ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিস্ফোরক ব্যবসা রমরমা

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ৪ এপ্রিল ২০১৫

বিস্ফোরক ব্যবসা রমরমা

গাফফার খান চৌধুরী ॥ নাশকতায় ব্যবহৃত বিস্ফোরকের যোগান আসছে ঢাকার কয়েকটি ম্যাচ ফ্যাক্টরি, অসাধু বিস্ফোরক ব্যবসায়ী আর সীমান্তের অস্ত্রগোলাবারুদ চোরাকারবারির কাছ থেকে। ৫৯ বিস্ফোরক ব্যবসায়ীর অধিকাংশই আড়ালে সন্ত্রাসীদের কাছে মোটা টাকায় বিস্ফোরক বিক্রি করছে। নিয়মিত মনিটরিং করার কথা থাকলেও তার বালাই নেই। ঢাকা থেকে সংগৃহীত বিস্ফোরক দিয়ে তৈরি হচ্ছে হাতবোমা, ককটেল আর হ্যান্ডগ্রেনেড। আর পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ভারতীয় জঙ্গীদের মাধ্যমে স্থল সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছে উচ্চমাত্রার বিস্ফোরক। অস্ত্রগোলাবারুদ সংক্রান্ত বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়েছে প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার সন্ত্রাসী। গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা। পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০০২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত অস্ত্র উদ্ধার সংক্রান্ত ২৩ হাজার ৬০৬টি আর বিস্ফোরক উদ্ধারের ঘটনায় ৫ হাজার ৪২৩টি মামলা হয়েছে। গ্রেফতার হয়েছে অন্তত ৬ হাজার। আর প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত র‌্যাব বিভিন্ন প্রকারের ১১ হাজার ৫১৮টি বিভিন্ন প্রকারের অস্ত্র, ১ লাখ ২২ হাজার ২২৯ রাউন্ড বিভিন্ন প্রকারের বুলেট, ১৬ হাজার ৬৪৭টি বিস্ফোরক (ককটেল, বোমা ও গ্রেনেড), ৫ হাজার ১৯৫ কেজি বিভিন্ন প্রকারের বিস্ফোরক এবং ৩৩৪টি ট্যাঙ্কবিধ্বংসী উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক উদ্ধার করেছে। এসব ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছে সাড়ে ৮ হাজার সন্ত্রাসী। গত বছর বিজিবি বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে ৫৪টি পিস্তল, ৬টি রিভলবার, ৪৪টি বন্দুক, ২৫টি বোমা, ৩০৫ রাউন্ড বিভিন্ন প্রকারের বুলেট ও তিন বোতল গানপাউডার উদ্ধার করে। সীমান্তে যেকোন ধরনের চোরাচালান বন্ধে বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ নিরাপত্তা জোরদার করতে বার বার তাগাদা দিচ্ছেন। প্রায় প্রতিদিনই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে অস্ত্রগোলাবারুদসহ গ্রেফতারের ঘটনা ঘটছে। এরমধ্যে গত বছরের ২ ডিসেম্বর রাজধানীর খিলগাঁও বোস্টন স্কুল এ্যান্ড কলেজের সামনে থেকে সোয়া ৫ কেজি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরকসহ পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয় এইচ এম আতিকুর রহমান (২৪) ও মাহবুবুর রহমান (১৮)। পুলিশ জানায়, গ্রেফতারকৃত আতিকুর রহমান খিলগাঁও পলাশ এডুকেয়ার কোচিং একাডেমির শিক্ষক। অপরজন একই কোচিং একাডেমির অফিস সহকারী। দুইজনই বোমা ও বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ। তারা কোচিং সেন্টারের আড়ালে বিস্ফোরক মজুদের কাজ করে। ঢাকায় বড় ধরনের নাশকতা চালাতে বিস্ফোরকের মজুদ গড়ে তোলা হচ্ছে। বিস্ফোরকের চালানটি তারা শিবিরের এক নেতার কাছে পৌঁছে দিতে যাচ্ছিল। পরবর্তীতে বিস্ফোরকগুলো উচ্চমাত্রার বলে মতামত দেয় বিস্ফোরক পরীক্ষাগার। উদ্ধারকৃত বিস্ফোরক দিয়ে অত্যন্ত শক্তিশালী বোমা ও গ্রেনেড তৈরি সম্ভব ছিল। গ্রেফতারকৃতরা জঙ্গী সংগঠনের সদস্য বলে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয় পুলিশ। এর আগে ডিবি পুলিশ ঢাকা মহানগর যুবদল নেতা কাজী আতাউর রহমান লিটুর বাড়ি থেকে দুই দফায় ৯৭টি শক্তিশালী বোমা উদ্ধার করে। ওই সময় গ্রেফতার হওয়া বাড়ির কেয়ারটেকার বেলায়েত হোসেন ডিবিকে জানায়, বোমাগুলো দীর্ঘদিন ধরে জঙ্গী সংগঠনের সদস্যরা তৈরি করে ওই বাড়িতে মজুদ করে