজে শুল্ক গোয়েন্দা অফিসে এসে তার কাজের জন্য তদবির করেন। কিন্তু সব তদবির উপেক্ষা করে ডক্টর মইনুল খান সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় একটি নিয়মিত মামলা করেন। এ বিষয়ে ডক্টর মইনুল খান বলেন, এ বিষয়ে তদন্ত করে দেখা যায় এই বেলায়েতই হচ্ছেন দেশের অন্যতম গডফাদার, যিনি শুধু নকল বিদেশী পণ্যই তৈরি করছেন না, মিথ্যা ঘোষণায় মার্সিডিজ গাড়ি এনেও ব্যবহার করছেন। অথচ তার সম্পদের ঘোষণায় সে গাড়ির কোন উল্লেখ নেই। তিনি এখন পলাতক। তিনি এতটাই প্রভাবশালী যে সব ধরনের তদবির করে শুল্ক গোয়েন্দার ওপর চাপ সৃষ্টি করে চলছেন যাতে তার মালামাল বৈধ বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়। জানা যায়, এ ঘটনার পর থেকে শুল্ক গোয়েন্দার মহাপরিচালকসহ অন্য কর্মকর্তা নিরাপত্তা নিয়ে চরম আতঙ্কে রয়েছেন। এ অবস্থায় গত সপ্তাহে বনানীর নিজ বাসার সামনে গুলিবিদ্ধ হন রাজস্ব বোর্ড ভ্যাট (মুসক) সদস্য ব্যারিস্টার জাহাঙ্গির। তার ওপর এ ধরনের হামলার পর থেকে গোটা রাজস্ব বিভাগে দেখা দেয় চরম আতঙ্ক। অথচ এমন আশঙ্কা অনেক আগেই প্রকাশ করে নিরাপত্তা চেয়েছিলেন ডক্টর মইনুল খান। তিনি জানান, নিরাপত্তার বিষয়টি সবাই অনুধাবন করছেন। শুল্ক গোয়েন্দার অফিসই যেখানে নিরাপত্তাহীন সেখানে চোরাচালানের মতো কঠিন দায়িত্ব পালন করাটা আরও ঝুঁকিপূর্ণ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, পর্যাপ্ত নিরাপত্তার পাশাপাশি এ ইউনিটটির স্পর্শকাতর চোরাচালান মামলাগুলোর সুষ্ঠু তদন্তের জন্য এখতিয়ার চেয়ে একটি আবেদন বর্তমানে বিবেচনাধীন রয়েছে। র‌্যাব, সিআইডি, ডিবি, অন্যান্য সংস্থার মতো শুল্ক গোয়েন্দা সংস্থা মামলা তদন্ত করে চার্জশীট দেয়ার এখতিয়ার চেয়েছে। এটা যে কোন সময় অনুমোদন পেতে পারে। উল্লেখ্য, বর্তমানে চোরাচালান মামলাগুলোর বেশিরভাগই দায়ের করা হয় হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর থানায়। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় এসব মামলার কোনটারই সুষ্ঠু তদন্ত হয় না। মাঝে মাঝে নামকাওয়াস্তে দু’একটি মামলার চার্জশীট হলেও সেগুলো আদালতে ঝুলে যুগের পর যুগ। আসামিদের রক্ষার জন্য পর্যাপ্ত ফাঁকফোকর রেখে এসব চার্জশীট দেয়া হয়। থানা পুলিশের পাশাপাশি কিছু মামলার তদন্ত কাজ ইদানীং ডিবিও করছে। তারপরও পরিস্থিতির কোন উন্নতি ঘটছে না। মহাপরিচালক ডক্টর মইনুল খান মনে করেন, বর্তমানে দেশের সোনার চালানগুলো একের পর এক ধরা হচ্ছে। এগুলোর সোর্স নিয়োগ করে কারা কিভাবে চোরাচালানী করছে সেটা শুল্ক গোয়েন্দার সদস্যরাই ভাল করে জানে। অথচ থানায় যখন মামলাগুলো তদন্ত করা হচ্ছে তখন সব আসামিই হয় পার পেয়ে যাচ্ছে নয় জামিন পাচ্ছে। কিন্তু এই তদন্তের কাজটি যদি শুল্ক গোয়েন্দা নিজেই করত তাহলে অত্যন্ত দক্ষতা ও উৎকর্ষতার সঙ্গে তদন্তের পর কঠিন চার্জশীট দিতে পারত। যেটা এখন পুলিশের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। জানা গেছে, বর্তমানে শুল্ক বিভাগের প্রধান অফিসসহ দেশব্যাপী বিভিন্ন ইউনিটে অর্গানোগ্রাম স্বীকৃত ৩২৯টি পদের বিপরীতে মাত্র ১৯৪ জন কাজ করছেন। এর মধ্যে মাঠ পর্যায়ে সর্বক্ষণিক কর্মী আছেন ১২০টি পদের বিপরীতে মাত্র ৫৪ জন। প্রয়োজনের তুলনায় এ জনবল হাস্যকর। এদের নিয়েই কাজ করছে শুল্ক গোয়েন্দা। বর্তমান কাজের ব্যাপ্তি ও পরিধি হিসেবে এ ইউনিটে দরকার কমপক্ষে এক হাজার জনবল। ডক্টর মইনুল খান বলেন, বর্তমানের অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগে সেই মান্ধাত্মা আমলের গুটিকয়েক জনবল দিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। এর বিপরীতে ভারতের ডিআরআই এর আদলে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি শক্তিশালী বাহিনী গড়ার প্রস্তাব দেয়া আছে। যেখানে থাকবে নিজস্ব অপারেশন টিম, প্রযুক্তির ব্যবহার, আমর্ড ব্যাটালিয়ান, তদন্ত ও প্রসিউকিউশানসহ প্রয়োজনীয় সব বিষয়। তবেই সম্ভব দেশের চোরাচালান রোধ। দেশের সব কটা বিমানবন্দর, স্থলবন্দর ও নৌবন্দরে পণ্য আমদানি রফতানির অজুহাতে চোরাচালান রোধ করাই শুল্ক গোয়েন্দার প্রধান দায়িত্ব। এর বাইরে রাজধানীতে ইদানীং বিদেশী ভেজাল পণ্য আটক ও বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে মালামাল খালাসের সময় চোরাচালান নিরোধ কাজ করছে। কাজের এ বিশাল পরিধির তুলনায় নেই পর্যাপ্ত জনবল নিরাপত্তা ও তদন্তের এখতিয়ার।
×