ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

অদ্ভুত আঁধার নেমেছে এক

প্রকাশিত: ০৪:০৬, ৩ এপ্রিল ২০১৫

অদ্ভুত আঁধার নেমেছে এক

এবারে চাপাতিসহ হত্যাকারীরা ধরা পড়েছে। না, পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কোন বাহিনী নয়, নিতান্ত সাধারণ দু’জন মানুষ, হিজড়া নাম দিয়ে সমাজ যাদের অপাঙ্ক্তেয় করে রেখেছে, তারা এগিয়ে এসেছে বিপন্নকে বাঁচাতে, দুষ্টের দমনে। নিজের হাতে আইন তুলে নেয়নি, পুলিশের হাতেই হত্যাকারীদের তুলে দিয়েছে। একটি জাতীয় দৈনিকের প্রথম পাতায় ওয়াশিকুর রহমান বাবুর লাশের ছবিটি আছে। ধারালো চাপাতির কোপে থুঁতনির নিচে বড় ফাঁক হয়ে আছে। প্রথম দৃষ্টিতে তা একটি খোলা মুখ বলে ভ্রম হয়। পরক্ষণেই বোঝা যায় দাঁতের পাটিসহ খোলা মুখ তো উপরে। ছবিতে কপালের নিচে এবং বাম গালে কালো কালির পোঁচ দেয়া হয়েছে। এ দুটো স্থানে কোপের চিহ্ন হয়ত আরও বীভৎস। তা আড়াল করতেই কালির পোঁচ। সে চেষ্টা ক্যামেরাম্যান, রিপোর্টার বা পত্রিকার সম্পাদক যতই করুন, এই হত্যাকাণ্ডের হিম-শীতল ভয়াবহতা তাতে কোনভাবেই আড়াল হয় না। চাপাতির এবড়ো-থেবড়ো কোপে রক্তাক্ত সেই মুখ, মাথা পত্রিকার ছবি না হলেও তাতে কোন হেরফের হয় না। কেন? তা বোঝা যাবে নিহত বাবুর ছবিটির নিচে আর একটি ছবির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে। দু’জন হত্যাকারীর ছবি। হেফাজতের আমির শফির পরিচালনাধীন চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার ছাত্র জিকরুল্লাহ এবং খোদ ঢাকা শহরের মিরপুরের দারুল উলুম মাদ্রাসার ছাত্র আরিফুল ইসলাম। নরসিংদীর রায়পুরা থানার গজারিয়াকান্দা গ্রামের মইনউদ্দিন সাহেবের পুত্র জিকরুল্লাহ নিষিদ্ধ ঘোষিত জেএমবির জঙ্গী সদস্য হিসেবে ইতোপূর্বে ধরা পড়লেও দ্রুতই ছাড়া পায় জামিনে। আমির শফির মাদ্রাসায় সে তালিম নিয়েছে ইমানী দায়িত্ব পালনের। ঠাণ্ডা মাথায় বাবুকে হত্যা করতে চাপাতি চালিয়েছে। আরেক খুনী আরিফুল ইসলামের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার তিতাস থানার বারোকাউনিয়া গ্রামে। পিতার নাম তাজুল ইসলাম। ছবিতে এই দুই হত্যাকারীর চেহারা ভাবলেশশূন্য। কোন অনুশোচনার ছাপ নেই। মাদ্রাসার পোশাক তারা পরেনি, মাথায় টুপি নেই। হাফহাতা বাহারি টি শার্ট তাদের গায়ে। দলনেতা মাসুম তাদের চাপাতি দিয়েছে, বাবুর ছবি দিয়েছে, তেজগাঁয়ের বেগুনবাড়ির বিসমিল্লা ভবন, তাতে যাবার সরু গলিপথ চিনিয়েছে। কি বলেছে ঘাতক দু’জন? ‘ব্লগ কি বুঝি না। আর তার লেখাও আমরা দেখিনি। হুজুরেরা বলেছেন সে (বাবু) ইসলামবিরোধী। তাকে হত্যা করা ইমানী দায়িত্ব। ইমানী দায়িত্ব পালন করলে বেহেশতে যাওয়া যাবে। সেই ইমানী দায়িত্ব পালন করতেই ওয়াশিকুরকে হত্যা করেছি।’ আমাদের এই বাংলাদেশে পুরো নামের সঙ্গে ছোট্ট ডাকনাম থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মায়েরাই সে নামটি রাখেন। ওয়াশিকুর রহমানের সঙ্গে বাবু নামটি হয়ত তার মা রেখেছিলেন। কিন্তু সেই মা বেশিদিন বাঁচেননি। বাবুর ছোটবোন আশরাফি সুলতানা শিমু। বিশ বছর আগে বাবু ও শিমুকে ছেড়ে মা চলে গেছেন পরপারে। বাবুর বয়স তখন ছয় কি সাত। শিমু তো আরও ছোট। শিমু বলেছে, ‘বাবা আমাদের ভাইবোন দু’জনকে কোলেপিঠে অনেক কষ্টে মানুষ করেছেন। ছোটবেলা থেকে ভাইয়া খুব মেধাবী ও শান্ত স্বভাবের ছিল। সে কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত ছিল না। শুনেছি ব্লগে একটু লেখালেখি করত। এজন্য জামায়াত-শিবির ও জঙ্গী সংগঠনের কেউ এ হত্যা করতে পারে। এছাড়া আমার ভাইয়ের কোন শত্রু ছিল না।’ পিতা টিপু সুলতান ছেলে বাবুকে নিয়ে মাসিক ছয় হাজার টাকায় সাবলেট নেয়া একটি কক্ষে থাকতেন। ঘটনার দিন তিনি ছিলেন গ্রামের বাড়িতে। পুত্রের এমন মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তিনি। এই পিতা, এই বোন- এদের কি জবাব দেবে রাষ্ট্র? কি জবাব আছে সরকারের- সমাজের? ড. অভিজিত রায়ের হত্যাকাণ্ডের পর এক মাসের ওপর সময় চলে গেছে। ফারাবী এবং বাঁশের কেল্লার কথিত মডারেটরকে গ্রেফতার করা ছাড়া সে হত্যাকাণ্ডের কোন সুরাহা রাষ্ট্র বা সরকার করেনি। টেলিভিশনে ওই দুই সন্ত্রাসীর মুখে যে বিদ্রƒপ মেশানো কৌতুকের হাসির আভা দেখেছি, তাতেই বুঝেছি রিমান্ডে বেশ কয়েকদিন রাখলেও তাদের ওপর ফুলের টোকাটিও পড়েনি। এই সম্মানিত মেহমানদের ওপর রাষ্ট্র ছিল বড়ই সদয়। চকিতে মনে পড়ল বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা কেমন আচরণ করেছিল ভিত্তিহীন অভিযোগে গ্রেফতার করা শাহরিয়ার কবির ও ড. মুনতাসীর মামুনের ওপর। এক এগারোর পর আমাকে ও ড. হারুন-অর-রশিদকে চোখ বেঁধে রিমান্ডে নেয়ার কথা মনে পড়ল। রিমান্ড বাড়াতে যখন আমাদের কোর্টে আনা হতো, তখন আমাদের চেহারার সঙ্গে প্রিয় পাঠক আপনারা একটু মিলিয়ে দেখুন হত্যার উস্কানিদাতা ফারাবী ও বাঁশের কেল্লার মডারেটরের মুখের চেহারা। বন্দী এবং রিমান্ডে নেয়া আওয়ামী লীগের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল এবং অপর নেতা ওবায়দুল কাদেরের বিধ্বস্ত চেহারার কথাও একবার স্মরণ করুন। তাতেই স্পষ্ট হয়ে যাবে একদিকে ধর্মান্ধ জঙ্গীগোষ্ঠী এবং অন্যদিকে রাজনীতিবিদ বা বিপন্ন মানবতার পক্ষে দাঁড়ানো আমাদের বিষয়ে রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গিটি কি? কিন্তু তা তো হবার কথা ছিল না। লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করা হয়েছিল, ফারাবী, জিকরুল্লাহ, আরিফুল এবং এদের মাথায় যারা বিষাক্ত প্রাণঘাতী ভাইরাস ঢুকিয়েছে সেই জামায়াত-হেফাজত জঙ্গীদের নির্মূল করে প্রিয় মাতৃভূমির, মানবতার এবং শুভবুদ্ধির ওপর আস্থা যাঁদের আছে তাঁদের সুরক্ষা দেয়া। সেসব কাজের জন্যই রাষ্ট্র তার সেনাবাহিনী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, প্রশাসন, বিচার বিভাগ, কারাগার এবং সর্বোপরি সরকার। কিন্তু বাস্তবে কি হচ্ছে? জামায়াত-হেফাজত জঙ্গী ঘাতকদের হাতে জীবন দেয়া আলোকিত মানুষের তালিকা শুধু দীর্ঘই হচ্ছে। এমন কোন খবর এখনও আমরা দেখিনি যেখানে ওইসব ঘাতকের কেউ অপঘাতে নিহত হয়েছে। বাবুকে হত্যা করে এক ঘাতক পালিয়ে গেলেও বাকি দু’জন ধরা পড়েছে রক্তমাখা চাপাতিসহ। হিজড়া নামে পরিচিত দু’জন মহান মানুষ মৃত্যুভয় না করে, কোন দোদুল্যমানতা না দেখিয়ে ঘাতকদের ধরেছেন। ‘অদ্ভুত আঁধারের’ এই বিপন্ন সময়ে সত্যিকারের চক্ষুষ্মান আপনারা দু’জন। আপনাদের সালাম জানাই, অভিনন্দন জানাই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার কাছে নিতান্ত সাধারণ কয়েকটি নিবেদন আছে। ১) খুনী ঘাতকদের ধরে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে যে দু’জন শিখণ্ডী তাঁদের সম্মানিত করুন, পুরস্কৃত করুন। আমরা ভুলে যাইনি যে, জাতীয় সংসদে শিখণ্ডীদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করে তাঁদের আইনী সুরক্ষা আপনিই দিয়েছেন। ২) যে দুটি মাদ্রাসায় ঘাতকরা তালিম পেয়েছে সেগুলো বন্ধ করে দিন। এই দুই মাদ্রাসা পরিচালনায় যারা যুক্ত আছে তাদের উস্কানিদাতা হিসেবে হত্যা মামলায় আসামি করতে নির্দেশ প্রদান করুন। ৩) হাতেনাতে ধৃত দুই ঘাতকসহ যে চারজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে তাদের দ্রুত বিচার আইনে বিচারের ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিন। ৪) ইসলামী জঙ্গীবাদ মোকাবেলায় আমাদের করণীয় সম্পর্কে জাতীয় আলোচনার ব্যবস্থা অবিলম্বে করুন। শাহবাগের গণজাগরণে অংশ নেয়া তরুণ প্রজন্মকে ডাকুন। তারা আমাদের পথ বাতলে দেবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, অন্ধকারের অপশক্তির হাতে মানবতা এমনভাবে বিপন্ন হতে থাকলে, আলোকিত মানুষের জীবন এমন নির্বিচারে সংহার হতে থাকলে, তাতে রাষ্ট্র ও সরকার এমন নিশ্চেষ্ট থাকলে, তাদের মধ্যে ‘করুণার আলোড়ন’ অনুপস্থিত থাকলে এবং তার ফলে শুভবুদ্ধির পরাজয় ঘটতে থাকলে তার পরিণাম হবে ভয়াবহ। নিশ্চিত থাকুন, আমরা কেউই সেই পরিণাম থেকে রেহাই পাব না। আপনি তা কেন হতে দেবেন? লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
×