রেখেছিল। চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি থেকে বিএনপির ডাকা অবরোধে ব্যাপক নাশকতার ঘটনা ঘটছে। নাশকতাকারীদের গ্রেফতারে চলমান অভিযানে গত ২০ জানুয়ারি রাজধানীর বনানীতে ছাত্রশিবিরের বোমা তৈরির কারখানা থেকে ১৩০টি শক্তিশালী তাজা বোমা, পেট্রোলবোমা, গানপাউডার, জিহাদী বই ও চাঁদা প্রদানকারী জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের তালিকা উদ্ধার হয়। গ্রেফতার হয় ছাত্রশিবিরের বনানী থানা শাখার সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমানসহ পাঁচজন। পরদিন ২১ জানুয়ারি লালবাগ থানাধীন ঢাকেশ্বরীতে বোমা তৈরির সময় ভয়াবহ বিস্ফোরণে নিউমার্কেট থানা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক বাপ্পীর মৃত্যু হয়। আহত হয় তিনজন। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি হাজারীবাগের একটি বাড়িতে বোমা তৈরির সময় বিস্ফোরণে নিহত হয় জসিম উদ্দিন নামে এক যুবদল নেতা। আহত হয় হাজারীবাগ থানা যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক রাজু হোসেন ও তার ভাই জিসান। পরবর্তীতে গ্রেফতারকৃতদের নানাভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তরফ থেকে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, ঢাকায় বৈধ বিস্ফোরকদ্রব্য বিক্রির দোকানের সংখ্যা ৫৯টি। এসব দোকানের অধিকাংশই বংশাল, সুরিটোলা, করাতিটোলা, লালবাগ, কোতোয়ালি, মিটফোর্ডসহ আশপাশের এলাকায় অবস্থিত। দোকানগুলো কি পরিমাণ বিস্ফোরক আমদানি করে এবং বিক্রি করে তা মনিটরিং করার দায়িত্বে রয়েছে বিস্ফোরক অধিদফতর। প্রতিমাসেই নির্দিষ্ট এলাকার দায়িত্বরত পরিদর্শকের বিস্ফোরক দোকানগুলো মনিটরিং করার কথা। সরকারী হিসাব অনুযায়ী তারা কত বিস্ফোরক এনেছেন এবং বিক্রি করেছেন তার ফিরিস্তি বিস্ফোরক অধিদফতরে জমা দেয়ার নিয়ম। বিক্রির পর বাড়তি থাকা বিস্ফোরক সম্পর্কেও বিস্ফোরক ব্যবসায়ী ও পরিদর্শকের তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার কথা রয়েছে। একাজ শুধু কাগজেকলমে রয়েছে। বাস্তবে এর কোন বালাই নেই। বিস্ফোরক ব্যবসায়ী সমিতিও এ ব্যাপারে মুখ খুলতে নারাজ। তারা বিস্ফোরক বিক্রির পুরো হিসাব সংশ্লিষ্ট অধিদফতরে জমা দেয়া হয়েছে বলে জানান। বাস্তবে বিস্ফোরক অধিদফতরের কাছে বিস্ফোরক বিক্রির প্রকৃত হিসাব নেই। সূত্র বলছে, বাংলাদেশের বৈধ দোকানগুলোতে যেসব বিস্ফোরক বিক্রি হয় তা সার উৎপাদন ও দিয়াশলাই (ম্যাচ) ফ্যাক্টরিতে কাজে লাগে। ম্যাচ তৈরি করতে যে রেড সালফার ব্যবহৃত হয়, তা ককটেল বা হাতবোমা তৈরির কাজেও ব্যবহৃত হয়। ভুয়া ভাউচারে অসাধু বিস্কোরক ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কাছে বিস্ফোরক বিক্রি করে থাকে। আবার সন্ত্রাসী গোষ্ঠীও মোটা টাকা দিয়ে বিস্ফোরক ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে বিস্ফোরক আমদানি করে থাকে। এছাড়া বিভিন্ন ম্যাচ ফ্যাক্টরির মাধ্যমেও এসব বিস্ফোরক যোগাড় করে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। যদিও বিস্ফোরক অধিদফতরের সংশ্লিষ্টদের দাবি, নিয়মিত মনিটরিং করা হচ্ছে। বেআইনীভাবে বিস্ফোরক বিক্রির ন্যূনতম কোন সুযোগ নেই। এ ব্যাপারে র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জনকণ্ঠকে বলেন, সন্ত্রাসী গোষ্ঠী নানাভাবে বিস্ফোরক সংগ্রহ করতে পারে। বিশেষ করে অসাধু বিস্ফোরক ব্যবসায়ী ও ম্যাচ ফ্যাক্টরির সঙ্গে যোগসূত্রের মাধ্যমে সন্ত্রাসীরা বিস্ফোরক সংগ্রহ করে বলে তাদের কাছে গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে। এসব অসাধু বিস্ফোরক ব্যবসায়ী ও ম্যাচ ফ্যাক্টরির সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত আছে। বিস্ফোরক বিক্রির ওপর নজরদারি অব্যাহত আছে বলে জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া বিভাগের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান।
×