ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ড. শাহজাহান মণ্ডল

নিজের একটি আঙ্গুল পোড়াও, তবে ...

প্রকাশিত: ০৪:০৭, ৩ এপ্রিল ২০১৫

নিজের একটি আঙ্গুল পোড়াও, তবে ...

কবিগুরু রবি ঠাকুরের ‘জুতা আবিষ্কার’ কবিতার ভাবাংশ ধার করে শিরোনামটি দেয়া। হবু চন্দ্র রাজার চরণ যখন ধুলোয় লেপ্টে যাচ্ছিল তখন তা থেকে পরিত্রাণের উপায় খোঁজা হচ্ছিল। গবু চন্দ্র মন্ত্রীর পরামর্শে একবার ঝাঁটা দিয়ে ধুলো দূর করার চেষ্টা করে রাজ্যকে ধুলোময় করা হয়, আরেকবার পানি দিয়ে ধুলো দূর করতে গিয়ে রাজ্যকে কাদাতে ভরপুর করা হয়। তখন এক মুচি এসে রাজাকে পরামর্শ দিল, রাজা মশায়, চামড়া দিয়ে আপনার দুটি চরণ ঢাকুন তবে, ধরণীকে আর ঢাকিবার নাহি হবে। রাজা রাজি হওয়ায় মুচি তাঁর পা দুটোকে চামড়া দিয়ে মুড়িয়ে দিল, মানে তাঁকে জুতো পরিয়ে দিল। রাজার পায়ে আর ধুলো লাগল না। বাঁচিল গবু, রক্ষা পাইল ধরা। জুতা আবিষ্কারের এ কাহিনী এদেশের তিন (?) বারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া আর তৎপুত্র হাওয়া ভবনের বাদশাহ তারেক রহমান পড়েছেন কিনা জানি না, তবে তাঁদের হুকুমদাস মন্ত্রীদের কাছে হয়ত শুনেছেন। এদেশের গণতন্ত্র নাকি মরে যাচ্ছিল গত ৫ জানুয়ারি ২০১৫। এ দিনটি ছিল বর্তমান সরকারের এক বছর পূর্তির দিন। তো তাকে বাঁচানোর জন্য ল-নে থেকে সাত বছর চিকিৎসা সেবা রপ্তকারী তারেক জিয়া ইটিভি মারফত আগের দিন গভীর রাতে খালেদা জিয়াসহ কিছু বাংলাদেশী হুজুর বাবার কাছে ঝাড়-ফুঁক পাঠিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার যখন ঐ তারিখে বলল যে, গণতন্ত্রের কোন অসুখ হয়নি, সে ভাল আছে আলহামদুলিল্লাহ্, তখন বিএনপি-জামায়াতের শিক্ষানবিস ডাক্তার-কম্পাউন্ডাররা তা মানল না। চিকিৎসা শুরু করল জনগণতন্ত্রের। লন্ডনী প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী তারা ঘোষণা করল লাগাতার অবরোধ আর হরতাল নামক ধ্বংসলীলা। বাংলাদেশের শিরায়-উপশিরায় তথা পথে-ঘাটে, অলিতে-গলিতে তারা চালাতে লাগল পেট্রোলবোমা, ককটেল। বাসভর্তি মানুষের গায়ে জ্বালিয়ে দিল আগুন। পুড়িয়ে হত্যা করল পঞ্চাশের বেশি মানুষ। সোয়া শ’ জনকে পুড়িয়ে পাঠাল ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে। গত ২৭ ফেব্রুয়ারিও নারায়ণগঞ্জে দগ্ধ করল ছয়জন মানুষকে। পুড়িয়ে ছাই করল কয়েক শ’ যানবাহন, ভাংচুর করল হাজারের বেশি। ওদিকে বিএনপির গুলশান কার্যালয়ে তপস্যারত তারেক-মাতা খালেদা জিয়া। নিরন্তর প্রার্থনা তার, হে আল্লাহ, যায় যত যাক প্রাণ, আমি হতে চাই হীরকের রাজার মতো ভগবান। হে ভগবান একটা টোকা লাগিস যেন হাসিনার গদিতে ইত্যাদি ইত্যাদি। আল্লাহ একেবারেই তাঁর কথা শুনলেন কিনা জানি না, তবে দেশের কিছু সম্পদ নষ্ট হলো, পর্যটকরা এদেশে বেড়াতে আসা বন্ধ করল। কিছু রেমিটেন্স আসা বন্ধ হলো। জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি হলো, কিছু মানুষ পুড়ল-মরল, কিঞ্চিৎ হলেও তৃপ্ত হলো খালেদা-তারেকের মন। ২০১৪-’র ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বিএনপিসহ বিশ (বিষ) দলীয় জোট চেয়ে আসছিল নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরকার। তাই কদিন আগে নবেম্বরের ২৮ তারিখ নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা বিষয়ক সংলাপের আহ্বান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লাল টেলিফোনে জানিয়েছিলেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াকে। সে আহ্বানকে খালেদা শুধু পায়েই ঠেলেননি, নির্বাচন বর্জন ও বন্ধ করার জন্য তা-ব চালিয়েছিলেন দেশব্যাপী। কিন্তু সংবিধান তথা প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন অনুযায়ী নির্বাচন থেমে থাকেনি। আইনসম্মতভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতিও পেয়েছে। ফলে খালেদা জিয়া আর সংসদে বিরোধীদলীয় নেতাও থাকতে পারেননি। ঐ পদটি দখল করেছেন জাতীয় পার্টির রওশন এরশাদ। কিন্তু কোন কালে ঘি খেয়ে আঙ্গুল শোঁকার মতো এখনও বিশ (বিষ) দলীয় জোটের একটাই দাবি, সুপ্রীমকোর্টের রায়ে অবৈধ ঘোষিত হওয়া এবং ২০১১-তে সংবিধান থেকে বাতিল হওয়া ঐ কেয়ারটেকার সরকারই চাই, ৯০ দিনের জন্য এসে আড়াই বছর থাকলেও ভাল, ঐ সরকারই চাই, কলা ছুলে দাও, কলা ছুলে দাও, কলা ছুললে কেন, বোজায়ে দাও। অনেককে বলতে শুনেছি, সেদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খালেদার দরজায় অপমান হজম করেও যে দাঁড়িয়ে ছিলেন তাতে একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল বরফ গলার, আলোচনার একটা মনোভাব তৈরি হওয়ার এবং এক পুত্রহারা মাকে ১৭ জন স্বজনকে এক-দিনে-হারানো একজন সর্বহারা মহীয়সী শেখ হাসিনার সমবেদনা জানানোর। কিন্তু আমার তার চেয়ে বেশি কিছু মনে হয়েছিল। মনে হয়েছিল, খালেদা বা তাঁর খয়ের খাঁ-রা যদি একটু তেমন সুযোগ দিতেন দুই নেত্রীর দেখা করানোর, তাহলে শুধু গুলশান অফিসের তালা বা দরজাই খোলা হতো না, খুলে যেত বাংলাদেশের সম্ভাবনার অনেক অনেক দ্বার, বাংলার বহু মায়ের সৌভাগ্যের দ্বার, দূরে যেত বহু মায়ের সন্তান হারাবার সম্ভাবনা। হয়ত বা আর পরের দিন থেকে পেট্রোলবোমায় ঝলসে যেতে হতো না কোন বাসের বা লঞ্চের যাত্রীকে কিংবা কোন ড্রাইভার বা হেল্পার ভাইকে। কিন্তু তার পরিবর্তে যা দেখা গেছে তা হলো খালেদা জিয়ার গোঁয়ার্তুমি, আরও নিষ্ফল হরতাল, আরও অনাকাক্সিক্ষত অবরোধ, আরও জ্বলন, আগুনে পোড়া মানুষের আর্তচিৎকার। আবার কেন যেন মনে হয়েছে, পুত্রের মৃত্যুশোক খালেদা জিয়াকে তেমন ছোঁয়নি আগুনে-মরা সন্তানের মায়ের শোকের মতো। তাঁর উপলব্ধি তবে হবে কিভাবে? বোধ হয় একটা উপায়ে হতে পারে খালেদা জিয়া ও তাঁর তোষামোদকারীদের বোধোদয়। খুব সামান্য সে উপায়। এঁদের কেউ যদি একটি জ্বলন্ত মোমবাতি দিয়ে তাঁর হাতের একটি আঙ্গুল একটানা মাত্র একটি মিনিট পোড়ান, তাহলেই উপলব্ধি করতে পারবেন, পেট্রোলবোমার আগুনে দেহের ১০০% পুড়ে গেলে কী যন্ত্রণা। কবিগুরু রবি ঠাকুর বেঁচে থাকলে এঁদের জন্য হয়ত লিখতেন, নিজের একটি আঙ্গুল পোড়াও তবে, মানুষকে আর পোড়াবার নাহি হবে। লেখক : অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
×